ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চয়পত্র কিনছেন ধনী-গরিব সবাই

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ১৩ জুন ২০১৮

সঞ্চয়পত্র কিনছেন ধনী-গরিব সবাই

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পাসের পরের মাসেই সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে ১ থেকে ২ শতাংশ কমতে পারে সঞ্চয়পত্রের সুদহার। এজন্য হিড়িক লেগেছে সঞ্চয়পত্র কেনায়। কিনছেনও ধনী-গরিব সবাই। যদিও এই সঞ্চয়পত্র স্কিম সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণীর জন্য। বিশেষ করে যারা এই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সচ্ছল হবে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার অনেক কমালে মধ্যবিত্ত শ্রেণী সঞ্চয়ে উৎসাহ হারাবে। আর এখনই সঞ্চয়পত্রের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে। কালোবাজারিরা বেশি সঞ্চয়পত্র কিনে এ সঙ্কট আরও প্রকট করতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। সম্প্রতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী জানান, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দুই-তিন বছর পর পর পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু এবার একটু দেরি হয়েছে; পরের মাসেই এটি রিভিউ হবে। সবশেষ ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। মঙ্গলবার সরেজমিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করছেন বিনিয়োগকারীরা। ফরম সংগ্রহ ও জমা দিতে প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগছে প্রতিটি গ্রাহকের। এ বিষয়ে বাংলাদেশে ব্যাংকের মতিঝিল শাখার মহাব্যবস্থাপক মোঃ মাছুম পাটোয়ারী বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটর পর অর্থমন্ত্রী সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এছাড়া ব্যাংকে আমানতের সুদের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি হওয়ায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, এই ঘোষণার পর প্রতিদিনই সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য গ্রাহক ভিড় করেছে। এত লোক যে আমাদের অফিসাররা তাদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মানুষের সঞ্চয়যোগ্য অর্থ বিনিয়োগের জন্য খুব বেশি বিকল্প জায়গা নেই। পুঁজিবাজারে যাওয়ার মতোও পরিস্থিতি নেই। ফলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ দিন দিন বাড়ছে। তিনি বলেন, উচ্চ আয়ের মানুষও অনেক ক্ষেত্রেই এ সুবিধা নিচ্ছে। কীভাবে এটি রোধ করা যায় সংশ্লিষ্টদের সে বিষয়ে নজর দেয়া দরকার। তিনি বলেন, বাড়তি বিক্রির কারণে সুদ পরিশোধ বাবদ রাজস্ব ব্যয় বাড়বে। তাই যারা সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য উপযোগী না তারা যেন সঞ্চয়ত্র কিনতে না পারে সে বিষয়টি সরকারকে সঠিকভাবে মনিটরিং করতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে। সঞ্চয়পত্রে বিক্রি বাড়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনিয়ম আর কারসাজির কারণে দেশের শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কম। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যও তেমন ভাল না। এছাড়া ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদহারের তুলনায় সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি। যার কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় মেটানোর জন্য অনেকেই ব্যাংক থেকে আমানত তুলে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছে। সঞ্চয়পত্রের এ ঋণের টাকা সরকারকে সঠিক জায়গায় বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন এ অর্থনীতি বিশ্লেষক। তা না হলে এই ঋণ বোঝা হয়ে দাঁড়াবে বলেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ। কারণ সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করতে হয়। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদহার: সঞ্চয়পত্রগুলোর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদী পরিবার সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ সুদ পাওয়া যায়। পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশন সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদী ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বর্তমানে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সরকার চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১২ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে। কিন্তু অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সব ধরনের সঞ্চয়পত্রসহ জাতীয় সঞ্চয়স্কিমগুলোতে নিট ঋণ এসেছে ৩৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। যা গোটা অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ১২১.৭৫ শতাংশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে জাতীয় সঞ্চয়স্কিমগুলোতে মোট বিনিয়োগ এসেছে ৬০ হাজার ১২৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের মূল ও মুনাফা পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২৩ হাজার ৪১৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এর মধ্যে কেবল মুনাফা পরিশোধেই ব্যয় হয়েছে ১৪ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। মূল ও মুনাফা বাদ দিয়ে এ খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, আলোচ্য ৯ মাসে সঞ্চয় স্কিমগুলোর মধ্যে বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে। এ খাতে গত ৯ মাসে নিট ঋণ এসেছে ১৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা। এর পরে রয়েছে তিন-মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, নিট ঋণ ১০ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। পেনশনার সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণ এসেছে ৩ হাজার ১০৮ কোটি টাকা। পাঁচ-বছর মেয়াদী সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণ এসেছে ২ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। তাছাড়া মেয়াদী হিসাবে জমাকৃত অর্থ রয়েছে ৫ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে নিট ঋণ আছে ১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে চলতি অর্থবছরে ব্যাংকবহির্ভূত উৎস থেকে সরকারের ৩২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে কেবল জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়ার কথা রয়েছে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
×