ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কেটে গলির মুখে বসা দর্জিদেরও নেই দম ফেলার ফুরসত

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১৩ জুন ২০১৮

মার্কেটে গলির মুখে বসা দর্জিদেরও নেই দম ফেলার ফুরসত

ওয়াজেদ হীরা ॥ সারাবছর কাজের খুব একটা চাপ না থাকলেও ঈদ এলেই সরগরম থাকে মার্কেটকেন্দ্রিক ভাসমান দর্জিগুলো। নির্দিষ্ট টেইলার্সের দোকান না থাকলেও কাজের চাপে হিমশিম খায় তারা। যারা গ্রাহকদের কাছে ‘কাটিং-ফিটিং’ মাস্টার (দর্জি) হিসেবেই পরিচিত। ঈদ কেন্দ্র করে যারা নিজেদের নতুন পোশাক কিনে নিয়েছেন তারা এখন ভিড় জমাচ্ছেন নিজের দেহের সঙ্গে মানানসই করে নিতে এসব ‘কাটিং-ফিটিং’ মাস্টারের (দর্জি) কাছে। দিনরাত কাজ চলছে। বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই। এই কাজেই অনেকের চলে সংসারও। বিভিন্ন মার্কেটের ভেতরে বা পাশেই এসব দর্জির দোকান। দোকান বলাও ভুল হবে। একটি মেশিন নিয়ে ফ্যাশন হাউসের এককোণে বসে পড়ে। এই দর্জিদের মূল কাজ হলো কারো পছন্দের পোশাক তার শরীরের মাপে মেপে কেটে ফিটিং করে দেয়া। শার্ট, গেঞ্জি, প্যান্ট, পাঞ্জাবি বা থ্রিপিস যাই হোক শরীরের সঙ্গে মানানসই করে নিতে সবাই ছোটেন এই মাস্টারদের কাছে। কাটিং করে ফিটিং করে দেয়ার জন্য এদের কাটিং মাস্টার বা ফিটিং মাস্টার বলে ডাকে। পোশাকের দোকানগুলোর মতোই ব্যস্ত তারাও। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মেশিন চলছে। সারা বছর কাজ খুব একটা না থাকলেও ঈদের সময় এদের দম ফেলার সময় নেই। সর্বশেষ গত দুদিন কয়েক জায়গায় দেখা গেছে রাত তিনটায় কেউ কেউ দোকান বন্ধ করছেন। সরেজমিনে চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট, নিউ সুপার মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ফ্যাশন হাউসগুলোর পাশেই সেলাই মেশিন নিয়ে বসে ক্রেতাদের নতুন পোশাক কাটিং ও ফিটিংয়ের কাজ করছেন দর্জিরা। ক্রেতারা তাদের দেহের মাপ অনুযায়ী ঈদের জন্য কেনা নতুন পোশাক কেটে ফিটিং করে নিচ্ছেন। মেয়েদের বেশিরভাগ টেইলারিং শপ রাজধানীর নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়া মার্কেটে হওয়ায় এসব এলাকায় বিভিন্ন বয়সী মেয়ের ভিড় বেশি দেখা যায়। অন্যান্য সময় কাটিং-ফিটিংয়ের যে খরচ এখন তার দ্বিগুণ। তবুও কোন কোন দর্জির কাছে সিরিয়াল দিতে হচ্ছে নয়ত পোশাক রেখে পরে আসতে হচ্ছে। জানা গেছে, একটি প্যান্ট ফিটিং ও লম্বা কাটাতে পূর্বে ৩০-৪০ টাকা নেয়া হলেও এখন ৭০-৮০ টাকা। শার্ট ফিটিং করতে ৬০ টাকা, প্যান্ট ৮০ টাকা, পাঞ্জাবি ফিটিং করতে ১০০-১৫০, থ্রিপিস করতে কাপড়ের কাজ অনুযায়ী ১২০-২৫০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। ঈদের সময় ১০ থেকে ২০ টাকা বেশি মজুরি নেয়া হয় বলেও জানিয়েছেন একাধিক দর্জি। একটি পাঞ্জাবির কাজ করতে করতে দর্জি সুরহাব বলেন, এখন কাজ খুব ভাল। ঈদের আগ পর্যন্ত এমন জমজমটা থাকব। পরে আবার কমে যায়। প্রতিদিন ঠিকমতো কাজ করলে তিন থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা যায় বলেও জানান তিনি। তবে ঈদ ছাড়া কাজ একেবারেই কম থাকে বলেও জানান। প্রায় ১০ বছর ধরে কাটিং ও ফিটিংয়ের কাজ করছেন হানিফল। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের সময় কাজের চাপ একটু বেশি থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ক্রেতার শরীরের মাপ অনুযায়ী একটি পোশাক কেটে, সেই মাপে পোশাক সেলাই করেই ফিটিং করা হয়। এতে ক্রেতাদের পোশাক তাদের শরীরের সঠিক মাপ অনুযায়ী হয়ে থাকে। ঈদের পোশাক ফিটিং করতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শরীরের সঙ্গে ফিটিং করে পোশাক পরা আধুনিক ফ্যাশনের একটি অংশ। ঢিলেঢালা পোশাক পরলে এ যুগের সঙ্গে তাল মেলানো যায় না বলেও জানান তারা। মাহবুবা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, আমি যে জামাটা কিনেছি তা একটু ঢিলেঢালা। তবে এই জামা অন্য দোকানে পাইনি। দর্জি দিয়ে কাটিয়ে ফিটিং করে নিচ্ছি। আমার পছন্দটাও থাকল, কাপড়টাও ফিটিং হলো। আদনান ও তার বন্ধু এসেছিলেন ঈদের নতুন শার্ট কিনতে। চন্দ্রিমা মার্কেট থেকে কিনেছেনও। তবে একটি শার্ট একটু বেমানান হওয়ার কারণে পাশেই থাকা ফিটিং মাস্টারের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করিয়ে নিলেন ৬০ টাকায়। আদনান বলেন, অনেক সময় ঈদে নতুন ডিজাইন আসে। সব সময় দেহের মাপের সঙ্গে মেলানো যায় না। আর এমন ব্যবস্থা যেহেতু আছেই তাই কাপড় পছন্দ হলে ফিটিং নিয়ে চিন্তা নেই। পাশের নিউমার্কেটেও দেখা গেল এসব মাস্টারের কাজের বড় চাপ। সুমন নামের এক ব্যক্তি নিজের পাঞ্জাবি ফিটিং করে নিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আমরা বেশি আধুনিক। সব কিছুই আমাদের মানানসই হতে হয়। যুগ পাল্টে গেছে তো। তবে দাম নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। জানা গেছে, নিউমার্কেট ও চন্দ্রিমা মার্কেটে এসব কাটিং-ফিটিং মাস্টারের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। প্রতি তলায় ফ্যাশন হাউসের কর্নারে রয়েছে এসব দর্জির মেশিন। অন্যান্য সময় কেউ কাটিং-ফিটিং করাতে এলে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়; তবে ঈদের সময় ডাকাডাকির সময় নেই বরং কাজ শেষ হতেই প্রায় মধ্যরাত। এছাড়াও নিউমার্কেটে মেয়েদের লেহেঙ্গা, ওয়ান পিস কাটিং করার জন্য আলাদা ধরনের দর্জি রয়েছে। যাদের কাজ ফিটিং করা হলেও এসবের মেশিনও আলাদা এবং খরচও একটু বেশি বলে জানা গেছে। বিভিন্ন বাহারি ডিজাইনের ওয়ানপিস কাটিং করতে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। ওয়ান পিস জামা কিনে ফিটিং করতে আসা তামান্না নামের এক কলেজের শিক্ষার্থী বলেন, আমরা বেশিরভাগই তো রেডিমেড জামা কিনি। যা অনেক ঢিলা হয়। ঢিলেঢালা পোশাক পরলে নিজেকে স্মার্ট লাগে না। তাই বেশিরভাগ জামা ফিটিং করেই পরে থাকি। কখনও কখনও কাটিং খরচ একটু বেশি হয় বলেও জানালেন এই শিক্ষার্থী। বঙ্গবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে এই ধরনের দর্জিদের কাজের প্রচুর চাপ। বঙ্গবাজারের দর্জি সিরাজুল হক বলেন, আমাদের এখানে বিশ রোজার পর থেকে ঈদের পোশাকের কাটিং ও ফিটিংয়ের কাজের চাপ বেড়েছে কয়েকগুণ বেশি। এখন প্রতিদিন গড়ে পাঁচ হাজার বা তার বেশি টাকা আয় হচ্ছে। এজন্য সকাল থেকে রাতভর পরিশ্রমও হচ্ছে বলে জানান।
×