ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঈদে ২০ কোটি জালনোট বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল চক্রের

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১১ জুন ২০১৮

 ঈদে ২০ কোটি জালনোট বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল চক্রের

শংকর কুমার দে ॥ জালনোট চক্রের গ্রেফতার হওয়া ১০ জনের মধ্যে ৫ জনকে দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পবিত্র ঈদ উল ফিতর ও ঈদ উল আজহা- এই দুই ঈদকে সামনে রেখে সারাদেশে অন্তত ২০ কোটি জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্র। কিন্তু বৃহস্পতিবার ঢাকার বিভিন্নস্থান থেকে জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্র গ্রেফতার হওয়ায় তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। জাল টাকার প্রতারণার খপ্পর থেকে রক্ষা পেয়েছে অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়ার কারসাজি থেকে রক্ষা পেয়েছে সাধারণ মানুষজনও। ডিবি সূত্র জানায়, প্রায় এক কোটি টাকার জালনোটসহ স্বামী-স্ত্রী ও তাদের সিন্ডিকেটের আট সদস্যসহ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেফতার হয়েছে দশ। উদ্ধার হয়েছে অন্তত তিন কোটি টাকার জালনোট ছাপার সরঞ্জাম। ছাপাকৃত এক লাখ জাল টাকা মাত্র দশ হাজার টাকায় বিক্রি করত গ্রেফতারকৃতরা। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঢাকার একটি বাড়িতে জাল টাকা তৈরির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। আসন্ন ঈদে তারা অন্তত তিন কোটি টাকার পাঁচ শ’ ও এক হাজার টাকার জালনোট বাজার ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রও। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে গ্রফতারকৃতরা হচ্ছে, রাজন শিকদার ওরফে রাজা ওরফে রাজু ও তার স্ত্রী লাবণী এবং তাদের সহযোগী রফিক, জাকির, হানিফ, রিপন, মনির, সোহরাব ও জসিম। এর মধ্যে জালনোট চক্রের প্রধান রফিকুল ইসলাম, জাকির শেখ, মোঃ শাওন, হানিফ গাজী ও রাজন শিকদারকে ৫ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবি। ডিবি তাদের বিরুদ্ধে যাত্রবাড়ী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেছে। ডিবি সূত্র মতে, জাল টাকা প্রস্তুতকারী চক্র ইতোমধ্যেই আরও কোটি টাকার জালনোট বাজারে ছেড়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা। জিজ্ঞাসাবাদে জাল টাকা চক্রের সদস্যরা জানায়, তারা ১ লাখ জাল টাকা বাজারে বিক্রি করেছে মাত্র ১০ হাজার টাকায়। জালনোট চক্রের পরিকল্পনা ছিল দুই ঈদে ২০ কোটি জাল টাকা বাজারে ছাড়ার। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, টাকা তৈরির কাগজ, ফ্রেম, নিরাপত্তা সুতা, রং, কেমিক্যাল, ল্যাপটপ, প্রিন্টার ও কালির কার্টিজ ব্যবহার করে তারা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, রাজধানী ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরির কারখানা স্থাপন করে বিপুল জাল টাকা, ভারতীয় রুপী, ডলার, ইউরোসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের টাকা তৈরি করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঢাকাসহ সারাদেশে বাজারজাত করে। এই জন্য জালনোট চক্রের আরও সদস্য আছে যারা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে পলাতকদের নাম পরিচয় প্রকাশ করেনি ডিবি। ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, জাল টাকা তৈরির অন্তত ১৫টি চক্র তিন স্তরে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। প্রথম গ্রুপ টাকা তৈরির কাগজ সরবরাহ করে। তারা টাকার যাবতীয় নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য সংবলিত কাগজ তৈরি করে চাহিদ অনুয়ায়ী তার নিকট সরবরাহ করত। কম্পিউটার ও প্রিন্টারের মাধ্যমে টাকা ছাপিয়ে সরবরাহকারী গ্রুপের মাধ্যমে দেশব্যাপী বাজারজাত করত। ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহীর বিভিন্ন সীমান্তবর্তী জেলায় নিযুক্ত তার এজেন্টদের মাধ্যমে রাজন শিকদার ওরফে শুক্কুর ওরফে রাজুর (২৬) পিতার নাম মৃত ছামেদ আলী। বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানাধীন পাঁচগাঁও গ্রামে। তার স্ত্রী গ্রেফতারকৃত লাবণী (২৬)। তারা ঢাকার কদমতলী থানাধীন ১ নম্বর লেনের ৩ নম্বর আফসার করিম রোডের আব্দুল মজিদ শিকদারের বাড়িতে ভাড়ায় ওঠে। ওই বাড়িতেই তারা জাল টাকা তৈরির সিন্ডিকেট গড়ে তোলে। ওই বাড়িতে গ্রেফতারকৃত মোঃ রফিকুল ইসলাম (৪০)। পিতা মৃত আবেদ আলী শেখ। বাড়ি বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন কেদেপাড়ার কানারগাতি গ্রামে। মোঃ জাকির শেখ (২৪)। পিতা মোঃ আনোয়ার শেখ। বাড়ি বাগেরহাট জেলা সদরের পাতিয়াখালীর নওয়াপাড়া গ্রামে। রফিকুল ও জাকিরকে নিয়ে থাকত। এছাড়া গ্রেফতারকৃত মোঃ হানিফ গাজী (৪৫)। পিতা মৃত নূর ইসলাম। মায়ের নাম আনোয়ারা বেগম। বাড়ি বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ থানাধীন কবাই গ্রামে। মোঃ শাওন ওরফে খোকন (২৮)। পিতা মৃত তোফাজ্জল হোসেন। বাড়ি পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালী থানাধীন আমতলীর বাড়িয়া গ্রামে। মোঃ রিপন হাওলাদার (৩৮)। পিতার নাম মোঃ আনছার হাওলাদার। বাড়ি পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা থানাধীন টুঙ্গীবাড়ি গ্রামে। মোঃ সোহরাব হোসেন (২৬)। পিতা মৃত আব্দুর রহমান। বাড়ি ঝালকাঠি জেলা সদরের ছত্তরকান্দা গ্রামে। মোঃ মনির হোসেন (২৫)। পিতা আব্দুল হাকিম। বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি থানাধীন দোলাগ্রামে। জসিম শেখ (২৭)। পিতা হাবিবুর রহমান। বাড়ি বাগেরহাট জেলার কচুয়া থানাধীন ছিটাবাড়ি গ্রামে। এরা ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করত না। জাল টাকা আনা নেয়ার কাজে ও বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেয়ার কাজটি করত। গ্রেফতারকৃত দশ জনের মধ্যে লাবণী ও সোহরাব প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়েছে। অন্য আটজন ইতোপূর্বেও বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার জালনোট ছাপার সরঞ্জাম উদ্ধার হয়েছে। ডিবি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রফিক প্রথম জীবনে নোয়াখালী ছগির মাস্টার নামক এক ব্যক্তির সহযোগী হিসেবে জাল টাকা তৈরির কাজ করত। পরে সে নিজেই জাল টাকা তৈরি শুরু করে। কদমতলী থানাধীন পূর্ব জুরাইন বৌ-বাজার এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরি করত। গ্রেফতারকৃতরা ঈদ, পূজাসহ নানা উৎসব পার্বনে জাল টাকা বাজারে ছেড়ে দেয়। প্রথমে জাল টাকাগুলো প্রথম ধাপে প্রতি লাখ ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। দ্বিতীয় ধাপে প্রতি লাখ ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। তৃতীয় ধাপে প্রতি লাখ জাল টাকা ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। শেষ ধাপের ক্রেতারা জাল টাকাগুলো যেসব এলাকার মানুষ সাধারণ আসল টাকা বা নকল টাকা সম্পর্কে ধারণা কম রাখে, সেই সব এলাকায় গিয়ে কেনা কাটা করার কথা জানান জালনোট প্রস্তুতকারী চক্রের এই সদস্য। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন কর্মকর্তা জানান, আইন অনুযায়ী জাল নোট যার কাছে পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধেই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যে জাল টাকা বাজারে ছেড়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে তদন্তপূর্বক প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। পরবর্তীতে সাক্ষ্য, প্রমাণ ও তদন্তে পাওয়া গেলে জাল নোট যে বাজারে ছেড়েছে তাকে গ্রেফতার করা হবে, যা আইনের ফাঁক ফোকর ও দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় তারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
×