ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইন্টারনেটের জন্য ভ্যাট দিতে অসুবিধা কি?

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১০ জুন ২০১৮

ইন্টারনেটের জন্য ভ্যাট দিতে অসুবিধা কি?

সম্ভবত বাংলাদেশই দুনিয়ার একমাত্র দেশ- যেই দেশে ভোক্তা বা ক্রেতা পণ্য কিনে যেন ভ্যাট না দেয় বা বাজেট থেকে সরকার যেন ইন্টারনেটের ভ্যাট তুলে দেয় তার জন্য আন্দোলন করে আর দাবি-দাওয়া পেশ করে ব্যবসায়ী-দোকানিরা, ভোক্তা বা ক্রেতারা নয়! সরকার নিজের আয়োজনে শত কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ থেকে ইন্টারনেট আমদানি করে দেশের সারা প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে কয়েকটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দিয়েছে। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে মোবাইল ফোনের কোম্পানিও। যারা কথা বলার লাইসেন্স নিয়ে শেষে অতিরিক্ত সুবিধা পৌঁছে দিতে তার সঙ্গে আর একটি লাইসেন্স নিয়ে যিনি মোবাইল ব্যবহার করেন তার কাছে ইন্টারনেট আর এই সংক্রান্ত নানা রকম সেবা বিক্রি করে। ইংরেজীতে একে ‘ভ্যালু এডেড সার্ভিস’ বা ঠঅঝ বলে, দেখবেন মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটের এক কোণায় ঠঅঝ সার্ভিস বলে এই কথাটা লেখা থাকে যার মধ্যে ইন্টারনেট বিক্রির নানা প্যাকেজ, অন্যান্য সুবিধা বা দাম ইত্যাদি দেয়া থাকে। আমাদের দেশে যে কয়েকটি মোবাইল ফোনের কোম্পানি আছে তার মধ্যে একটি সরকারী (টেলিটক)। সস্তায় ও ভাল মানের কথা বলার সুযোগ দিতে গিয়ে আর সস্তায় ইন্টারনেট বিক্রি করতে গিয়ে বাকি বিদেশী মোবাইল কোম্পানির নানা রকম জ্বালায় আর নিজেদের অব্যবস্থাপনায় আমাদের দেশী এই কোম্পানিটি এখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারেনি। বিদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলোতে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরাই চাকরি করে আর তাদের উপরের বড় বস হলেন বিদেশী। ইংরেজীতে বকাঝকা খেয়ে আর যখন তখন চাকরি চলে যাবার ভয়ে কর্মীদের একটা বড় অংশই মুখ বুঝে এদের অন্যায় ব্যবসা সমর্থন করেন। আর কিছু লোক তো সব সময় থাকেই, সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই তো আমরা দেখেছি আমাদের দেশের হাতে গোণা কয়েকজন মানুষ কেমন করে নীলের ব্যবসা থেকে লাঠি-বারুদের রাজত্ব চালাতে ঢিলেঢালা হাফ প্যান্ট পরে ইংরেজদের সাহায্য করেছে। না হলে দুইশ’ বছর ইংরেজরা ভারতবর্ষে টিকলো কেমন করে? আর এক শ্রেণীর ইন্টারনেট ব্যবসায়ী আছেন যারা আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) নামে পরিচিত। এদের বেশিরভাগই আমাদের দেশের ইন্টারনেট ব্যবসার প্রথমদিকের তরুণ উদ্যোগী। অনেকের মনে আছে যখন ডায়াল আপ ইন্টারনেট ছিল তখন এদের কেউ কেউ কেমন করে মানুষের বাড়ি বাড়ি তার টেনে নিয়ে সেই ইন্টারনেট পৌঁছে দিয়েছে। তারও আগে কেউ কেউ খুঁজে পেতে হয়রান হয়েছে কেমন করে অন্তত ই-মেইল সেবাটা মানুষের ঘরে ঘরে সস্তায় দেয়া যায়। যদি নামও বলি তাহলে শহীদুল আলম, প্রদেষ্টার সমুদ্র হক, অগ্নির নওয়াব কবীর, ডাটা কর্ণারের তানভীরসহ সবশেষে প্রশিকার জাকারিয়া স্বপন এদের কথা বলতেই হবে। শেষতক কেমন করে আমাদের ইন্টারনেট বড় লোক ব্যবসায়ীদের কাছে চলে গেল তার ইতিহাস অন্য সময়ে লেখা যাবে। ২০০০ সালের দিকে অনেকেই পত্রিকায় পড়েছেন ‘বাগেরহাট অনলাইন’ বলে এক অভিনব ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করেছিল সে শহরেরই এক স্বল্প শিক্ষিত তরুণ লিপু যে কিনা ডায়াল আপ ইন্টারনেট থেকে নিজেই একটা সার্ভার বানিয়ে সেটা আবার তার টেনে টেনে মানুষের বাড়ি পৌঁছে দিত। অনেকেই জানেন, আজকের কমিউনিটি রেডিও-র জন্য লেগে থাকা সফল সাধক এএইচএম বজলুর রহমানের অনুপ্রেরণায় ভোলার চরফ্যাশনে ‘বাঁশ-লাঠি-এন্টেনা সমিতি’ কেমন করে ইন্টারনেট আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করত বা রামপালের শ্রীফলতলা গ্রামে ২০০০ সালে টরে-টক্কার মোর্স কোড আর যোগাযোগ ওয়্যারলেস দিয়েও ‘আমাদের গ্রাম’ প্রকল্পের উদ্যোগে আমরা ইন্টারনেট ই-মেইল ব্যবহার করতাম। রামপালের গ্রামে আমরা চালু করেছিলাম জিএসএম ফিক্সড টেলিফোন যা দিয়ে সিম কার্ড ব্যবহার করে ডায়াল আপ ইন্টারনেট ও ফ্যাক্স পর্যন্ত তখন ব্যবহার করেছি। যদিও সে আমলে গ্রামীণ ফোনের কুটনামির কারণে আমাদের সেই কাজটি চূড়ান্ত রূপ নিতে পারেনি কিন্তু উদ্যোগটি সফল ছিল। সেসব উদ্ভাবনের সুযোগ ২০০১ সালের পরে আমরা কিসের যেন এক দমকা দাপটে শেষ পর্যন্ত তৃণমূলে ধরে রাখতে পারিনি। ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দেশে ইন্টারনেট উন্মুক্ত করে দেয় তখন ল্যান্ড টেলিফোন দিয়ে ডায়াল করে ইন্টারনেট মোডেম হয়ে নির্দিষ্ট সার্ভারে সংযুক্ত হতে হতো। মাস শেষে যখন বিল আসতো তখনও ভ্যাট দিতে হতো যা যেতো সরকারী কোষাগারে। সে সময়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবির একটা যৌক্তিকতা ছিল যেহেতু এই সেবা নতুন ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক তাই কম্পিউটার শুল্ক ও তথ্য প্রযুক্তির নানা প্রকার সেবা থেকে ভ্যাট তুলে নেবার দাবিও ছিল। সে সময়ে সরকার তা মেনেও নিয়েছিল। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের বেকার যুবকদের কর্ম-সংস্থানের জন্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল যার সুফলও পাওয়া গেছে। বিশেষ করে কম্পিউটারের খুচরো যন্ত্রাংশের ব্যবসা ও আইএসপিদের ইন্টারনেট সেবায় অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা স্বল্প বিনিয়োগে কাজের সন্ধান পায়। আমরা জানি, এই আইএসপিদেরও সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। এদেরও ব্যবসা করতে বিনিয়োগ করতে হয়, আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো এই আইএসপিদের সঙ্গে কাজ করে দেশের হাজার হাজার বুদ্ধিদীপ্ত কিশোর-তরুণ যাদের শতকরা ৯০ ভাগ নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। যদি কেউ পথের পাশে এদের কাজ করতে দেখে থেমে একবার ২ মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলেন দেখবেন সে এই ইন্টারনেট প্রযুক্তি সেবা সম্পর্কে যে কারিগরি জ্ঞান রাখে তার বিন্দু-বিসর্গ আপনি জানেন না। এই আইএসপি ব্যবসা এক সময় যখন ‘সত্যিকারের’ ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেলো এদের অনেকে দ্রুত টাকা বিনিয়োগের লভ্যাংশ ফেরত পেতে তখন মোবাইল ফোনওয়ালাদের মতো সরকারের সঙ্গে দর কষাকষির সুযোগ করতে শুরু“করল। কিন্তু সরকার, বিশেষ করে বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশ সরকার তার ইন্টারনেটের জনবান্ধব নীতির কারণে, যাতে সস্তায় দেশের মানুষের কাছে এই সেবা পৌঁছে যায়, দেশের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণ ছেলেমেয়েরা যেন এর সর্বোচ্চ সুবিধা পায় সেই সৎ উদ্দেশ্যে ইন্টারনেটের পাইকারি দাম শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে তখন দেখা যাচ্ছে ইন্টারনেটের খুচরো বিক্রেতারা তার সুফল ৮০ ভাগই নিয়ে নিল কিন্তু গ্রাহকের কাছে তার মূল দাম কমালো না! উল্টো, গ্রাহক যে ভোক্তা হিসেবে তার অধিকার সেবার জন্য সরকারকে ভ্যাট দেয় সেটা কমাতে ফি বছর এরা সরকারকে চাপ দেয় আর সহানুভূতি পেতে দেশের মানুষের কাছে নানা রকম অজুহাত দেয়। ধরুন, আমি-আপনি যদি দোকান থেকে ১৫০০ টাকা দিয়ে কিছু কিনি আর তার জন্য দোকানির ক্রয়মূল্য যদি হয় ১০০০ টাকা তাহলে আমাদের জানতে হবে দোকানি যখন কিনেছিল তার মধ্যেই তার ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত ছিল যা হলো টাকা ১৩০.৪০ (যেমন ক্রয়মূল্য ১০০০ টাকাঢ ১৫ ভাগ ১১৫ টাকা= টাকা ১৩০.৪৫)। এখন সে যদি এই পণ্য ১৫০০ টাকায় বিক্রি করে তাহলে ভ্যাটের নিয়ম অনুযায়ী তা হবে ১৫০০ ঢ ১৫ ভাগ ১১৫ টাকা= টাকা ১৯৫.৬৫। তার মানে ১০০০ টাকায় কিনে যদি বিক্রেতা ৫০০টাকা যোগ করে তা বিক্রি করে তাহলে প্রকৃত সংযোজন হবে ৫০০ টাকা। বিক্রেতা যেহেতু পণ্যটি ক্রয়ের সময় ভ্যাট পরিশোধ করেই ক্রয় করেছে তাই এই ৫০০ টাকা মূল্য সংযোজন করেই সে ভ্যাট ধার্য করবে যা হবে ১৫০০ টাকা ঢ ১৫ ভাগ ১১৫ টাকা= টাকা ১৯৫.৬৫। ফলে নিট ৫০০ টাকার উপর পরিশোধযোগ্য ভ্যাট হলো ৬৫.২১ টাকা। এই ভ্যাটের টাকা ক্রেতা দেবে বা দিচ্ছে আর দোকানির কাজ হলো আপনাকে রশিদ দেবে আর এই টাকা চালান দিয়ে সরকারকে দিয়ে দেয়া। এখন আপনি-আমি যদি সরকারকে ভ্যাট দেই সেই দোকানি কান্নাকাটি করছে কেন? সরকারের হয়ে সে আমার কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে সরকারকে দিয়ে দেবে এটাই তার দায়িত্ব। আর সে কী বলছে? এতে দেশে জিনিসের দাম নাকি বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের উপর চাপ পড়ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন আপনি ভেবে দেখুন সরকার এত টাকা দিয়ে ইন্টারনেট আনলো, ৮০ ভাগ দাম কমিয়ে পাইকারি বাজার সস্তা করে দেয়ার পরেও আপনি আমার দেয়া খাজনাটা নিয়ে সরকারকে পৌঁছে দেবেন না? উল্টো আমার হয়ে, আমাকে সামনে ঠেলে হৈচৈ করছেন? এটা ব্যবসায়ীদের অন্যায়। ভোক্তাগণ এতে মোটেই যুক্ত নয়, কারণ ভোক্তা ইন্টারনেটের সর্বোচ্চ ব্যবহার চায়, নিরবচ্ছিন্ন ব্যবহার করতে চায়। ব্যবসায়ীদের উচিত শুধু মুনাফা চিন্তা না করে ব্যবস্থাপনার সেবা উন্নতির দিকে মনযোগ দেয়া, মূল্যস্তরের সঙ্গে রয়ে-সয়ে লাভ যুক্ত করা, যাতে মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে উদ্ভাবনের সফল সুযোগ পেয়ে এই দেশটাকে একটা ভাল মর্যাদায় নিয়ে যেতে পারে। দেশের প্রায় ৯ কোটি মানুষ এখন ইন্টারনেট গ্রাহক (বিটিআরসি-র সূত্রমতে এপ্রিল ২০১৮ সালে ৮৫.৯১ মিলিয়ন) যার মধ্যে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা হলো ৮০.১৫ মিলিয়ন, ওয়াইম্যাক্স গ্রাহক ০.০৮৭ মিলিয়ন, আইএসপি/পিএসটিএন বা ব্রডব্যান্ড গ্রাহক ৫.৬৮ মিলিয়ন। এই খাত থেকে সরকার ভ্যাট হিসেবে যে রাজস্ব পায় তা জনগণের। দেশ চালাতে সরকারকে যেমন দেশ-বিদেশের নানা মাধ্যম থেকে টাকা জোগাড় করতে হয়ে তার অন্যতম উৎস হলো এই রাজস্ব খাত, ভ্যাট যার অন্যতম। খোঁজ-খবর নিয়ে দেখা গেল আইএসপিগুলো ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদানে গ্রাহক পর্যায়ে মূল্য কিছুটা কমিয়েছে কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবার দাম এখনও অনেক বেশি। সরকারী নীতিমালা এখানে আরও কঠোর হওয়া দরকার। মুশকিল হচ্ছে সরকারের ইন্টারনেট বিতরণ নীতিমালাটি ২০১৫ সালের পরে মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও একে হালনাগাদ করা হচ্ছে না, এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে নিয়ন্ত্রকের অনুশাসন। না হলে ভ্যাট বা রাজস্ব না দিতে এসব অবাস্তব দাবি দাওয়া দিয়ে এরা মানুষকে কেবলই বিভ্রান্ত করতে থাকবে। সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভাল মানুষির সুযোগ নিয়ে ভুল-ভাল হিসাব দিয়ে ‘বণিকের মাণদণ্ড রাজদ- রূপে’ জনগণের সামনে ঘুরাতেই থাকবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×