ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার তাগিদ

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১০ জুন ২০১৮

বিশাল বাজেট বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার তাগিদ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মোঃ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পর্দাপণ করেছে। বাজেটে কর্পোরেট কর হার আড়াই শতাংশ হ্রাস করার ফলে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে সহায়ক হবে। তবে মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে, যা আমাদের পলিসির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিষয়টি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার প্রস্তাব করছি। যাতে করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন বজায় থাকে। শনিবার দুপুরে এফবিসিসিআইয়ের মতিঝিল কার্যালয়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়েছে। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনের পাশাপাশি ওই সময় সংগঠনটির সভাপতি মোঃ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বাজেট সংক্রান্ত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ ফজলে ফাহিম, সহসভাপতি মুনতাকিম আশরাফ, সাবেক পরিচালক আব্দুল হক, পরিচালক শমী কায়সার প্রমুখ। এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ব্যাংকের টাকা জনগণের আমানত। এই টাকা যারা লুট করে, এফবিসিসিআই তাদের পক্ষে কথা বলবে না। এ সময় বাজেটের আকার প্রসঙ্গে বলা হয়, সরকারের এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং তদারকির মান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় এই বিশাল বাজেট বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- যে গতিতে বাড়ছে, রাজস্ব আয় যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই হারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি। এনবিআর এর সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি। কর্পোরেট কর হারের প্রসঙ্গে এফিবিসিসিআই জানায়, ব্যাংকিং সেক্টরে কর্পোরেট কর হার কমানোর কারণে এ সেক্টরে সুদের হার যৌক্তিক পর্যায়ে কমানো তথা সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে বিশ্বাস করি। কর মুক্ত আয়ের সীমা প্রসঙ্গে আরও বলা হয়, কর মুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে যা আমরা চাইনি। কর মুক্ত আয়ের সীমা আমরা কমপক্ষে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করছি। আয়কর অধ্যাদেশের ১২০ ধারার অপপ্রয়োগে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এটি একটি কালো আইন। আমরা এ আইনের ১২০ ধারা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন বলেন, বিচারাধীন কোন বিষয়ে মন্তব্য করব না। তবে যারা ব্যাংকের টাকা লুট করেছে, আমরা তাদের শাস্তি চাই। সবার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যদি কেউ কোন বিশেষ সুবিধা নিয়ে কাজ না করে তা দেখার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসা করি। রাজনীতি করি না। লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি এখন অনেক শক্ত। চলতি অর্থবছরে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে চলেছে। সফলতার সঙ্গে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জন করেছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে আমরা এগিয়ে চলেছি। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত থেকে এখন বাংলাদেশ উন্নয়ন রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে। শুধু তাই নয়, ২০৪১ সাল সামনে রেখে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকসমূহের উর্ধমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করছি। আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্য আজ বিশ্ব দরবারে রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। লিখিত প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে-প্রস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা যা, গত বছরের লক্ষ্যমাত্রার (২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা) তুলনায় ১৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। রাজস্ব আদায়ের এই উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। লক্ষমাত্রা অর্জনের জন্য অনেক ক্ষেত্রে কর দাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং আইন-কানুনের অপপ্রয়োগ ও কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছা ক্ষমতার কারণে ব্যবসায়ীদেরকে হয়রানি করা হয়ে থাকে। এ কারণে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিবিড় মনিটরিং ও পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। চাহিদা মোতাবেক সেবা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে তবে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে সেটা হয়নি। সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আরও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। আয়করের ক্ষেত্রে বর্তমানে মোট নিবন্ধিত কর দাতার সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী ৫ বছরের মধ্যে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ৮০ লাখ উন্নীত করতে হলে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ কর প্রশাসন ব্যতীত এটি অর্জন বেশ কঠিন। তাই কর প্রশাসনকে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অটোমেশনসহ সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে অধিক নজর দেয়ার জন্য প্রস্তাব করছি। কর মুক্ত আয়ের সীমা বাজেটে কর মুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে মূল্যস্ফীতি, জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, জনগণের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে এখনকার বাজারে এ সীমা ৫ লাখ টাকায় উন্নীত করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বর্ধিত করার প্রস্তাব করেছি। এটি পুনর্বিবেচনার জন্য আবারও জোর দাবি জানানো হচ্ছে। এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যক্তি কর দাতার প্রদর্শিত নিট পরিসম্পদের ভিত্তিতে সারচার্জের শূন্য শতাংশের সীমা বর্তমানে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বর্ধিত করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু বাজেটে তা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ বিষয়টি আবারও বিবেচনার জন্য অনুরোধ করছি। লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, বাজেটে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য কর্পোরেট করের হার ১৫ শতাংশ নির্ধারণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে যা বর্তমানে ১২ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রীন কারখানার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে ১২ শতাংশ যা বর্তমানে ১০ শতাংশ। কর্পোরেট করহার বৃদ্ধির কারণে তৈরি পোশাক শিল্পে পুনঃবিনিয়োগের অর্থের যোগানে স্বল্পতা সৃষ্টি হবে। যা এ শিল্পের বিকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে পোশাক খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে কর্পোরেট হার ১২ শতাংশ ও সবুজ কারখানার ক্ষেত্রে পূর্বের ন্যায় ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, মানব সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রভৃতি খাতে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাভোগীদের সংখ্যা এবং মাসিক ভাতার হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সুবিধা, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ধরনের উপকারভোগীর সংখ্যা ও আর্থিক সুযোগ বৃদ্ধি সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে এ সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। এ ছাড়া শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ আকর্ষণের পাশাপাশি কর প্রদানে স্বচ্ছতা আনা এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর্পোরেট কর হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস করার জন্য আমরা প্রস্তাব করেছিলাম। ব্যাংকিং সেক্টরে কর্পোরেট কর হার কমানোর প্রতিফলন ব্যাংকিং সেক্টরে সুদের ‘স্প্রেড’ যৌক্তিক পর্যায়ে কমানো তথা সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে সহায়ক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
×