ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষার স্বপ্নপূরণে শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৮ জুন ২০১৮

সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষার স্বপ্নপূরণে শেখ হাসিনা

কোন দেশের টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটে। বাংলাদেশে তেমনটি ঘটতে শুরু করেছে। শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর পরই এমন কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে; যার ফলে দিন দিন দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, শিল্পায়ন, বিদ্যুত, কৃষি এবং অন্যান্য সেক্টরে ও উন্নয়নের হাওয়া বইতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি যদি শিক্ষার উন্নয়ন না ঘটে, সেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থায়ী রূপ পেতে পারে না। তবে আশার কথা, আমাদের দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নয়ন সমান্তরালভাবে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে চলেছে, বিষয়টি এখন আর কল্পনা বা অনুমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বিষয়টি এখন দৃশ্যমান। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এ ধরনের যে সমস্ত সংস্থা রয়েছে, তাদের সকলেরই অভিমত, বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পৃথিবীর উন্নত দেশের কাতারে শামিল করতে হলে শেখ হাসিনার কৈশোরের লালিত স্বপ্ন সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। প্রতি বছর ১ জানুয়ারি সারাদেশে ফুটে ওঠে এক অন্য রকম চিত্র। নতুন বই হাতে উচ্ছ্বসিত শিশু-কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীরা। নতুন বছর, নতুন শ্রেণী, নতুন বই। এই দৃশ্য বড় আশাজাগানিয়া। আগামীর কর্ণধারদের এই উচ্ছ্বাস আলোকিত আগামীর বার্তা বহন করে। এরপরও ১ জানুয়ারির সকালটা ছিল অন্য রকম। এই বছর সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী এই কর্মসূচী সফলভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছে। পর পর দুই মেয়াদে দায়িত্বরত সরকার রীতিমতো যে একটি বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বিনামূল্যের বই, বিশেষ করে মফস্বলের অভিভাবকদের জন্য অবশ্যই স্বস্তির বিষয়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের সহায়তায় নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের কষ্টের বোঝা যে অনেকটাই লাঘব করেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই কার্যক্রম খুদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন রকমের অনুপ্রেরণাও যোগাচ্ছে । শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অন্যতম হলোÑ ১ জানুয়ারি শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক তৈরি, ১০ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান, সকল স্তরে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক ভাবে চালু, সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তন, ৫০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন, উপজেলায় আইসিটি রিসোর্স সেন্টার স্থাপন, মেধাবৃত্তি ছাড়াও বছরে প্রাথমিক থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যন্ত ২ কোটি ৩ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান, ৬০ হাজার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে প্রতিবন্ধী বৃত্তি প্রদানসহ শিক্ষা খাতে মোট উপকারভোগীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৭ হাজার। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে- শিক্ষকের গুণগত মান বৃদ্ধি ও পাঠদান পদ্ধতি উন্নত করার জন্য নিয়মিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রদান। ২০০৮ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং ২০১০ সাল থেকে জেএসসি পরীক্ষার প্রচলন। ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি ২৬ হাজার ১৯৩টি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ। পিএসসির অনুরূপ জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে সকল বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ, সহজ আকর্ষণীয় চমৎকার পাঠ্যপুস্তক তৈরি, বইয়ের বোঝা কমানো, পরীক্ষা পদ্ধতির বড় রকমের সংস্কার ইত্যাদি। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তির ব্যবস্থা। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১ শতাংশ বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৯ ভাগে। শিক্ষার সুবিধা বঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট। আধুনিক যুগের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে । ২০০৯ সালে যেখানে মোট শিক্ষার্থীর ১% কারিগরি শিক্ষা পেত বর্তমানে ১৬% এ উন্নীত করা হয়েছে। ২০২০ সালে ২০% এবং ২০৩০ সালে ৩০% উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। ২০৪১ সালে ৬৫%-এর উর্ধে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা আর শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে রীতিমতো ঘটে গেছে বিপ্লব যা বিশ্বের বহু দেশের কাছে অনুকরণীয়। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। উন্নত মানের কাজ, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, গবেষণা, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি প্রভৃতি বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ, শিক্ষার মান উন্নয়ন, শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা, গুণগত মানবৃদ্ধি, গবেষণা, শিক্ষানীতির লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাইকা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার ঋণ সহায়তায় ১২টি প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান। স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গেলেও শিক্ষার অগ্রগতিতে গত এক দশকই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশ্বব্যাংক, ইউনেস্কো, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামসহ আন্তর্জাতিক দাতা ও গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশে শিক্ষার অগ্রগতিকে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশসমূহের জন্য উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, শিক্ষায় প্রতিটি পর্যায়ে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষায় নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে বাংলাদেশ ছুঁয়েছে নতুন মাইলফলক। ’৭২-এর সংবিধানে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। মানবাধিকারের মূলমন্ত্র হলো ‘সাম্য, সুবিচার ও মানবিক মর্যাদা।’ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এই বিষয়গুলো নিশ্চিত হচ্ছে কি-না, এটি গুরুত্বপূর্ণ। সব কিছুর মূলে হলো বৈষম্য নিরসন। শিক্ষায় বৈষম্য না কমলে টেকসই শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। দেশে বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় এখনও ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে । স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছিলেন। একীভূত ও মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সরকারীকরণ করা হলো। এর মাধ্যমে শিক্ষকরাও সরকারী বেতনভুক্ত হলেন। যেখানে প্রাথমিক শিক্ষকরা নামমাত্র বেতন পেতেন, সেখানে তারা সরকারী সুযোগ-সুবিধার অন্তর্ভুক্ত হলেন। এরপরও কি পরিবর্তন হয়েছে? মানসম্মত শিক্ষা কি আমরা পাচ্ছি? এরই মধ্যে জন্ম হলো কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। উন্নত দেশের সর্বত্র এ পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচলন হলো। শুরু হলো বৈষম্যের নতুন অধ্যায়। দরিদ্র পরিবারের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে রাখার মোক্ষম উপায় আধুনিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা। সারাদেশে সবার জন্য একই পদ্ধতি অনুসৃত হবে না কেন? কেন বই ও সিলেবাসের মধ্যে পার্থক্য থাকবে? শিক্ষার অধিকার সবার জন্য সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমান সরকার মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করেছে। আশার কথা হলো সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান ও কম্পিউটার শিক্ষা শাখা চালু করা হয়েছে। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষায় বিদ্যমান সমস্যার সমাধান ও আধুনিকায়নে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এখন শুধু প্রয়োজন সুযোগের সমতা আনয়ন করা ও শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে সার্বজনীন অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। উন্নত-উন্নয়নশীল কোন দেশে প্রাথমিক শিক্ষাকে পঞ্চম শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি। ’৯০-এর দশকে আমাদের দেশে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এরপর ২৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও বাধ্যতামূলক শিক্ষাস্তর পঞ্চম শ্রেণী থেকে আপগ্রেড করা হয়নি। উন্নত-উন্নয়নশীল দেশে প্রাথমিক শিক্ষার স্ট্যান্ডার্ড হলো ১৮ বছর, মানে উচ্চমাধ্যমিক। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা স্তর অষ্টম শ্রেণীতে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হলে ও বাস্তবায়ন থমকে আছে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষাস্তর ধাপে ধাপে অষ্টম থেকে দশম হয়ে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করা সময়ের দাবি। অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা ১৮ বছর পর্যন্ত যার যা ঝোঁক, সেই অনুযায়ী তাত্ত্বিক কিংবা প্রায়োগিক শিক্ষা নেবে। এরপর যোগ্যতা ও পারিবারিক অবস্থা অনুসারে উচ্চশিক্ষায় যাবে অথবা কাজে যাবে। এতে দেশের মানব সম্পদের ভিত্তিমান মজবুত হবে। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×