ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

সকল করযোগ্য ব্যক্তি কর দিলে বাজেটের আকার দ্বিগুণ করা যায়

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ৮ জুন ২০১৮

সকল করযোগ্য ব্যক্তি কর দিলে বাজেটের আকার দ্বিগুণ করা যায়

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট গতকাল জাতীয় সংসদে যথারীতি উপস্থাপিত হয়েছে। আর আমি এই কলামটি লিখছি বুধবারে। স্বাভাবিকভাবেই আমি বাজেটের কিছুই জানি না। না জেনে কিছু লেখা যায় না। অথচ আজকে সকল কাগজের আলোচনার বিষয়বস্তু বাজেট। বাজেটের নানা দিক। আলোচনা-সমালোচনা। কত কথা। আমিও বাজেট না জেনে কিছু কথা বলতে পারি। যেমন এখন বাজেট রচনা করা খুব সহজ কাজ। বিদেশ যেতে হয় না। এমন এক সময় ছিল যখন বাজেট রচনার পূর্বে অর্থমন্ত্রীকে তার দলবলসহ, কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজসহ যেতে হতো ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। সেখানে হতো দাতাদের ‘কনসোর্টিয়ামের’ বৈঠক। দাতা মানে? মানে যারা বাজেটের জন্য অর্থ সাহায্য দেবে। তারা প্রশ্ন করত, জবাবদিহি করতে হতো। তাদের সন্তুষ্ট করতে হতো। তারপর আসত সাহায্য-অনুদান-সহযোগিতার আশ্বাস। এর ওপরই নির্ভর করত বাজেট। বাৎসরিক বাজেট। খাদ্য সাহায্য কত আসবে, অনুদান কত আসবে, ঋণ-সাহায্য কত আসবে তা ছিল বাজেট প্রণয়নের আগে জানার বিষয়। আজ আর এই পরিস্থিতি নেই। খাদ্য সাহায্য আমাদের লাগে না। অনুদান আসে না। বস্তুত বাজেট প্রণয়নে দাতাদের মুখাপেক্ষী আমরা নই। নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানাচ্ছি আমরা। ঋণ করার ক্ষমতা হয়েছে। নিজের অগ্রাধিকারভিত্তিতে আমরা কাজ করছি। বলাবাহুল্য, এটা আমাদের অর্থমন্ত্রীর একটা বড় সৌভাগ্য। এখন তিনি তার নিজের কাজ নিজেই করতে পারছেন। বিশাল পারফর্মেন্স বাংলাদেশের, বিশাল পারফর্মেন্স সরকারের। ভাবা যায় আরেকটি ঘটনা বাজেট প্রণয়নে আমাদের সাহায্য করেছে অনেকেই এ কথা ভুলে যান। প্রায় এক-দেড় দশক ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়েনি, তেলের দাম কী বস্তু তা আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝি। ১৯৭২-৭৫ সাল এবং এর পরেও একবার তা আমরা বুঝেছি। আমরা বলতে পারি তেলের কমমূল্য এবং পাশাপাশি অন্যান্য জিনিসপত্রের স্বাভাবিক মূল্য এবং তা আন্তর্জাতিক বাজারেÑ এটা আমাদের সুস্থ মাথায় বাজেট করতে সাহায্য করেছে এবং এখনও করছে। তাহলেই প্রশ্নÑ বাজেটের টাকা কোত্থেকে আসছে? বাজেট মানে আয় ও ব্যয়। আমরা অবশ্য ব্যয়ের হিসাবের ভিত্তিতেই বাজেট আলোচনা করি। ব্যয়ের ভিত্তিতেই বলি বাজেট কত বড়, তার আকার কত। ঘরের হিসাব এ রকম নয়। পারিবারিকভাবে আমরা আয়ের হিসাব আগে করি। আয় বুঝে ব্যয়। আয় ১০০ টাকা, ব্যয় ৮০ টাকা। অতএব সঞ্চয় ২০ টাকা, যা হবে পুঁজি। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে আমরা ব্যয়ের হিসাব আগে করি। কেন করি তা আমি জানি না। এমন কী বাজেট কেন জুন মাসে ঘোষিত হয় এবং তা লাভ কেন হয় জুলাই থেকে তাও আমি বুঝি না। যুক্তি কী, প্রেক্ষাপট কী জানি না। ব্যাংকের অর্থবছর জানুয়ারি-ডিসেম্বর তাতে কোন অসুবিধা হয় না। যত অসুবিধা সরকারের বাজেটের ক্ষেত্রে। এর ফলে যে বর্ষাকালে সারাদেশে উন্নয়নের নামে খোঁড়াখুঁড়ি চলে মাত্রার বাইরে তা সবাই জানি। এরপরও জুলাই থেকেই বাজেট এবং তা ব্যয়ের হিসাব আগে করেই। ব্যয়ের ভিত্তিতে আয় প্রাক্কলন? ঠিক আছে। আমাদের যত ব্যয় তত কী আমাদের আয়, মোট ব্যয়? নিশ্চয়ই নয়। আমাদের বাৎসরিক ব্যয় অনেক অনেক বেশি। আয় কম, অনেক কম। পরিসংখ্যানে যাব না। তাহলে উন্নয়নের টাকা কোথায়? উন্নয়নের টাকা নেই। তাহলে? তাহলে ধার-কর্জ। হ্যাঁ, এটাই আমাদের নিয়তি। আমরা স্বাধীনতার পর আজকের দিন পর্যন্ত উন্নয়নের টাকা রাজস্ব বাজেটের উদ্বৃত্ত থেকে জোগাড় করতে পারিনি। হিসাব করলেই দেখা যাবে আমাদের ‘বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী’ (এডিপি) তে যে টাকা লাগে তা আমাদের ঋণের সমান। এখন ঋণ মানে ঘাটতি যাকে আমরা বাজেট ঘাটতি বলি। তা মোট ‘জিডিপির’ পাঁচ শতাংশ। প্রতিবছর তাই ১৬-১৮ কোটি লোকের দেশে আমরা আজও উন্নয়ন বাজেটের টাকা রাজস্ব উদ্বৃত্ত থেকে সংগ্রহ করতে পারিনি। কীভাবে করব? প্রভাশালী ব্যক্তিগণ, ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ, ব্যবসায়ীগণ, পেশাজীবীসহ দেশের কর- সামর্থ্যবান লোকেরা কর দিতে চায় না। তারা সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা চায়, শুধুই চায়। কর দিতে রাজি নয়। কর, যেমন ধরুন, আয়কর (ইনকামট্যাক্স) কারা দেয়? কোম্পানি বাদে আয়কর দেয় কিছুসংখ্যক চাকরিজীবী-সরকারী ও বেসরকারী। লাখ লাখ সম্ভাব্য করদাতা করজালের বাইরে। দিনে লক্ষাধিক টাকা বিক্রি ইনকামট্যাক্সের বেলায় প্রায় শূন্য। এক বিকেল-রাতে ৫০টা রোগী দেখেন হাজার টাকা ফি-ইনকামট্যাক্স যৎসামান্য। ফলে দেখা যায় সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রায় পুরো বোঝাটাই বহন করে দেশের গরিব মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ। কীভাবে বলছি এ কথা? সরকার দিন দিন এগোচ্ছে বেশি বেশি ‘ভ্যাটের দিকে’। মূল্য সংযোজন করের দিকে। এগোচ্ছে উৎসে কর কর্তনের দিকে। এর অর্থই হচ্ছে পরোক্ষ ব্যবস্থা। ‘ভ্যাট’ হচ্ছে ভোগকর (কনজামশন ট্যাক্স) বা ব্যয়কর (এক্সপেন্ডিচার ট্যাক্স)। অর্থাৎ কিছু ক্রয় করলেই, ভোগ করলেই কর দিতে হবে এবং তা সকলের জন্য এক। অফিসের পিয়ন যে হারে দেবে, প্রধান নির্বাহীও একই হারে দেবে। বড়ই অবিচার। করনীতি বলে যার যত বেশি আয় সে তত বেশি কর দেবে। কিন্তু ভ্যাটের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য নয়। অতএব, ভ্যাটের মাধ্যমে সরকার ট্যাক্স আদায় করছে গরিব ও মধ্যবিত্তের কাছ থেকে। উৎসে করের ক্ষেত্রেও তাই। কর আদায়কারী সংস্থার জন্য উৎসে কর কর্তন একটা খুবই সুবিধাজনক ব্যবস্থা। কিন্তু এতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। কিছুক্ষণ আগে বললাম আয়করের কথা। তাহলে কী বোঝা যাচ্ছে সরকার বাজেটের টাকা সংগ্রহ করছে দেশের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, গরিব নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কাছ থেকে। এটা ন্যায়বিচার পরিপন্থী। যদি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে কর আদায় করে বাজেটের আকার বড় করা যেত তাহলে ভীষণ আনন্দের ঘটনা হতো এটা। কিন্তু স্পষ্টতই তা নয়। বাজেটের আকার বড় হচ্ছে, দিন দিন বড় হচ্ছে। এটা সুখের খবর, আনন্দের খবর, কিন্তু এটা আরও আনন্দের খবর হতো যদি ধনীরা কর দিত। দেখা যাচ্ছে দেশের এক নম্বর করদাতা হচ্ছেন জর্দাওয়ালা শ্রেণীর লোক। যে সমস্ত ব্যবসায়ী গ্রুপের ব্যাংক ঋণ দুই-চার-পাঁচ-সাত-আট হাজার কোটি টাকা সেইসব গ্রুপের মালিকরা কত টাকা ট্যাক্স দেন? জানা নেই। তারা বলেন, তাদের কোম্পানির কথা। কোম্পানি ট্যাক্স দেয়। কোম্পানি ট্যাক্স দেয়ার পরই মালিককে ট্যাক্স দিতে হয়। তাই নয় কী? প্রতিদিন কাগজে ট্যাক্স দেখি ভ্যাট ফাঁকির কথা। দেখি বন্ডের ওয়ার হাউসের মাল খোলাবাজারে বিক্রির কথা যা হওয়ার নয়। ৬২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আটকা আছে। রিট মামলা হাইকোর্টে। বেঞ্চ নেই। লাখ লাখ বিদেশীকর্মী বাংলাদেশে কাজ করে বিনা ট্যাক্স ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। কোন ব্যবস্থা নেই। বড় বড় কোম্পানি ‘ট্রান্সফার প্রাইসিং’ এর মাধ্যমে সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছে। কত উদাহরণ দেব? এসব ফাঁকিবাজি বন্ধ করতে পারলে বাজেটের আকার বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ করা সম্ভব। আরও দ্বিগুণ করা যেত খরচের গুণগত মান রক্ষা করতে পারলে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এক টাকার কাজ দুই টাকায় হচ্ছে। কোন জবাবদিহিতা নেই। রাজস্ব বাজেটের টাকার অপচয় হচ্ছে। উন্নয়নের বাজেটের টাকার নয়-ছয় হচ্ছে। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিল্ডিং ৫ বছরও হয় না, ইট-সিমেন্ট আলাদা হয়ে যায়। বড় বড় রাস্তা করার পর এক বছরও যায় না। মেরামতি লাগে। এই যে খরচের অপব্যবহার তা বন্ধ করতে পারলে বাজেটের আকার বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ, তিনগুণ করা যেত। দেখছি সরকারের বাজেট বড় হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়নের হার দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ৮০ শতাংশও বাজেট বাস্তবায়ন হয় না। ফলে খরচ আরও বাড়ে। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, সামাজিক অনেক সূচকে আমাদের অগ্রগতি অসামান্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সত্যি হচ্ছে ওপরের কথাগুলো। অর্থমন্ত্রী কী তার দ্বাদশ বাজেটে এসবের ব্যাপারে কিছু বলেছেন? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×