ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিক মমত্ববোধ

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ৭ জুন ২০১৮

মানবিক মমত্ববোধ

ষাট-সত্তরের দশকে স্কুল লেভেলে একটি কবিতা ছিল। ‘বাঁকা চাঁদ হাসি মুখে ফিরে এল ঈদ ভোর হতে শাহীনের ভেঙে গেল নিদ’। ঈদের চাঁদ উঠেছে। ছোট বড় ধনী গরিব সবাই দেখেছে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে। কাল ঈদ। খুশিতে ঘুমই হত না রাতে, আর হলেও উত্তেজনায় কাকভোরেই ঘুম টুটে যেত। ওই সুখ ছিল নির্জলা আনন্দের সুখ। সবাই মিলে ছিল সে আনন্দ। ঘরে-বাইরে আনন্দ। একজন আরেকজনকে চিনতো, মানতো, একজনের পাশে আরেকজন দাঁড়াতো। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ছিল। আস্থা থেকে ভালবাসা সৃষ্টি হয়। আর ভালবাসা থাকলে আর কিছু লাগে? ভালবাসা থাকলে মমত্ববোধ জাগে। আর তখনি আনন্দ বেদনা ভাগাভাগি হয়। এজন্য ওয়াজ নসিহত দরকার হয় না। আজকে মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা কমে বিপদসীমার নিচে চলে গেছে। সে কারণে ভ্যালেন্টাইন্স ডে, মা দিবস, বাবা দিবসের আমদানি করতে হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়ত প্রতিবেশী দিবস, পল্লী দিবস ইত্যাদিও উদ্ভাবন করতে হতে পারে। এখনও গ্রামে মানুষের প্রতি মানুষের জাতিধর্ম নির্বিশেষে যে আস্থার জায়গাটা আছে সেটা নাগরিক জীবনে নেই। অশিক্ষিত পরিবারে যেটুকু আছে শিক্ষিত পরিবারে সেটুকু নেই। কারণ কি? তাহলে কি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আগের মতো ভালবাসা শেখাতে পারছে না? পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলি দাও..., আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে..., বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়; সর্বজীবে দয়া যার ধার্মিক সে হয়..., নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল..., সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি... ফল হলে গাছগুলি মাথা করে নত; জলভরা মেঘমালা ঝুঁকে পড়ে কত..., একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে..., জগত জুড়িয়া একজাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি..., এসব ভালবাসার কবিতা কি এখন আছে? মদনমোহন তর্কালঙ্কার, সুনির্মল বসু, কৃষ্ণকান্ত মজুমদার, রজনীকান্ত সেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর এই সব কবিতাগুলো ছাত্রছাত্রীদের মুখে মুখে থাকত। কোন আবৃত্তি সংগঠন ছিল না, কিন্তু ঘরে ঘরে কবিতা আবৃত্তি হতো। এখন কবিতা মুখস্ত করার দরকার হয় না। আর স্কুল কলেজে মুখস্ত করার মতো আকর্ষণীয় কবিতাও নেই। আগের সে শিক্ষকও যেমন নেই, আগের সেই আত্মত্যাগী নেতৃত্বও নেই। তাহলে শিখবে কার কাছে? অনুসরণ করবে কাকে? তাহলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার মানবিক ভালবাসাবোধ কোথা থেকে আসবে? শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস স্থল ধর্মগুরুগণ। কিন্তু বিবর্তিত সমাজব্যবস্থায়, ধর্মগুরুদের মান্য করার প্রবণতা হারিয়ে গেছে আর বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধর্মেরই কতিপয় অন্ধ ধর্মীয় উন্মাদের কারণে ধর্মের প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধাও সমাজে সীমিত হয়ে পড়ছে। তবে এত কিছুর পরেও ঈদের খুশি ভাগাভাগি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বর্তমানের অন্তর্জাল আর আকাশ-সংস্কৃতি আমাদের পারিবারিক সামাজিক ব্যবস্থাকে এখনও পূর্ণগ্রাস করতে পারেনি। এখনও আমরা একসঙ্গে ঈদগাহে যাই। ফিতরা, দান খয়রাত ও যাকাত ব্যবস্থা এখনও ঈদ-আনন্দের ভাগাভাগি টিকিয়ে রেখেছে। ঈদে এখনও তাই কোলাকুলি গলাগলির সুখ পাই। কাকরাইল, ঢাকা থেকে
×