ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

অভিমত ॥ রূপপুর, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এবং মঈন খান গং

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৬ জুন ২০১৮

অভিমত ॥ রূপপুর, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এবং মঈন খান গং

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বে সমুদ্র জয়ের পর মহাকাশ জয় করল বাংলাদেশ। কক্ষপথে স্থাপন করল কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আর এর মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইটের অভিজাত ক্লাবে যুক্ত হলো বাংলাদেশ। এ-ক্লাবে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার কথা ছিল নিদেনপক্ষে এক যুগ আগে। কিন্তু বাংলাদেশকে যুক্ত হতে দেয়নি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১ অক্টোবর প্রহসনমূলক ও কথিত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বঙ্গবন্ধু নাম থাকার কারণে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া স্যাটেলাইট প্রকল্পটি বাতিল করে দেয়। এই অপকর্মের হোতা ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কথিত ব্রিলিয়ান্ট মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান। আর ড. মঈন খানের ওই নির্বুদ্ধিতামূলক ও প্রতিহিংসামূলক পশ্চাদমুখীন সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ মহাকাশে অরবিটাল স্লট বা জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইট (ভূস্থির উপগ্রহ) স্থাপনের সুবিধাজনক অবস্থান হারিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মর্যাদাপূর্ণ স্যাটেলাইট ক্লাবে যুক্ত হওয়া বিলম্বসহ দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে। দুঃখজনক ও উদ্বেগের ব্যাপার হলো, নিকট ইতিহাসের এই ঘটনাটি এমনকি অনেক ইতিহাস সচেতন মানুষও ভুলে গেছেন কিংবা রহস্যময় কারণে মনে করতে চাচ্ছেন না। সেইসঙ্গে জাতিকেও ভুলে থাকার নছিয়ত করছেন। কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের ও সব ভালর সঙ্গে ওঠবস খ্যাত গণমাধ্যমের ১২ মে, ২০১৮ প্রকাশিত ‘যেভাবে তৈরি হলো’ শিরোনামের প্রতিবেদনের শুরুই করা হয়েছে এভাবেÑ‘বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট নিয়ে কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে’। এই গণমাধ্যমটি কি স্যাটেলাইট নিয়ে ২০০৭ সাল পূর্ব সব কর্মকা-ের তথ্য মুছে ফেলতে চায়? নাকি ড. মঈন খান গংসহ ওই অপকর্মের হোতাদের ভূমিকা সম্পর্কে জাতিকে বিশেষত, তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশের স্যাটেলাইটের ইতিহাস সম্পর্কে অন্ধকারে রাখার বিশেষ কোন এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছে? এই গণমাধ্যমটির চাতুর্যপূর্ণ কৌশল ধরা সত্যিই অত সহজ নয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১’এ উৎক্ষেপণ হলো ১২ মে, ২০১৮ বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ১৪ মিনিটে আর ওই দিনই কথিত প্রচার সংখ্যার শীর্ষের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার মূল শিরোনাম ‘আমরাও মহাকাশে’। এখানেই শেষ নয়, চাতুর্থ আরও আছে। ৭ মে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সহযোগিতায় বিজ্ঞানচিন্তা ‘স্যাটেলাইট যুগে বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে। ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে মাননীয় একজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। বিষয়টি মামুলি নয়, নয় পূর্বপরিকল্পনাহীন। বরং ক্ষমতাসীনদের বিভ্রান্ত করা (নিশ্চয়ই সবাইকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব নয়), দ্বিতীয়ত, স্যাটেলাইট সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন হাতিয়ে নেয়া। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১-এর ঋণদাতা ব্যাংক এইচএসবিসির প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন তাৎক্ষণিক সাফল্য এনে দিয়েছে ওই গণমাধ্যমকে। ৩০ নবেম্বর, ২০১৭ পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের মূল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বস্তুত এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পরমাণু বিশ্বে প্রবেশ করেছেÑ একই সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদনে নন-নিউক্লিয়ার থেকে বাংলাদেশের নিউক্লিয়ার যুগে পদার্পণ ঘটল। যা ছিল বাঙালী জাতির পঞ্চাশ বছরের স্বপ্ন। আর এর আগে ৪ নবেম্বর, ২০১৭ জমকালো এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বায়েরা) বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ‘কনস্ট্রাকশন এ্যান্ড ডিজাইন’ লাইসেন্স প্রদান করে। যার মাধ্যমে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের মূল নির্মাণপর্বের কাজের ক্লিয়ারেন্স পায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন আর বাংলাদেশ ৩২তম দেশ হিসেবে যুক্ত হয় বিশ্ব পরমাণু ক্লাব বা নিউক্লিয়ার নেশনে। ২১ জুন, ২০১৬ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের সাইটিং লাইসেন্স প্রদান করে বায়েরা। বস্তুত এভাবে ধাপে ধাপে সব প্রক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক ও দেশীয় নিয়মনীতি পূরণের মধ্য দিয়ে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের স্বপ্ন যখন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে, তখন নানা আজগুবি ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য-উপাত্তের মিশেলে রিপোর্ট ও কলাম ছেপে কথিত প্রচার সংখ্যার শীর্ষের গণমাধ্যম (বাংলা ও ইংরেজী) জনগণের মধ্যে নিউক্লিয়ারবিরোধী সেন্টিমেন্টকে উসকে দিয়েছে। এ কাজে যুক্ত করা হয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রকে। ওই পত্রিকার প্রতিবেদন ও কলাম-নিবন্ধনের বিষয়বস্তু বিশ্লেষণে এটা স্পষ্ট যে, নিউক্লিয়ার বিরোধী সেন্টিমেন্টকে উসকিয়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের মতো মর্যাদাসম্পন্ন ও সময়োপযোগী কার্যক্রমকে জনগণের নিকট নেতিবাচক ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ধ্বংসাত্মক বলে চিহ্নিত করা। এ-বিষয়টি আরও পরিতাপের এই কারণে যে, অজ্ঞাত ও রহস্যময় কারণে রূপপুর প্রকল্পÑসংশ্লিষ্টরা ইতিবাচক প্রচারের কার্যকর ও দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এখানেও বিএনপির কথিত ব্রিলিয়ান্ট মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান গং ঘাপটি মেরে আছেন কি-না কে জানে! এদিকে কথিত প্রচার সংখ্যায় শীর্ষের ওই মিডিয়ার জন্য পোয়াবারো এই কারণে যে, রূপপুরের মতো মেগা প্রকল্পে বিশাল পরিমাণ নির্মাণ সামগ্রী বিশেষত, সিমেন্ট ও রড প্রয়োজন হচ্ছে। উল্লেখ্য, রূপপুর সাইটকে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের জন্য প্রচুর পরিমাণ সিমেন্টের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। আর দেশের সিমেন্ট কোম্পানিগুলো এ সুযোগ লুফে নিতে ভুল করেনি। আবার সিমেন্টে ও রড বিক্রির নগদ অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করছে বিজ্ঞাপন প্রদানে। যার মাধ্যমে ওইসব কোম্পানির ব্যান্ডিং নতুন মাত্রা পাবে বৈকি। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা হলো, কথিত প্রচার সংখ্যার শীর্ষের মিডিয়া (বাংলা ও ইংরেজী) যেখানে রূপপুর নির্মাণের বিরোধী, শুধু তাই নয় রূপপুর সম্পর্কে গোয়েবলসীয় প্রচারণা চালিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিভ্রান্ত করছে ও সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেপিয়ে তুলছে, তারা কোন নৈতিকতায় রূপপুর ব্রান্ডিং-এ সিমেন্ট ও রড কোম্পানির বিজ্ঞাপন ছেপে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন? তাদের নীলনকশার সাফল্যে যদি রূপপুরের নির্মাণ কাজ না-হতো, তাহলে এত টাকার বিজ্ঞাপন কোত্থেকে ছাপানোর সুযোগ পেত ওইসব সব ভালর সঙ্গে বসবাসরত প্রিন্ট মিডিয়া? তাদের কী এ রকম জৌলুস থাকত মিডিয়া পাড়ায়? আসলে কথিত প্রচার সংখ্যার শীর্ষের ওই প্রিন্টমিডিয়া জাতির সঙ্গে মস্কারা করছে রূপপুর সম্পর্কে আজগুবি ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে। তারা নৈতিকতাহীন ও সুবাধাবাদী গণমাধ্যম। সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাই সরকারের অর্জনসমূহ প্রচারে আন্তরিক হওয়া সময়ের দাবি। ফলে প্রচার কার্যক্রমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর সময় কোথায়?। লেখক : বিজ্ঞানলেখক ও গবেষক
×