ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং জোনে কমিশনবাজদের দৌরাত্ম্য

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ৫ জুন ২০১৮

সীতাকুণ্ডের শিপব্রেকিং জোনে কমিশনবাজদের দৌরাত্ম্য

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দেশের একমাত্র জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে বিভিন্ন ইয়ার্ডে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য বেপরোয়া অবস্থায় পৌঁছেছে। এ ঘটনায় ইয়ার্ড মালিকরা রীতিমত অসহায়ত্ব বরণ করে আছেন। উল্লেখ্য, সীতাকু-ের ফৌজদারহাট থেকে কুমিরা পর্যন্ত প্রায় দেড়শ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের মধ্যে বর্তমানে ৪৫টি চালু রয়েছে। এসব ইয়ার্ডে বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে ভাঙ্গা হয়। স্ক্র্যাপ শিপ সরবরাহ হয় দেশের রি-রোলিং মিলগুলোতে। যা থেকে উৎপাদিত হয় রড। উৎপাদিত এ রড দেশে চাহিদার ৭০ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ আমদানি হয় বিলেট ও স্ক্র্যাপ আকারে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প থেকে সরকারী কোষাগারে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব যোগান দেয়া হয়। দেশে রডের চাহিদা সর্বোচ্চ ৪৫ লাখ টন। এর মধ্যে প্রায় ২৬ লাখ টন যোগান হয় জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প থেকে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের একাধিক সূত্রে জানিয়েছে, এ ব্যবসায় বহুমুখী চাঁদাবাজির অর্থ প্রদান করতে গিয়ে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। সরকারী কোষাগারে সব ধরনের রাজস্ব যোগান দেয়ার পর এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণীর প্রভাবশালীদের কাছেও বখরা পৌঁছে দিতে হয়। এর ওপর রয়েছে চাঁদাবাজ মাস্তানদের দৌরাত্ম্য। সীতাকু-ের যে এলাকাজুড়ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো অবশিষ্ট সেগুলোতে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার অভ্যন্তর দিয়ে মালামাল পরিবহনের যানবাহন চলাচল করে থাকে। যানবাহন চলাচলের কারণে বিভিন্ন সড়ক বিভিন্ন সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর কারণে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকদের প্রতিটি সড়ক মেরামতের জন্য নির্ধারিত অঙ্কের টাকা প্রদান করতে হয়। এতে ব্যত্যয় ঘটলে এলাকার মাস্তান শ্রেণীর লোকদের নেতৃত্বে সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে সর্বশেষ রবিবারও অনুরূপ একটি ঘটনার অবতারণা হয়েছে। যদিও এ ঘটনায় যারা আটক হয়েছে তাদের বক্তব্য এক রকম। পক্ষান্তরে ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষের বক্তব্য ভিন্নতর। এ শিপ ব্রেকিং জোনে স্ক্র্যাপ শিপ ভাঙ্গার পর শুধু স্ক্র্যাপ নয়, একটি শিপে যত ধরনের জিনিসপত্র থাকে তা নিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছে লাখো শ্রমিক, হাজারো ব্যবসায়ী। মূলত পাকিস্তান আমলে সীতাকু- এলাকাটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এরপর ঘূর্ণিঝড়ে সীতাকু- উপকূলে আটকে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত একটি জাহাজ ভাঙ্গার পর থেকে শুরু হয় এ ব্যবসার বিস্তৃতি। যা বর্তমানে রীতিমত একটি শিল্পে রূপ নিয়েছে। দেশে সরকারী- বেসরকারী উন্নয়ন প্রকল্প যতই এগিয়ে যাচ্ছে এ শিল্প থেকে স্ক্র্যাপ লোহার যোগান ততই বাড়ছে। ফলে স্ক্র্যাপ শিপ আমদানির পরিমাণও বেড়ে চলেছে। বিপরীতে এ খাত থেকে সরকারী কোষাগারে রাজস্ব যোগানও বাড়ছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পরিবেশ দূষণ ও এ শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের নিরাপত্তা। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, দেশীয় এনজিও এবং সরকার পক্ষেও নানা বিধিবিধান আরোপ করা রয়েছে। এসব মেনেই শিপ ব্রেকিং ব্যবসার প্রসার ঘটছে। তবে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের কারণে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি কারও অজানা নয়। এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতি ডেকে আনার বিষয়টি নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। যার কারণে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং এসোসিয়েশন (বিএসবিএ) এর অর্থায়নে ইতোমধ্যে সেখানে বিশেষায়িত একটি হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সার্বিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে শিপ ব্রেকিং ব্যবসায় জড়িতরাও পিছপা হচ্ছেন না। কিন্তু অনাহূতভাবে কিছু কিছু সংশ্লিষ্ট সংস্থা এ ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিতে তৎপর। এর ওপর রয়েছে এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় ক্যাডার, প্রভাব সৃষ্টিকারী মাস্তান এমনকি পুলিশসহ সমাজের দৃশ্যমান প্রভাবশালীদের বখরা আদায়ের নিরন্তর অপতৎপরতা। যা দিন দিন বিস্তৃতিই লাভ করছে। স্ক্র্যাপ জাহাজ ভাঙ্গা ব্যবসায় জড়িতরা এসব নিয়েই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নিতে বাধ্য রয়েছেন। কোন ঘটনা ঘটলেই স্ক্র্যাপ ব্যবসায়ীদের রীতিমত কপাল পুড়ে। কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা বলে কয়ে আসে না। তারপরও সকল দায় দায়িত্ব বর্তায় ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষের ওপর। ব্যবসায়ীরা এ ধরনের অপতৎপরতার কালো হাত থেকে নিষ্কৃতি চাই। কিন্তু সব পথই যেন রুদ্ধ। সকল অনিয়ম যেন নিয়মেই পরিণত হয়ে আছে। চাঁদা ছাড়া এ ব্যবসা এগিয়ে নেয়া রীতিমত অসম্ভব। এলাকার চেয়ারম্যান, উপ- চেয়ারম্যান, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, আইন প্রণেতাসহ সকলের কাছে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা রীতিমতো জিম্মি। ব্যবসায় লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন বখরা ঠিকই পৌঁছে দিতে হয়। নচেত শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা এগিয়ে নেয়া রীতিমত দুঃসাধ্য। সীতাকু- পুলিশ সমাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় যত না তৎপর তার চেয়ে বেশি তৎপর শিপ ব্রেকিং জোনে ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে। চাঁদাবাজ মাস্তানদেরও শ্যেন দৃষ্টি এ জোনের ওপর। এর পাশাপাশি বনজ সম্পদ উজাড় করে নতুন নতুন ইয়ার্ড সৃষ্টিকারীদের সংখ্যাও রয়েছে। তার ওপর কিছু কিছু এনজিও সংস্থা পরিবেশ দূষণের নামে মামলা-মোকদ্দমার জালে ফেলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাহাজ আটকে রাখার ঘটনাও রয়েছে। এসব বিষয় প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে অজানা নয়। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। ফলে বাধ্য হয়ে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জিম্মিত্ব বরণ করে ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ জোনে চাঁদাবাজ মাস্তানদের কাছে বহু ইয়ার্ড মালিক মালামাল বিক্রি করতে যে বাধ্য এমন ঘটনাও বহু। তাদের দরে তাদের কাছে মালামাল বিক্রি না করলে নেমে আসে প্রতিবন্ধকতার দেয়াল। ফলে প্রশাসনসহ এসব সমাজ বিরোধীদের ম্যানেজ করেই ইয়ার্ড মালিকদের চলতে হয়। এ জোনে বহুমুখী চাঁদাবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর শেষ কোথায় তা কারও জানা নেই। দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। সরকারে যখন যারা থাকেন তাদের দলীয় ক্যাডারদের বখরাপ্রাপ্তি ভর মৌসুম চলে। সরকার বদলে গেলে নতুন সরকারের চেলা চামু-াদের প্রাদুর্ভাব ঘটে। ব্যবসায় লোকসানের কারণে বহু শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড বন্ধ রয়েছে। আবার অনেকে ঋণ খেলাপী হয়ে ইয়ার্ড বন্ধ রেখেছে এমন নজির এর ও কমতি নেই। এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, সীতাকু-ে বেল্টে শিপ ব্রেকিং ব্যবসায় জড়িতদের সামাজিক অবদান কম নয়। পরিবেশ নিয়ে, চাঁদাবাজ নিয়ে, প্রভাবশালীদের আবদার মেটাতে গিয়ে ব্যবসা থেকে লভ্যাংশের বড় একটি অংশ হাত ছাড়া হয়ে যায়। এসব থেকে রেহাই পাওয়ার কোন পথ খোলা নেই। সূত্র জানায়, এ ব্যবসায় জড়িতরা নিশ্চিতভাবে সমাজের বিত্তবান। এসব বিত্তবানদের অনেকে সামাজিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখে আসছেন। কিন্তু চাঁদাবাজ মাস্তানদের দৌরাত্ম্য বন্ধ না হয়ে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। আজ এ গ্রুপ, কাল ওই গ্রুপের সদস্যদের চাহিদা মিটাতে হয়। অন্যথায় সৃষ্টি হয় নানা প্রতিবন্ধকতা।
×