ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ মাদক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক অঙ্গীকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৪ জুন ২০১৮

অভিমত ॥ মাদক নিয়ন্ত্রণে সামাজিক অঙ্গীকার

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ সমাজে সুস্থ সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবন কামনা করে। সুস্থ জীবন সুনাগরিক হওয়ার অন্যতম অবলম্বন। সুনাগরিক হতে হলে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে সুস্থ জীবনের অধিকারী হতে হবে। শারীরিক ও মানসিক উভয় দিয়ে সুস্থ হলেই একজন নাগরিক রাষ্ট্রর প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে পারে। কাজেই সুস্থ জীবন সুনাগরিক হওয়ার চাবিকাঠিস্বরূপ। মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন হতে মাদকের উৎপত্তি হলেও বর্তমানে এর অনিয়ন্ত্রিত এবং ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে সমাজব্যবস্থায় এক মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। মাদকের করাল গ্রাসে মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হচ্ছে। বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। এ সমস্যা প্রতিরোধে প্রয়োজন সামজিক গণসচেতনতা। সমাজের সকল গুণী লোককে মাদকবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে বিশেষত সকল তরুণ ছাত্র-ছাত্রী ও যুবকর্মীদের মাধ্যমে একে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিয়ে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে কার্যকর ভূমিকার প্রতি যতœশীল হতে হবে। মাদকাসক্তি এক নীরব ঘাতক ব্যাধি। যে দ্রব্য গ্রহণে আসক্তি জন্মে তার নাম মাদকদ্রব্য। মাদকদ্রব্য গ্রহণ একটি বদাভ্যাস, একটি আচরণগত সমস্যা, মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে মাদকাসক্তের স্বাস্থ্য হানি হয় জীবনীশক্তি কমতে থাকে, শরীরের ইন্দ্রীয়গুলো নিস্তেজ হয়ে যায়, বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়, মানসিক ভারসাম্য লোপ পায়, কর্মদক্ষতা ও ক্ষমতা গ্রাস পায়, হতাশা এবং অবসাদ তাকে ঠেলে দেয় এক অন্ধকার জীবনে। সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলে। কোন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হলে তার মধ্যে নানা রকম পরিবর্তন দেখা দেয়। এসব পরিবর্তনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনÑ দৈহিক পরিবর্তন, আচরণগত পরিবর্তন, মানসিক পরিবর্তন, বোধশক্তিতে পরিবর্তন, কাজে-কর্মে পরিবর্তন ইত্যাদি। মাদকাসক্তি অপরাধ নয়, রোগ। মাদকাসক্ত ব্যক্তি তাই কোন অপরাধ নয়, একজন রোগী। মাদকাসক্তি একটি মারাত্মক বয়সের অসুস্থতা। এইডস, ক্যান্সার ও হৃদরোগের মতো এটি একটি ভয়াবহ রোগ। মাদকাসক্তির অভিশাপে নিমজ্জিত এখন গোটা পৃথিবী। মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা আজ কোন দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধা নেই। সমগ্র বিশ্ব এ সমস্যার সম্মুখীন। পৃথিবীর অন্যতম উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশও এই সমস্যায় জর্জরিত। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জাতি আজ বেশি উদ্বিগ্ন কারণ বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে ধারণা করা হয় যে, বাংলাদেশে মাদকাসক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের প্রায় দ্বিগুণ। এদেশের মাদকাসক্তদের অধিকাংশই তরুণ এবং শতকরা ৮৫ ভাগ মাদকাসক্তের বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। মাদকাসক্তি কারণ বহুবিধ। উঠতি বয়সীর তরুণরা নেশা করে কৌতূহল বশত, বন্ধুদের প্ররোচনায় অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে ওঠে, বাবা-মার অসুখী দাম্পত্য জীবনের কারণে অনেক হতাশাগ্রস্ত তরুণ নেশা করে থাকে, পাড়া-মহল্লার ক্লাবের আড্ডা থেকেও মাদকাসক্তির বিস্তৃতি ঘটে, কর্মবিমুখিতা ও ভ্রান্ত জীবনদর্শন, অপসংস্কৃতি ও অসৎ সঙ্গের প্রভাব, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা, ব্যক্তিত্ব ও নৈতিক দৃঢ়তার অভাব, মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা, হতাশা (প্রধানত বেকারত্বজনিত), অত্যাধুনিক সাজগোজের প্রবণতা ও স্মার্ট হওয়া সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভের অদম্য আকাক্সক্ষা ইত্যাদি মাদকাসক্তির কারণ। পূর্বেই বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি কিশোর অথবা যুবক। কিশোরের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা থেকে তা বিকাশের পথ প্রথমেই তিরোহিত হয়ে যায়। ছাত্র হলে সে তার লেখাপড়া করতে সক্ষম হয় না। অন্য পেশাদার হলে তাতেও মনোনিবেশ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। ফলে সারাজীবন সে বেকার ও বোঝা হয়ে যায়। আসক্ত ব্যক্তির মানসিক শারীরিক, সামাজিক ও পারিবারিক এবং আর্থিক অবনতি ঘটে থাকে। মাদকাসক্তি প্রতিকার ব্যবস্থাকে সামাজিক আন্দোলন হিসাবে উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, আত্মকর্মসংস্থান ও মাদকবিরোধী বিভিন্ন র‌্যালি/সমাবেশের আয়োজন করতে হবে। এ ছাড়া মাদক সমস্যার সমাধানকল্পে কর্মমুখী শিক্ষার প্রসারের জন্য বর্তমান সরকারকে কিছু বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এই প্রসঙ্গে কারিগরি প্রশিক্ষণের উপরও জোর দিতে হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারের জন্য মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা থাকতে হবে। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইমামগণ ও ধর্মীয় শিক্ষকগণ পারিবারিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণ বিষয় ও বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। এই লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের জীবনের প্রতি আস্থা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের জন্য বিভিন্ন পরামর্শ কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার রোধে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচীর পাশাপাশি বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেরও পালন করতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কোন অবস্থাতেই জাতিকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়া যায় না। তরুণ প্রজন্মকে মাদকদ্রব্যের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা এই মূহূর্তে অত্যন্ত জরুরী। আর এই জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলোর অত্যন্ত স্পষ্ট ও তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। এ ছাড়া মাদকদ্রব্য চোরাচালানিদের বিরুদ্ধেও গণসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আজকের ও আগামী দিনের সুস্থ, সুন্দর, সুখকর জীবনের জন্যই মাদকদ্রব্যের ব্যবহার রোধ করতে হবে। সমগ্র বিশ্ববাসীকে মাদকবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার করার মধ্য দিয়ে মাদকের মরণ ছোবল থেকে বাঁচতে হবে। দেশ ও বিশ্ববিবেক সে প্রত্যাশাতেই প্রহর গুনছে। [email protected]
×