ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মাদকের চেয়েও এর ভয়াবহতা বেশি ;###;তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষতিকর দিকটি পরিলক্ষিত না হলেও এর বিরূপ প্রভাব সুদূরপ্রসারী ;###;ভেজাল খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করছে ;###;শিশুদের অধিকহারে খর্বাকৃতি হওয়ার পেছনেও ভেজাল খাদ্য

খাদ্যে ভেজালের আগ্রাসন ॥ জেল জরিমানা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৩ জুন ২০১৮

খাদ্যে ভেজালের আগ্রাসন ॥ জেল জরিমানা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নান্দোসের মতো আন্তর্জাতিক চেইন খাবারের দোকানের নোংরা রান্না ঘরে খাবারে তেলাপোকা, টিকটিকি পাওয়া গেছে। আগোরা ও স্বপ্নের মতো দেশের অন্যতম খ্যাতিমান চেইন শপে মিলেছে পচা মাংস। ফখরুদ্দিন বিরানীর মতো নামীদামী প্রতিষ্ঠানে পাওয়া গেছে পচা বিস্কুট। সেই বিস্কুট গুঁড়া করে দেয়া হতো হালিমে। রস ও মুসলিমের মতো মিষ্টিতে মিলেছে মরা তেলাপোকা। বছরের পর বছর ধরে তারা একই কাজ করে যাচ্ছে। বারবার অভিযান চালানো হচ্ছে। জেল জরিমানা করা হচ্ছে। তাতেও যেন টনক নড়ছে না কারো। এ সব কারণেই বিশ্বের একনম্বর ফাস্টফুড কেএফসিকে বাংলাদেশ থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। বলতে গেলে দেশের এমন কোন খ্যাতিমান খাবারের দোকান নেই, যাদের পচা, বাসি, নোংরা খাবার বিক্রি বা তৈরির দায়ে জেল জরিমানা গুনতে হয়নি। তারপরও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। খাদ্যে ভেজাল রীতিমতো মহামারী আকার ধারণ করেছে। মাদকের চেয়েও এর ভয়াবহতা বেশি। তাৎক্ষণিকভাবে ভেজাল খাদ্যের প্রভাব পরিলক্ষিত না হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। দেশের ভবিষ্যত হিসেবে পরিচিত কোমলমতি শিশুদের মেধা ভেজাল খাদ্যের কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাদের অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে মুনাফালোভী ভেজাল ব্যবসায়ীরা। এককথায় ভেজাল খাদ্য জাতির মেরুদ-ই ভেঙ্গে দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। রোজায় ভেজালবিরোধী অভিযান চলার পরও ভেজালের আগ্রাসন কমেনি। রোজা ছাড়া অন্যান্য সময়ে ভেজাল জিনিসপত্র তৈরি ও বিক্রি হলেও তা তেমন আলোচনায় আসে না। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ক্যান্সারসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যারা বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই ভেজাল খাদ্যের শিকার। সম্প্রতি বাংলাদেশের শিশুদের অধিকহারে খর্বাকৃতি হওয়ার পেছনেও রয়েছে ভেজাল খাদ্যের প্রভাব। অভিযানগুলোতে দেখা গেছে, নোংরা পচা খাবার বিক্রি, খাবারে মরা মাছি, তেলাপোকা, টিকটিকি পড়ে মরে আছে। এ সবসহ খাবার তৈরি করা হয়েছে। পচা মাংস বিক্রি, বহু পুরনো তেল দিয়ে জিনিসপত্র ভাজি করা, পচা ডিম দিয়ে নুডুলস তৈরি, জিলাপিসহ বিভিন্ন খাদ্যে খাবারের রঙের পরিবর্তে কাপড়ের রং ব্যবহার করাসহ বহু ধরনের ভেজাল করার প্রমাণ মিলেছে। ফরমালিন দিয়ে পচা মাছ শক্ত রেখে সদ্য মরা বলে বিক্রি করা ছাড়াও বহু ধরনের ভেজাল ধরা পড়েছে। হালনাগাদ দুই শতাধিক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। জেল জরিমানা করা হয়েছে অন্তত দেড়শ জনকে। সিলগালা করা হয়েছে শতাধিক খাদ্য প্রস্তুতকারী কারখানা। তারপরও থেমে নেই ভেজালের আগ্রাসন। এ সব বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযান চললেও ভেজালের আগ্রাসন সেই অর্থে বন্ধ করা যাচ্ছে না। সারা বছরই ভেজালের আগ্রাসন থাকে। তবে রোজার সময় সেই আগ্রাসন তুলনামূলক বেশি। বিশেষ করে রোজার সময় মুখরোচক খাবার বেশি তৈরি হয়। আর এসব খাবারে ভেজাল করা হয়। এজন্য রোজার সময় ভেজালবিরোধী বিশেষ অভিযান চালানো হয়। তবে সারা বছরই ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকে। তবে তা স্বল্প পরিসরে। র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সাড়ে সাত বছর ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনকারী বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগে কর্মরত আনোয়ার পাশা জনকণ্ঠকে বলেন, র‌্যাবে থাকা অবস্থায় তিনি অন্তত দেড় হাজার ভেজালবিরোধী অভিযান চালিয়েছেন। অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ভেজালের নানা ধরনের রকমফের রয়েছে। যারা ভেজাল করেন, তারা না বুঝেই অধিক পরিমাণে কেমিক্যাল ব্যবহার করছেন। ফলে খাদ্যে বিষক্রিয়া হয়। যা ভেজালকারী নিজেও বুঝতে পারেন না। যে সব কেমিক্যাল দিয়ে ভেজাল করা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে ফরমালিন। এটি এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ যা সহজেই মানবদেহ সহ্য করতে পারে না। মিশে না। ফরমালিনের কারণে বছরের পর বছর একটি খাদ্য তাজা দেখা যায়। যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর ফল পাকানো হয় ইথোফ্যান নামক কেমিক্যাল দিয়ে। পরিমাণমতো ইথোফ্যান দিলে তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয় না। তবে অধিক দিলে তা অনেক সময়ই শরীরের জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে আনে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ভেজালবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। ক্ষতিকর কেমিক্যাল দিয়ে যাতে কেউ উপযুক্ত সময়ের আগেই ফল পাকাতে না পারে, পচা বাসি খাবার যাতে বিক্রি করতে না পারে এজন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেককেই জেল-জরিমানা করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম ও ঢাকা মহানগর পুলিশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান জানান, ভেজালবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। এ ক্ষেত্রে আইন আরও কড়াকড়ি করতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশে খাদ্যে ভেজাল করার অপরাধে সর্বোচ্চ সাজার বিধান আছে। খাদ্যে ভেজাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হরমোন ও ডায়াবেটিস বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাঃ শাহজাদা সেলিম খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, সাধারণত রোজায় খোলাবাজারে যেসব খাদ্য বিক্রি হচ্ছে, তার অধিকাংশই অস্বাস্থ্যকর। কারণ খাবারের মান অনুযায়ী এসব খাদ্যে মশা, মাছি বসছে, ধুলাবালি লাগছে। এতেই এসব খাবার অস্বাস্থ্যকর হচ্ছে। পচা বাসি তো আছেই। সাধারণত খোলা জায়গায় কোন খাবার তৈরির আধঘণ্টা পরই তা অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায়। যে খাদ্য বেশি সময় ধরে থাকে, সে খাদ্য তত বেশি অস্বাস্থ্যকর হয়। এসব খাদ্য খেলে ডায়রিয়া, আমাশয়, পেট ব্যথা হয়ে থাকে। আর দীর্ঘ সময় খেলে লিভার সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস ও থাইরয়েডের সমস্যাসহ নানা জটিল সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে আস্তে ঘা হতে থাকে। পরে তা ক্যান্সারে পরিণত হয়। ভেজাল খাবারের সঙ্গে ডায়াবেটিস সরাসরি যুক্ত। ভেজাল খাবার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিসের সমস্যা দেখা দেয়। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও জানান, সাধারণত খাদ্যকে ভাল রাখার জন্য খাদ্য অনুযায়ী রাসায়নিক উপাদান ব্যবহৃত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এমন উপাদান ব্যবহারে অনুমতি দিয়েছে। এক্ষেত্রে কোন খাদ্যে বা কোন জিনিসে কি পরিমাণে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হবে তার মাত্রা ঠিক করে দেয়া হয়। সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সঠিকভাবে খাদ্যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে রীতিমতো রেকর্ড গড়েছে কানাডা। যে সব রাসায়নিক পদার্থ খাদ্যে ব্যবহার করা হবে, তার মাত্রা ঠিক করে দেয়া আছে। বাংলাদেশে খাদ্যে সঠিকভাবে পরিমাণমতো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে না। যে কোন খাদ্যে প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি প্রয়োজনীয় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করার অর্থই হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল করা। খাদ্যে যারা এসব রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করছেন, তারা সঠিক মাত্রা না জেনেই ব্যবহার করছেন। ফলে খাদ্য উপকারের চেয়ে অপকার করছে বেশি। যদি সামান্য আয়োডিনের কথাই বলা হয়, তাহলেও তা সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করে লবণে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। লবণে আয়োডিনের পরিমাণ কম বা বেশি দুটোই ক্ষতিকর। একই অবস্থা ফরমালিনের ক্ষেত্রেও। মাছ বা অন্যান্য খাদ্য কম পরিমাণে ফরমালিন ব্যবহার করলে তা স্বাস্থ্যের জন্য বেশি ক্ষতিকর নয়। অথচ আমাদের দেশে যে কোন খাদ্য সর্বোচ্চ যতদিন ভাল রাখতে যে পরিমাণ ফরমালিন দেয়া দরকার তার চেয়েও অনেক বেশি দেয়। এতে করে খাদ্য দ্রব্যে কোন কোন সময় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ফরমালিন ব্যবহৃত হচ্ছে। যা অত্যন্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ। তিনি বলছেন, এর কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে দেশের ভবিষ্যত হিসেবে পরিচিত শিশুরা। ভেজাল খাদ্যের বিষক্রিয়ায় শিশুরা দিন দিন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে। তারা নানা ধরনের রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে কোমলপানীয়তে ফ্যাট থাকছে বেশি। একই অবস্থা ফাস্টফুডগুলোতেও। এসব খাবার খেয়ে শিশুরা শারীরিক উচ্চতা ও বয়সের তুলনায় অনেক মোটা হয়ে যাচ্ছে। এ সব খাবার খেয়ে অধিকাংশ শিশুই ভিডিও গেমস, কম্পিউটার বা ল্যাপটপে মগ্ন থাকছে। এতে করে তাদের শরীরের কোন প্রকার মুভমেন্ট হচ্ছে না। এর ফলে শিশুদের ওজন বাড়ছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। এতে করে একদিকে যেমন মুটিয়ে যাচ্ছে, আরেক দিকে মেধা মননশীলতার বিকাশ ঘটছে না। অতিরিক্ত ওজনের কারণে ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, চোখের সমস্যা, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, লিভার সিরোসিসসহ নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে কিডনির ওপর। কারণ এ ধরনের খাদ্য সহজেই কিডনি ফিল্টারিং করতে পারছে না। ফলে অল্প দিনেই কিডনি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের শিশুদের খর্বাকৃতি হওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবেও এ সবকে চিহ্নিত করেছে লন্ডনের বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েল সোসাইটি।
×