ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের টাকা লোপাট

প্রকাশিত: ০৫:০১, ২ জুন ২০১৮

টিআর ও কাবিটা প্রকল্পের  টাকা লোপাট

স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম ॥ নাগেশ্বরী এবং ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় সরকারের দেয়া ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) এবং সংস্কার (কাবিটা)’র লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। প্রকল্পে ভুয়া সভাপতি এবং স্বাক্ষর জাল করে প্রকল্পের টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। সব অভিযোগ অস্বীকার করে উপজেলা প্রশাসন। সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলা পরিষদের তালিকার ২ নং প্রকল্প বলদিয়া ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের সতিপুরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ছড়ার পাড় সংযোগ সড়কের মাটির কাজে চলতি বছরে দু’ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। প্রকল্পের সভাপতি ও সম্পাদক করা হয় যথাক্রমে মহিলা সদস্য কমেলা বেগম ও হান্নান কাজী নামক একজনকে। প্রকল্পের সময় শেষ হলেও এক ডালি মাটিও পড়েনি কাঁচা সড়কটিতে। ওয়ার্ডের এলাকাবাসী কাদের (৬০) মজিবর (৪৫) এবং ঘোড়ার গাড়ি চালক সামাদ মিয়া (৪৮) জানান, গত বছরের বন্যার পর থেকে এখানে কোন মাটি ফেলে সংস্কার করা হয়নি রাস্তাটি। যার কারণে একটু বৃষ্টি হলেই গাড়ি চলা তো দূরের থাক মানুষ চলাচলে খুব কষ্ট সাধ্য হয়ে যায়। ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান মিন্টু জানান, তিনি নিজেও জানেন না এখানে সড়কে কোন প্রকল্প আছে। শুধু ৪০ দিনের কর্মসূচী দিয়ে এই রাস্তাটি কিছুটা সংস্কার করা হয়। প্রকল্পের সভাপতি বলদিয়া ইউনিয়নের মহিলা সদস্য কমেলা বেগমের অভিযোগ তিনি নিজেই জানেন না যে তাকে প্রকল্প সভাপতি করা হয়েছে। কৌশলে তার ছবি সংযুক্ত করে এবং স্বাক্ষর জাল করে প্রকল্প বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ করেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে মৌখিক অভিযোগ করেছেন। অপরদিক নাগেশ্বরী উপজেলার কেদার ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের বিষ্ণুপুর গ্রামের মোশলেম উদ্দিনের ছেলে কেদার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধেও রয়েছে প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। এখানেও সরেজমিনে দেখা যায়, ওই এলাকায় স্থানীয়দের অর্থ এবং তাদের দেয়া বাঁশ ও স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি করা হয়েছে প্রায় এক শ’ ফুটের ওপরে একটি বাঁশের সাঁকো। এই সাঁকো দিয়ে কয়েকটি গ্রামের মানুষ পারাপার হয়। বাঁশের সাঁকোটি তৈরি করতে সরকারী কোন অর্থ পাননি স্থানীয় লোকজন। অথচ এই সাঁকোটি দেখিয়ে টিআর প্রকল্পের ৮০ হাজার টাকা এবং গ্রাম ম-লের হাট ঈদগাহ মিনার দেড় বছর আগে নির্মিত মিনারটি দেখিয়ে ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেন অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান। এলাকাবাসী বাবু মিয়া ও আবুল হোসেন জানান, ৫ মাস আগে বাড়ি প্রতি ৩/৪টি করে বাঁশ তুলে এই সাঁকোটি তৈরি করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, প্রিন্সিপাল বাঁশের সাঁকো এবং ঈদগাহ মিনারের বরাদ্দের টাকা নিয়েছে। কিন্তু আমরা এক টাকাও পাইনি কাজের জন্য। স্থানীয়রা আরও অভিযোগ করে বলেন, কেদার মহিলা কলেজের নামে বরাদ্দকৃত ২০১৫-১৬ এবং ২০১৬ -১৭ অর্থবছরের দু’ লক্ষাধিক টাকার সোলার নিজ বাড়িতে লাগিয়েছেন প্রিন্সিপাল। এছাড়াও প্রিন্সিপাল নিজের আত্মীয়দেরকে প্রকল্প সভাপতি এবং কমিটিতে রেখে যেকোন প্রকল্পের টাকা নিজেদের পকেটে ভরছেন। ফলে সাধারণ মানুষর জন্য সরকারের দেয়া প্রকল্পের কোন সুফল পাচ্ছে না। ওই প্রিন্সিপাল সংসদ সদস্য একেএম মোস্তাফিজুর রহমানের কাছের লোক হওয়ায় বিগত কয়েক বছর ধরে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করলেও কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না। সরকারের উচ্চ পদস্থ একটি তদন্ত কমিটি করে গরিবের টাকা আত্মসাতকারীদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান তারা। এই বিষয়ে অভিযুক্ত অধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, গ্রামবাসীরা বাঁশ দিয়েছে কিন্তু আমি তো অন্যান্য খরচ দিয়েছি সে টাকা তো তুলতে হবে তাই না। নাগেশ্বরী উপজেলা প্রকল্প তদন্তকারী কর্মকর্তা সিরাজুদ্দৌলা বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না, এখন দেখে শুনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নাগেশ^রী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর কুমার বলেন, প্রকল্পের অনিয়মের বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ভুরুঙ্গামারী উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা খন্দকার মোঃ ফিজানুর রহমান জানান, নিয়ম মেনে প্রকল্প দেয়া হয়েছে। কাজ শেষ না হওয়ার বিষয়ে তিনি জানান, বৃষ্টি থাকায় কাজের ব্যাঘাত হয়েছে কোন কোন জায়গায়। তবে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাত হয়নি। কাজের শুরুতে ৫০ হাজার টাকা ছাড় দেয়া হয়েছে মাত্র। কাজ হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। ভুরুঙ্গামারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম মাগফুরুল আব্বাসী জানান, মৌখিকভাবে অভিযোগ পেয়েছি। পিআইও কে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তথ্যনুসন্ধানে জানা যায়, নাগেশ্বরী উপজেলায় ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১ম পর্যায় টিআর-এ ১৪টি ইউনিয়নে ৫২টি প্রকল্পে ৩২ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৮ টাকা, একই প্রকল্পে এমপির বরাদ্দ দেয়া ১১টি ইউনিয়নে ৩৩টি প্রকল্পে ৩৬ লাখ ৬৫ হাজার ২০৩ টাকা এবং এমপির কাবিখা বরাদ্দে ৮টি ইউনিয়নে ১৮টি প্রকল্পে ৪৯ লাখ ৬২ হাজার ৯৯৮ টাকা। এছাড়াও কাবিটা প্রকল্পে ১৪টি ইউনিয়নে ১৮টি প্রকল্পে ৪৩ লাখ ২১ হাজার ৫৪৫ টাকা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংস্কারের জন্য ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৬০৭ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ভুরুঙ্গামারী উপজেলায় চলতি অর্থবছরে ১ম পর্যায়ে কাবিটার আওতায় ১০টি ইউনিয়নে ১৩টি প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ৩৬ লাখ ৫২ হাজার ৭৬৮ টাকা, টিআর-এ ১০টি ইউনিয়নে ৩৩টি প্রকল্পে ২৮ লাখ ৫০ হাজার ৯৬০ টাকা। এছাড়াও এখানে এমপির কাবিখা প্রকল্পে ২টি ইউনিয়নে ৩টি প্রকল্পের জন্য ৮ লাখ টাকা এবং টিআরের জন্য ৫টি ইউনিয়নে ১১টি প্রকল্পে ১২ লাখ ৪ হাজার টাকা অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের জন্য বরাদ্দ দেয়।
×