ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

অবিরাম কল্লোল ধ্বনি বিছানাকান্দি ...

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ১ জুন ২০১৮

অবিরাম কল্লোল ধ্বনি বিছানাকান্দি ...

ঘড়ির কাঁটাতে সকাল দশটা বাজি বাজি সেই কোন্্ সময় থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি নতুন গন্তব্যে যাব বলে। আকাশের মন খারাপ খুব তাই মুষলধারায় বর্ষণ হয়েই চলছে খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে। এদিকে বৃষ্টির ফলে রাস্তায় হাঁটু পানি। যার ফলে আমরা সবাই গৃহবন্দী অবস্থায় আছি । শেষ পর্যন্ত আমরা বের হলাম সবার কাক্সিক্ষত গন্তব্যে বিছানাকান্দির দিকে। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে আছে পরিবারের সবাই বিশেষ অতিথি হিসেবে আছেন ঢাকা থেকে আগত তাপস মেসো আর মাসি। মূলত মেসোর জন্যই বিছানাকান্দিতে আমাদের যাত্রা। গাড়ি মূল সড়কে উঠতেই তাপস মেসো বলে উঠলেন নতুন গন্তব্যে যাবার প্রস্তুতিতে কেউ সকালে নাস্তা করে নাই তাই আগে নাস্তার পর্বটা সেরে নেয়া যাক। মেসোর কথার সঙ্গে সবাই সম্মতি জানালেন। আমাদের ভ্রমণসঙ্গী অর্পিতা বলে উঠলেন মেসো কোথায় নাস্তা করাবেন। উত্তরে বললেন, তোমরাই বলো কোথায় নাস্তা করতে চাও। সবাই মনে মনে খুঁজতে লাগলেন কোথায় যাওয়া যায়। যেখানে পাওয়া যাবে নতুন খাবারের স্বাদ। সানন্দা বলে উঠলো আমরা কাজলশাহ ইস্কন পরিচালিত ভজানালয়ে যেতে পারি। সেখানে নতুন করে খাবারের দোকান চালু হয়েছে। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম ইস্কনের ভোজনালয়ে। গিয়ে তো চোখ মাথায় উঠার জোগাড়। মানুষের গিজ গিজ করছে বসার কোথাও জায়গা নেই এত বৃষ্টির ভেতরেও । অপেক্ষা প্রহর শেষ করে আমরা বসার জায়গা পেলাম। হাসি মুখে একজন এগিয়ে এলেন কি লাগবে প্রভু। কি আছে জানতে চাইলে বললেন, আছে- রুটি, পরোটা, পাকুরা, অন্ন, ডাল আর সবজি যা চাবেন তাই পাবেন। অনেকদিন পর বইয়ের ভাষার অন্ন শব্দটার স্বাভাবিক প্রচলন শুনে কানে যেন একটু বারি খেয়ে গেল। কেউ সাদা রুটি, কেউ আবার পরোটা, সঙ্গে লাবড়া, সয়াবিন তরকারি, মিষ্টান্ন, হালুয়া নিলেন। সব আইটেম গরম গরম পরিবেশন করা হলো আমাদের মাঝে। সবাই দেখলাম কোন কিছু না বলেই ভোজন শুরু“করলেন যার মানে সবার পেটে লেগেছে আমার মতো। অসাধারণ স্বাদ এতক্ষণে আমার বোঝার বাকি রইল না এত মানুষের ভিড় কেন এখানে। ভোজন পর্ব শেষ হবার আগেই মেসো তারা দিতে থাকলেন। তারা তারি পেট পূজা শেষ কর তা না হলে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। আমরা গন্তব্য পথে যাত্রা শুরু করলাম মহাসড়ক পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। আকাশের মন ভাল না গোমড়া করে আছে। এর মাঝেই আমরা এগিয়ে চলছি চৌহাট্টা, আম্বরখানা, চকিদীঘি পেরিয়ে। সিলেট শহরের বিমানবন্দর রোড ধরে বিছানাকান্দির পথ। দু’পাশের সবুজ চা বাগান পেছনে ফেলে আমরা যাচ্ছি আমাদের গন্তব্যে। এই পথ ধরে গেলে মনে হবে, পুরো পৃথিবীটাই যেন সবুজের রাজ্য। আর আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথটাকে কেউ বড় অজগর বলেও ভুল করতে পারেন। এদিকে আবার মুষল ধারায় বৃষ্টি শুরু হলো। ঝুম বৃষ্টির মাঝে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। এয়ারপোর্ট রোডে ছাড়িয়ে আসার ভাঙ্গাচোরা রাস্তার মধ্যে আমরা পতিত হলাম। কিছদুর পর পর ভাঙ্গা রাস্তা। মেরামতের কাজ চলছে প্রায় সব জায়গাতেই। বেরসিক রাস্তার জন্য সবার অবস্থা কাহিল। এদিকে বৃষ্টির জন্য রাস্তার অবস্থা আরো বেগতিক। বেসামাল রাস্তা পেড়িয়ে আমরা ঘণ্টা দুয়েকে আমরা পৌঁছে গেলাম হাদারপার বাজারে। সেখানে গিয়ে গাড়ি আর এগুতেই চায় না। অনেক খারাপ অবস্থা রাস্তার নিরুপায় হয়ে আমাদের গাড়ি থেকে নামতে হলো। পদব্রজে আমরা এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আমাদের যেতে হবে ট্রলারঘাটে সেখান থেকে নৌকা করে যেতে হবে। নদীর ঘাট কোথায় বলেতেই সবাই বলে সামনে কিন্তু সামনেতো আর শেষ হয় না। এদিকে আকাশের ভেঙ্গে পরার অবস্থা। সবার সঙ্গে আমরা ও পা চালিয়ে হাঁটছি। দূর থেকে দেখা পেলাম সাত পাহারের চূড়া। অসাধারণ প্রকৃতির দূর আকাশে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের ছাড়াছড়ি। শেষ পর্যন্ত আমরা ট্রলার ঘাট এলাকায় এসে পৌঁছালাম। দরদাম করে উঠে পড়লাম ট্রলারে। বলে রাখা ভাল, এ রুটে কোন নিয়মিত প্যাসেঞ্জার ট্রলার নেই। আপনাকে হয় একটি ট্রলার নিজের পুরোটাই ভাড়া করতে হবে। নতুবা অন্য কোন টিমের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে হবে। যদিও এতে সময় অপচয় এবং অন্য টিম না মেলার ঝক্কিটা থেকেই যায়। তাই বিছানাকান্দি যেতে চাইলে টিম ধরে যাওয়াই ভাল। আমাদের যাত্রা শুরু হলো বিছানাকান্দি পানে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় আকাশ আর মেঘের সঙ্গে পাহাড়ের দলগুলো মিশে আছে। যতই কাছে যাই পাহাড়গুলো ততই আকাশ থেকে যেন দূরে যেতে থাকে। আর পাহাড়ের গায়ে বেপরোয়া সাদা মেঘের দলগুলো যেন একটির সঙ্গে আরেকটি আলিঙ্গন করে আছে। আমরা চলছি ঢেউয়ের তালে তালে যখন দুটো ট্রলার একে অন্যকে অতিক্রম করে তখন যেন ঢেউ আঁছড়ে পরে। আধা ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্র পাথর, দেখে যেন মনে হয় পুরো এলাকাটাই পাথরের বিছানা। পিয়াইন নদীর অগণিত পাথরের মাঝে আপনাকে হাঁটতে হবে সাবধানে পা ফেলে। একটু অসাবধানতার ফলে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পানির গভীরতা কম হলেও পাথরের মাঝে আপনার ভ্রমণকে করবে আরও রোমাঞ্চিত। একটু পরপর বিজিবি সদস্যদের সতর্কবাণী আপনাকে এনে দেবে আরও থ্রিলার। জলপাথরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি আমি একের পর এক তুলতে লাগলাম। ওপরে নীল আকাশ ঠিকরে পড়েছে জলে। জল হয়েছে নীলাভ। ডানে-বাঁয়ে সামনে মেঘালয়ের উঁচু পাহাড়। পাহাড়ে হেলান দিয়ে সাদা মেঘ। মাঝে ঝরনার বর্ষণধারা। দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত শুধু পাথর আর পাহাড়। এ দৃশ্য দেখে নিজেকে সামলানো যে বড় কঠিন! বিছানাকান্দির জল ধারায় স্নাত হয়ে আমরা গেলাম পাশের ছোট্ট বাজারে। ছোট্ট বাজার বললে ভুল হবে কি নেই সেই বাজারে। তবে ভিন্নতা হলো সেখানে সব ভারতীয় পণ্য অনেক কম দামে কিনতে পারবেন। নানা রকমের চকোলেট, সাবান, শ্যাম্পু, ছোটদেরখেলনা, কসমেটিক, আচার আরও অনেক কিছু নাম বলে শেষ করা যাবে না। আমরা ঘুরে বেড়ালাম ছোট্ট বাজারে। আমাদের ছোট্ট ভ্রমণসঙ্গী সপ্তক তার দিদির কাছে বায়না ধরল তাকে খেলনা কিনে দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে দিদা তাকে খেলনা কিনে দিলেন। সবাই বাজার থেকে কিছু না কিছু কিনল চকোলেট, বিস্কুট, আচার, সাবান, কসমেটিক বাজার সদাই করে সবাই ক্লান্ত পেটে লেগেছে সবার। ছোট মাসি বলে উঠলেন পেটে কিছু না দিলে আর সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। আমরা বাজারের পাসে গড়ে ওঠা খাবারের দোকানে গেলাম। সবাই কোন কথা না বলেই বসে পরল খাবারের টেবিলে। এক ভদ্র মহিলা এলেন কি লাগবে আপনাদের দেশী মুরগির মাংস, রুইমাছ, বোয়ালমাছ, ছোটমাছ, চিংড়িমাছ, বেগুনভাঁজা, ভেরাইটিজ কি লাগবে। সবাই চিন্তার মাঝে পরে গেল কে কোন আইটেম খাবেন বলে। আমি নিলাম দেশী মুরগির মাংস, আর বোয়ালমাছ। রান্না বাটা মসলার স্বাদ, অসাধারণ লাগছিল খেতে। অনেকদিন পর বাটা মসলার স্বাদ পেলাম। শহুরে জীবনে বাটা মসলার ব্যবহার এখন কেউ আর করে না। আমাদের সঙ্গীদের কেউ ছোট মাছ আবার কেউ রুইমাছ নিলেন। সবাই আহার পর্ব শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললেন। এবার বিদায় নেবার পালা সবাই চাইছিল আরও কিছু সময় থাকার জন্য কিন্তু সূর্যদেবের বিদায়ের পালা চলে আসছে। আমরা ফিরে চললাম ঘাটের দিকে। পেছন থেকে সীমান্তের দিগন্ত ছোঁয়া মেঘালয় পাহাড় হাত ছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের। সময় পেলে ঘুরে আসতে পারেন এই পর্যটন স্পট থেকে। এখানকার নয়নাভিরাম প্রকৃতি আপনাকে নিরাশ করবে না। যাবেন কীভাবে : সিলেট শহর হতে ৬০ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নে বিছানাকান্দি গ্রাম। সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জ মহাসড়ক ধরে সালুটিকর বাজারের ডান দিকে গাড়ি নিয়ে গোয়াইনঘাট লিঙ্ক রোডে হয়ে দেড় ঘণ্টা গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন বিছানাকান্দি। এক্ষেত্রে শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজি নিলে সহজে এবং কম খরচে বিছানাকান্দি যাওয়া যায়। হাদারপাড় বাজার পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা। সেখানে পৌঁছুতে লাগবে কমবেশি দেড় ঘণ্টা। বাজারের পাশেই খেয়াঘাট। ঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে যাওয়া যায় বিছানাকান্দি। দর কষাকষি করে ১০০০ টাকার মধ্যে নৌকা রিজার্ভ করা যায়। যদিও পর্যটকদের কাছে অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকানোর নজির এখানকার মাঝিদের আছে। তাই আগে থেকে ভাড়া ঠিক করে নেয়া ভাল। নৌকায় যেতে যেতে দেখতে পাবেন দুপাশে সবুজ গ্রামের প্রতিচ্ছবি। সঙ্গে দূরে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখে অতি নীরস লোকটিও যদি একটু রসিকতা করে, তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সেটিই যেন স্বাভাবিক। নৌকা যতই আগাবে সামনের দিকে আপনি ততই অবাক হতে বাধ্য। নদীর ধার ঘেঁষে মাঝে মাঝে উঁচু করে স্তূপ আকারে জমিয়ে রাখা হয়েছে সাদা, কালো ও বাদামি পাথরের চাঁই। মনে হবে সবুজ পাহাড়ের কোলে আরেক সাদা পাহাড়।
×