ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন বাজেটে কমছে কর্পোরেট কর হার

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১ জুন ২০১৮

বিনিয়োগ আকর্ষণে নতুন বাজেটে কমছে কর্পোরেট কর হার

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ আসছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ বাড়াতে কর্পোরেট করের হার কমানো হচ্ছে। কর্পোরেট করের হার বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না ব্যবসায়ীদের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় এফবিসিসিআই, ডিসিসিআইসহ প্রায় সব ব্যবসায়ী সংগঠন থেকেই আসছে বাজেটে কর্পোরেট কর কমানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এসব প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান ব্যবসায়ীদের কর কমানো বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। ফলে ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে কর্পোরেট করের হার আড়াই থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হতে পারে। এদিকে কর্পোরেট করের হার কমানো প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা একমত হলেও এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, এমনিতেই এনবিআর রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারছে না। এ অবস্থায় কর্পোরেট করের হার কমানো হলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ আরও কমে যাবে। এতে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণও বাড়বে। অন্যদিকে কর্পোরেট করের হার কমানো হলে বিনিয়োগ বাড়বে এর কোন নিশ্চয়তা নেই বলেও অর্থনীতিবিদদের অভিমত। তাদের মতে এতকিছুর পরও যদি কর্পোরেট কর কমাতে হয় তাহলে কর ফাঁকি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে কোন ফাঁক-ফোকর দিয়ে করযোগ্য প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিতে না পারে। এ ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া বলেন, বাংলাদেশে কর্পোরেট কর অনেক বেশি, এটা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আগামী বাজেটে কর্পোরেট কর কিছুটা কমাতে হবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের কিছুটা সুযোগ দিতে হবে যাতে করে দেশে বিনিয়োগ বাড়ে। ফলে সবদিক বিবেচনা করে একটা সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই বাজেট তৈরি করতে হবে। মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া আরও বলেন, আগামী বাজেট এমনভাবে তৈরি করা হবে যাতে দেশে শিল্পায়ন হয়, বিনিয়োগ বাড়ে। এজন্য আগামী বাজেট হবে জনকল্যাণমুখী ব্যবসাবান্ধব। এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) বলেন, ‘কর্পোরেট কর কমানো এবং ব্যক্তি আয়কর সীমা বাড়ানোর জন্য আমরা বলেছি। কর্পোরেট কর পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার বিষয়টা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন। ফলে আগামী বাজেটে কর্পোরেট কর কমানো হবে বলে আমরা প্রত্যাশা করছি। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যবসায়ীদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে প্রফিট মার্জিন কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ায় ব্যবসায়ীদের সমস্যা হচ্ছে। কর্পোরেট কর কমানো হলে ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ক্ষমতা বাড়বে এবং তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি কর্পোরেট কর কিছুটা কমানোর সুযোগ রয়েছে। তবে করের হার কমানো হলে বিনিয়োগ বাড়বে সে আশা করাটা অবাস্তব। তিনি বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করের হার অবশ্যই একটা বিবেচনার বিষয়। কিন্তু তার চাইতে অনেক বেশি বিবেচনার বিষয় হচ্ছে অবকাঠামো পরিস্থিতি কী রকম? বিদ্যুত ও গ্যাসের পরিস্থিতি কী রকম? সার্বিকভাবে সুশাসন ও ব্যবসা বাণিজ্যের পরিবেশ কি রকম ইত্যাদি বিষয়। তবে যাই হোক এইসব পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শুধু কর্পোরেট করের হার কমানো হলে বিনিয়োগ বাড়বে না। সিপিডির সিনিয়র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সিপিডি’র অবস্থান হলো যে কোন ধরনের করের হার সংশোধনের ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ একটি গবেষণা করে দেখা দরকার, আসলে কর্পোরেট কর কমালে বিনিয়োগে কোন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে কিনা। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে কর্পোরেট কর কমানো হলেও তার কোন প্রতিক্রিয়া বিনিয়োগে পড়েনি। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে কর্পোরেট কর কমানোর সঙ্গে বিনিয়োগের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাওয়া যায়। কারণ হলো, ওইসব দেশে কর ফাঁকি দেয়ার সুয়োগ অনেক কম। সেখানে সরকারের কর আদায় প্রক্রিয়া এবং নজরদারি প্রক্রিয়া অনেক শক্তিশালী। ওইসব দেশে ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্টের তুলনায় আমাদের দেশে ফাইন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট অনেক দুর্বল। ফলে কর কমিয়ে দিলে বিনিয়োগ কতটা বাড়বে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শেষ কথা হলো বাংলাদেশে ব্যবসার খরচ অনেক বেশি। গ্যাস, বিদ্যুত ও শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য সরকার যদি কিছুটা কর কমাতে চায় তাহলে সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে কর্পোরেট করের হার : বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট করের হার ৪০ শতাংশ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্পোরেট করের হার ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকের ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ সকল প্রকার তামাক পণ্যের প্রস্তুতকারী কোম্পানির জন্য করের হার ৪৫ শতাংশ। এছাড়াও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মোবাইল ফোন কোম্পানির করের হার ৪০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত মোবাইল ফোন কোম্পানির করের হার ৪৫ শতাংশ। আবার পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির করের হার ২৫ শতাংশ এবং তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির কর্পোরেট করের হার ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে তালিকাভুক্ত ও তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করের ব্যবধান ১০ শতাংশ। অর্থাৎ কোন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে ১০ শতাংশ কর রেয়াত সুবিধা পায়।
×