ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাচারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি একাট্টা

টেকনাফে শতাধিক ইয়াবা কারবারি বিএনপি ঘরানার!

প্রকাশিত: ০৬:১৭, ১ জুন ২০১৮

টেকনাফে শতাধিক ইয়াবা কারবারি বিএনপি ঘরানার!

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ দেশে মাদকবিরোধী অভিযানে সর্বস্তরের জনগণ খুশি হয়েছে। সাধুবাদ জানিয়েছে সরকারকে। তবে বিএনপি বলছে তাদের নেতাকর্মীদের ধরতে এ অভিযান। অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম উঠে আসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী টেকনাফে যুবলীগ এবং মোহনগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ নেতাকেও রেহাই দেয়নি। র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এবং তিনবার নির্বাচিত পৌর কাউন্সিলর একরামুল হক ও মোহনগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মুজিবুর রহমান। অভিজ্ঞজনরা বলেন, বিএনপির আমলে টেকনাফে ইয়াবা কারবারের বিস্তার ঘটেছে। টেকনাফ ও উখিয়ার বেশিরভাগ ইয়াবা কারবারি বিএনপি ঘরানার লোক। অল্প দিনেই তাদের অবস্থা বিত্তবৈভবে পরিপূর্ণ। তাদের দেখাদেখি ইয়াবার হাল ধরেছে আওয়ামী ঘরানার লোকজনও। ১৯৯২ সালের দিকে টেকনাফ সীমান্তে যখন ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য চলছিল, তখন ইয়াবা ডন সাইফুল করিম, জাফর আহমদ, আবদুল্লাহ ও রাশেদুল করিম মার্কিন উপজেলা বিএনপির নেতা। তখন মিয়ানমার থেকে ক্ষমতার দাপট ও টাকার জোরে ১৯৯৫ সালে সীমান্ত বাণিজ্যের নামে লাখ লাখ পিস ইয়াবার চালান আনে। সে সময় থেকে বিএনপি ঘরানার বহু নেতা কর্মী তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। ক্ষমতার দাপট ও ইয়াবার চালান সরবরাহ করে বিএনপি, যুবদল ছাত্রদলের লোক কামাই করে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ইয়াবা ব্যবসা করে উখিয়া টেকনাফের বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল নেতারা অঢেল টাকার মালিক বনে গেছে। বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী জনপ্রতিনিধি (ইয়াবা কারবারি) নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৪ সাল থেকে সরকারের করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নাম থাকলেও বহু বিএনপি নেতার নাম বাদ পড়ে গেছে। ইয়াবার চালান বিক্রিতে কোটি কোটি টাকা কামাই করেছে বিএনপি নেতারা। অথচ তারা গভীর পানির মাছ হিসেবে জীবনযাপন করায় ওইসময় অপ্রকাশিত রয়ে যায় বিএনপি নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের নাম। নীরবে ইয়াবা ব্যবসার ডন হলেও বিএনপির একাধিক নেতা রয়েছেন এখনও সম্পূর্ণ আলোচনার বাইরে। সূত্র জানায়, দেশে বিএনপি নেতাদের শক্তিশালী ইয়াবা সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সিন্ডিকেটকে ইয়াবা চালানের যোগান দেয়া হয় টেকনাফ থেকে। বিএনপি আমলেই টেকনাফে ইয়াবা কারবার শুরু করেছিল বিএনপি নেতা জাফর আহমদ, (বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা) উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ও বিএনপি নেতা সাইফুল করিম। এমন কি সাইফুল করিমের দালানে ১৯৯৪ সালে গোপনে ইয়াবা তৈরির মেশিনও স্থাপন করা হয়েছিল। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে ওই ইয়াবা কারখানা বন্ধ করে দেয় সাইফুল সিন্ডিকেট। বর্তমানে ওসব ইয়াবা ডন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। টেকনাফ উপজেলা বিএনপি নেতা জাফর আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, টেকনাফের শীলবনিয়া পাড়ার হাজী সাইফুল করিম, জিয়াউর রহমান, আবদুর রহমান, মনির উল্লাহ, সাকের, দিল মোঃ দিলু ও হ্নীলা পূর্ব লেদার জাফর আলম ছাড়াও টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজারে বহু বিএনপি নেতাকর্মী ইয়াবা কারবারে জড়িত। সম্প্রতি বিএনপি নেতা আবদুল্লাহর সহোদর জিয়াউর রহমানের বাড়ি থেকে বিপুল ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ। সেন্টমার্টিনের অদূরে সমুদ্র পথে বিএনপির চিহ্নিত ওই ইয়াবা ব্যবসায়ীরা ট্রলার ভর্তি ইয়াবার চালান পৌঁছাত চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। মাঝ পথে কোন সমস্যার ইঙ্গিত পেলে ওসব ইয়াবা খালাস করা হতো মহেশখালীর যুদ্ধাপরাধীপুত্র সালাহ উদ্দিনের কাছে। অথবা টেকনাফ বাহারছড়ার হাবিবুল্লাহ ও মৌলবি আজিজ উদ্দিনের কাছে। মহেশখালীতে ইয়াবা ডন সালাহ উদ্দিন ও শামলাপুরে মৌলবি আজিজ উদ্দিন এবং হাবিবুল্লাহ সর্বপ্রথম ইয়াবা আনা শুরু করেছিল বলে তথ্য মিলেছে। জানা গেছে, টেকনাফ পৌর বিএনপির সভাপতি রাজ্জাক মেম্বারের দুই ছেলে মোঃ আবদুল্লাহ ও মোঃ ফারুক তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। তার ছেলে কক্সবাজার জেলা ছাত্রদল নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ২১ লাখ টাকা এবং ৭০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল। টেকনাফ বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির নেতা রাশেদুল করিম মার্কিন তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী। টেকনাফ উপজেলা যুবদল যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুল আমিন আবুল কিছুদিন আগে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ ঢাকায় আটক হয়েছিল। টেকনাফ সদর বিএনপির সভাপতি আলম মেম্বারের ছোট ভাই শামসু আলম কালু ৭ লাখ ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়ে ১০ বছরের কারাদ-ে দ-িত হয়ে বর্তমানে সাজা ভোগ করছে। এছাড়াও টেকনাফ বিএনপি নেতা ও হ্নীলা ইউপি সদস্য শামসুল আলম বাবুল, হ্নীলা ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা জিয়াউল বশির শাহীন, টেকনাফ উপজেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা ও টেকনাফ পৌরসভার মধ্যম জালিয়াপাড়া যুবদলের আহ্বায়ক আবদুল্লাহ তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। দেশের অন্যতম শীর্ষ ইয়াবা পাচারকারী হচ্ছে হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও কক্সবাজার জেলা যুবদলের নেতা মোঃ আলী। বিএনপি নেতা শাহপরীর দ্বীপের ইসমাইল মেম্বারের নামও আছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায়। কুখ্যাত ইয়াবা কারবারি উখিয়ার থাইংখালীর জয়নাল মেম্বার, নুরুল আমিন মেম্বার, কলিমুল্লাহ লাদেন ও গোয়ালিয়ার মোস্তাক মেম্বার বিএনপি নেতা। তারা বর্তমানেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা পাঠিয়ে হাজার হাজার পিস ইয়াবার চালান আনছে। তবে ইয়াবা মোস্তাক ইয়াবার চালান নির্বিঘেœ গন্তব্যস্থলে পাঠানোর আশায় বর্তমানে আওয়ামী লীগ সমর্থন করে যাচ্ছে। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রাকিব আহমদ ইয়াবা ব্যবসার সুবিধার্থে আওয়ামী লীগকে ডাল হিসেবে ব্যবহার করছে। গতবার নির্বাচনে তার পক্ষে স্থানীয় জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মী এবং ইয়াবা কারবারিরা ব্যাপক প্রচার চালিয়েছে। রাকিব মেম্বার তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা পাচারকারী হলেও এক এমপির মদদে পার পেয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। কক্সবাজার ও উখিয়া-টেকনাফে মিছিল-মিটিংয়ে পৃথক হলেও ইয়াবা কারবারে আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাকর্মীরা একাট্টা। বিএনপির সিনিয়র নেতা জনপ্রতিনিধি ছাড়াও ওয়ার্ড পর্যায়ের অনেক বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদল নেতা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায় রয়েছে। একইভাবে ইয়াবা কারবারে জড়িত রয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বহু নেতাকর্মী। বিএনপি নেতা অনেকে দল ক্ষমতায় নেই বলে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর (ইয়াবা কারবারি) হাত ধরে ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। সচেতন মহল মনে করে, কি করে তারা অল্প সময়ে বিপুল সম্পদের এবং গাড়ি, বাড়ি সুরম্য অট্টালিকার মালিক হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
×