ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভারি বর্ষণে রাজধানীর বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে যায়, তীব্র যানজট ;###;কোথাও কোথাও পারাপারের বাহন হিসেবে নৌকা ব্যবহার;###;এবার ১৭ দিন আগেই মৌসুমি বায়ু দেশের ভেতরে প্রবেশ করছে

রেকর্ড বৃষ্টি ॥ তিন ঘণ্টায় ৮১ মিলিমিটার

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১ জুন ২০১৮

রেকর্ড বৃষ্টি ॥ তিন ঘণ্টায় ৮১ মিলিমিটার

শাহীন রহমান ॥ মে মাসে বৃষ্টিপাতের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টা থেকে বেলা নয়টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ঢাকায় ৮১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। আবহাওয়া অফিস বলছে, গ্রীষ্মে বিশেষ করে মে মাসে তিন ঘণ্টায় এই পরিমাণ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড তাদের কাছে নেই। এমনকি মে মাসের একদিনের রেকর্ডে এই পরিমাণ বৃষ্টিপাত আগে কখনও হয়নি; যা বৃহস্পতিবার তিন ঘণ্টায় হয়েছে। তারা জানায়, বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিপাত বাদ দিয়ে এবার মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এদিকে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। নগরবাসীকে পোহাতে হয়েছে চরম ভোগান্তি। আবহাওয়া অফিস জানায়, আগামী ২/৩দিনও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে এবং ঢাকাসহ দেশের মধ্যাঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া এবার মৌসুমি বায়ু অনেক আগেই দেশের ভেতরে প্রবেশ করছে। মৌসুমি বায়ু বর্তমানে রাখাইন কোস্টে অবস্থান করছে। আজ শুক্রবার রাতের মধ্যেই তা টেকনাফ উপকূলে প্রবেশ করতে পারে। মৌসুমি বায়ু দেশের ভেতরে প্রবেশ করলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে। এদিকে সকাল থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। অফিসগামী লোকজন এবং স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। প্রধান প্রধান সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে কোথাও কোথাও পারাপারের বাহন হিসেবে নৌকা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। সকাল থেকে বিভিন্ন সড়কে দেখা দেয় তীব্র যানজট। আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, ’৮১ সালের পর মে মাসে একাধিকবার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালের পর এবারই প্রথম মে মাসে এত অধিক বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। আগে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হলেও একদিনে এত বৃষ্টিপাত কখনও হয়নি। সর্বোচ্চ ৭২ মিলিমিটার পর্যন্ত রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার তিনঘণ্টার বৃষ্টিপাত সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। তিনি জানান, এই সময়ে তিন ঘণ্টায় এত বৃষ্টিপাত হওয়ার রেকর্ড আবহাওয়া অফিসের কাছে নেই। আব্দুল মান্নান জানান, আগামী ২/৩ দিন পর্যন্ত বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এছাড়া এবার আগে আগেই মৌসুমি বায়ু দেশের ভেতরে প্রবেশ করছে। আজ শুক্রবারের মধ্যে মৌসুমি বায়ু টেকনাফ বন্দরের পৌঁছে যাবে। এক সপ্তাহের মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের ধারা আরও বেড়ে যেতে পারে। গত বছর ১৭ জুন মৌসুমি বায়ু দেশের ভেতরে প্রবেশ করলেও এবার ১৭দিন আগেই তা দেশে আসছে। আবহাওয়া অফিসের হিসাব বলছে, গত শনিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত এই চারদিন বাদ দিলে মে মাসজুড়েই বৃষ্টিপাতের দাপট ছিল লক্ষ্য করার মতো। শুধু বৃষ্টিপাত নয়, কালবৈশাখীর তা-ব আর বজ্রঝড় ছিল উল্লেখ করার মতো। বজ্রপাতে কয়েক শ’ লোকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে; যা এখনও অব্যাহত। এছাড়া হঠাৎ ঘনকালো মেঘের কারণে চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে রাতের আবহও সৃষ্টি ছিল এ মাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে সব কিছু পেছনে ফেলে বৃহস্পতিবার সকালে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তার কোন রেকর্ড আবহাওয়া অফিসের কাছে নেই। এদিকে বৃহম্পতিবার সকালে বৃষ্টির পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝড়োবাতাসসহ বৃষ্টি হয়েছে। সকাল ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৮১ মিলিমিটার। এ ছাড়া চট্টগ্রামে হয়েছে ৭৫ মিলিমিটার। তারা জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপ বিহার এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থন করছে। এর বর্ধিতাংশ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কারণে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দম্কা হাওয়া ও বিজলি চমকানোসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি-ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। জলাবদ্ধতা, যানজট ভোগান্তি ॥ বৃষ্টিপাতের কারণে রাজধানীর সব নিচু এলাকা হাঁটুপানি পর্যন্ত ডুবে যায়। যান চলাচলে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। কোন কোন এলাকায় নৌকা নিয়ে পারাপার করতে দেখা যায় যাত্রীদের। যানজটের ভোগান্তি সারাদিনই সহ্য করতে হয়েছে নগরবাসীকে। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর ব্যস্ততম মিরপুর ও তার আশপাশের এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। প্রধান সড়কগুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। অফিসগামী লোকদের দুর্ভোগ ছিল অবর্ণনীয়। মিরপুরের ১ নম্বর দারুসসালাম রোড়ের টিএ্যান্ডটি চায়নিজের সামনে গ্যাসের লাইনের কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় সকালে বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ওই গ্যাসের লাইনের গর্তে চলন্ত রিক্সা- প্রাইভেটকার আটকে যায়। প্রধান সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে টেকনিক্যাল থেকে মিরপুর এক পর্যন্ত বিশাল যানজটের কারণে গাড়ির দীর্ঘ লাইন সৃষ্টি হয়। এছাড়া বৃষ্টির কারণে শ্যামলি, পল্লবী, তালতলা, মোহাম্মদপুর, কাজীপাড়া, শেরেবাংলা নগর, আগারগাঁও সড়কও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। যান চলাচলের সময় প্রচ- ঢেউ সৃষ্টি হয়। গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকে পড়ায় অনেক যানবাহন সড়কের ওপরই বিকল হয়ে পড়ে। পানির মধ্য দিয়ে পথচারী হেঁটে চলাচল করেন। ক্যান্টনমেন্ট, কালশি, উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকা এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ধানম-ি-২৭, হাজারীবাগ, শংকর, জিগাতলা, রায়েরবাজার ও পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডসহ অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কাজে বাইরে বের হওয়া এসব এলাকার লোককে সীমাহীন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পুরো সড়কে হাঁটুপানি জমে যায়। ফলে যানবাহনও কমে যায়। বেশকিছু গাড়ি সড়কেই নষ্ট হয়ে পড়ে। মে মাসের আবহাওয়া বিশ্লেষণ ॥ এদিকে ১ মে থেকেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে একটানা বর্ষণ ছিল। সঙ্গে ছিল কালবৈশাখী ঝড় এবং বজ্রপাত। বজ্রপাতে মে মাসে কয়েক শ’ লোকের মৃত্যু হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মে মাসে দীর্ঘমেয়াদী পশ্চিমা লঘুচাপ এবং পুবালী হাওয়ার সংমিশ্রণের কারণে এবার গ্রীষ্মে অন্যান্যবারের তুলনায় অধিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাদের হিসাবে মে মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় ৫৮ ভাগ বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। বৃহস্পতিবারের ৮১ মিলিমিটার যোগ করলে এ পরিমাণ আরও বেশি দাঁড়াবে। ৪ দিনের দাবদাহ ॥ এদিকে মে মাসজুড়ে টানা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলেও গত শনিবার ২৬ মে থেকে ২৯ মে পর্যন্ত কোন বৃষ্টিপাত হয়নি। শুধুমাত্র এই কয়েকদিন গ্রীষ্মে প্রচ- দাবদাহ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে রাজধানীবাসী। তাপমাত্রাও বেড়ে যায়। গত সোমবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৫ দশমিক ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সারা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে সাতক্ষীরায় ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আবহাওয়াবিদরা জানান, রোদেলা দিনে বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি থাকায় এবং বাতাসের গতিবেগ কম হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই চারদিন অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হয়েছে। গত বুধবার সন্ধ্যায় মাঝারি মাত্রার বৃষ্টিপাত পুনরায় স্বস্তি বয়ে আনে। তারা জানান, এই সময়ে সাগরে সৃষ্টি হয় একটি নি¤œচাপ। ফলে সমুদ্রবন্দর এলাকায় তিন নম্বর সতর্কতা জারি করা হয়। যদিও নি¤œচাপটি গত বুধবার রাখাইন উপকূল হয়ে স্থলভাগে গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। ঘনকালো মেঘে বারবার অন্ধকার নেমে আসে ॥ এবারের মে মাসে আবহাওয়ার ধরন ছিল অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে কিছুটা আলাদা। যখনই মেঘ সৃষ্টি হয়েছে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে সঙ্গে সঙ্গে। একাধিকার এ ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। বিশেষ করে প্রথম দিকে আকাশ পরিষ্কার থাকলেও পরিস্থিতি দ্রুতই বদলে যেতে থাকে। চারদিকে ঘনিয়ে আসে অন্ধকার। ঘনকালো মেঘে ঢেকে যায় সারা আকাশ। দিনের পরিবেশ দেখে মনে হয় কৃষ্ণপক্ষের মধ্যরাতের কোন দৃশ্য। এবার আকাশে কালবৈশাখীর মেঘ জমলেই প্রায় এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে একাধিকবার। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই সময়ে মেঘের ঘনত্ব অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকার ফলে যখন মেঘ হয় তখন আকাশে এমন একটি অবস্থার তৈরি করে যার মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। তারা বলেন, সাধারণত এই সময়ে আকাশের অনেক উপরে কালকালবৈশাখীর মেঘ জমে। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে মেঘের ঘনত্ব থাকে। মেঘের এই অধিক ঘনত্বের কারণে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। তবে এই পরিস্থিতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, দ্রুতই পাল্টে যায় এবং চারদিক আবার পরিষ্কার হয়ে যায়। বৈশাখ মাসের মেঘ সাধারণত পুরু ও ভারি হয়। এ কারণে ওই ভারি মেঘের স্তর ভেদ করে ভূপৃষ্ঠের দিকে সূর্যের আলো আসতে পারে না ফলে মেঘগুলো কালো দেখায়। গবেষকদের মতে, এ ধরনের মেঘের পুরুত্ব ৩ হাজার ফুট পর্যন্ত হতে পারে যা সূর্যালোকের পক্ষে ভেদ করা প্রায় অসম্ভব। গত ১০ মে বৃহস্পতিবার সকালের কালো মেঘ এমন আকার ধারণ করে যে দিনের আলো উবে গিয়ে প্রকৃতিতে অন্ধকার নেমে আসে। যেন অমাবস্যা রাতের কোন দৃশ্য। পরিবেশ দেখে নগরবাসীর মনও দুরু দুরু করতে থাকে, কি জানি কি হয়। হুটহাট নেমে আসা রাতের আঁধার কিছুটা উৎকণ্ঠায় ফেলে তাদের। ৩০ এপ্রিলও রাজধানীতে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ওইদিন সকাল থেকেই আকাশে জমতে থাকে খ- খ- কালো মেঘ। বেলা একটু বাড়তে থাকলে আকাশে রোদের শেষ রেখাটুকুও মিলিয়ে যায়। ঘনকালো মেঘে ঢেকে যায় ঢাকার আকাশ। সাড়ে এগারোটার দিকে চারদিকে নেমে আসতে শুরু করে রাতের আঁধার। গত ২ মে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকেও এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কালো পর্দার মতো ঘনকালো মেঘের স্তরে ঢাকা পড়ে ঢাকার আকাশ। বাসা-বাড়িতে জ্বলে ওঠে বাতি। সড়কে বাধ্য হয়ে মোটরযানগুলো জ্বালায় আলো। গত ৩০ মার্চও ঢাকার আকাশ ঢেকে যায় ঘন কালো মেঘে। ওইদিনও ঝলমলে তপ্ত দুপুরের পরে বিকেল নামতেই বদলে যায় ঢাকার আকাশ; ছেয়ে যায় ঘনকালো মেঘে।
×