ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সিয়াম-রোজা-উপবাস-মৌনতা

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১ জুন ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ সিয়াম-রোজা-উপবাস-মৌনতা

ইসলাম কলেমা, সালাত, সওম, হজ, যাকাত- এই পাঁচটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সিয়াম বা সওম শব্দের শব্দমূলগত অর্থ বিরত থাকা, ক্ষেত্রবিশেষে এর অর্থ মৌনতা অবলম্বনও হয়। একে যে রোজা বলা হয় এটা মূলত সিয়ামের ফারসী অর্থ। পারসিক বা যরুস্ত্রু ধর্মাবলম্বীরা রোজা পালন করত। পারস্যে ইসলাম এলে সওমের অর্থ রোজা করা হয় এবং ফারসীর প্রভাবে রোজা শব্দটি আমাদের কাছেও এসে যায়, অবশ্য উপবাস শব্দটি সওম বা সিয়ামের অর্থে তেমন একটা ব্যবহৃত হয় না। ইসলামে যাবতীয় পানাহার, কামাচার, পাপাচার, মিথ্যাচার থেকে নিয়ত করে প্রত্যহ দিবাভাগের সবটুকু সময় অর্থাৎ সুবিহ্ সাদিকের পূর্বক্ষণ থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকাকে সিয়াম বা সওম বলে। আবার দেখা যায়, বিশেষ ক্ষেত্রে এটা মৌনতা অবলম্বন করা অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। হযরত মরিয়ম ‘আলায়হাস্ সালাম বিনা স্বামীতে সন্তান প্রসব করায় সামাজিক জিজ্ঞাসার আশঙ্কায় দারুণ মুচড়ে পড়লে আল্লাহর তরফ থেকে মৌনতা (সওম) পালনের নির্দেশ আসে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ফাকুলী ওয়াশররী ওয়া কাররী ‘আয়না, ফাইম্মা তারাইন্না মিনাল বাশারি আহাদা, ফাকুলী ইন্নি নাযারতু লিররহমানি সওম- সুতরাং আহার করো, পান করো ও চোখ জুড়াও। কোন মানুষকে দেখলে তুমি বলবে : আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতা অবলম্বনের (সওমের) মানত করেছি। (সূরা মরিয়াম : আয়াত ২৬)। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্য শাবানে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট সিয়াম বিধান নাজিল হয় এবং তাতে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় এই সিয়াম পালন করতে হবে রমাদান মাসে। এই বিধান নাজিল হওয়ার প্রায় ৭ মাস পূর্বে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম মদিনায় হিজরত করে এসে জানলেন যে, মদিনার ইয়াহুদীরা আশুরার সিয়াম পালন করে। হযরত মূসা (আ.) ফেরাউনের কবল থেকে আল্লাহর রহমতে তার কওমের সমস্ত লোককে উদ্ধার করে দরিয়া পাড়ি দেয়ায় শোকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য এই সিয়াম পালন করতেন। প্রিয়নবী (সা) তা অবগত হয়ে ১০ মহরম আশুরার সিয়াম পালন করেন, তাঁর অনুসরণের সাহাবায়ে কেরামও এদিন সিয়াম রেখেছিলেন। আল্লাহ্্র তরফ থেকে সিয়াম বিধান পেয়ে রমাদানের সিয়াম পালন করা শুরু হলো। আশুরার সিয়াম নফল সিয়াম হিসেবে রয়ে গেল। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্য শাবানে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সিয়াম বিধান নাজিল করলেন। ইরশাদ হলো : ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ! তোমাদের জন্য সিয়াম বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যাতে তোমরা তাকওয়া হাসিল করতে পার। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। এই সিয়াম বিধানে এমন কতকগুলো শিথিল ব্যবস্থা দেয়া হলো যা মুসাফির, পীড়িত ব্যক্তি এবং অতিশয় কষ্ট হয় এমন ব্যক্তির জন্য যা সহজ হয়ে গেল। আগেকার যমানায় দিনের পর দিন যে লাগাতার পানাহার বর্জন কিংবা এক রাত থেকে আরেক রাত পর্যন্ত পানাহার বর্জন ইত্যাদি ছিল তা আর থাকল না। ফলে এই সিয়াম দৈহিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে সহায়ক হলো। সিয়াম বিধান দিয়ে আল্লাহ্ জাল¬া শানুহু ইরশাদ করেন : যারা এই মাস (রমাদান মাস) পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ পীড়িত থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশতর তা চান না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরাম সিয়াম বিধান বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংখ্যায় প্রাপ্ত হয়েছিলেন। হযরত ইবরাহীম (আ), হযরত মূসা (আ), হযরত দাউদ (আ), হযরত ঈসা (আ) প্রমুখ যে বিভিন্ন সময় সিয়াম রেখেছেন তা জানা যায়। হযরত ইব্রাহীম ‘আলায়হিস্ সালাম নানা উপলক্ষে সিয়াম পালন করতেন। হযরত মূসা ‘আলায়হিস্ সালাম ফেরাউনের খপ্পর থেকে বনী ইসরাইলকে (ইসরাইল বংশীয় হাজার হাজার লোক) উদ্ধার করে লোহিত দরিয়ার ওপারে আল্লাহর রহমতে পাড়ি দিতে সমর্থ হয়েছিলেন, যে কারণে তিনি সেই পাড়ি দেয়ার দিনটিতে সিয়াম পালন করতেন। সেদিন ছিল আশুরা, ইয়াহুদীরা এদিন সিয়াম পালন করে আসছিল। এ ছাড়াও হযরত মূসা ‘আলায়হিস্ সালাম ৪০ দিন তূর পাহাড়ে লাগাতার ইতিকাফসহ সিয়াম পালন করার পর ৬ রমাদান বেশ কয়েকবার পাথরের ফলকে উৎকীর্ণ অবস্থায় তাওরাত কিতাব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আর আমি মূসার জন্য ত্রিশ রাত্রি নির্ধারিত করি এবং আরও দশ দ্বারা তা পূর্ণ করি। এভাবে তার রবের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাত্রিতে পূর্ণ হয়। (সূরা আরাফ : আয়াত ১৪২)। সওম বা সিয়ামকে সাধারণ উপবাস বা উপোস কিংবা অনশনের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাবধানী, সংযমী জীবন হাসিল করা, তাকওয়া অর্জন করা। পারস্যে যরুস্ত্রুদের মধ্যে রোজা পালন রীতি চালু ছিল ব্যাপকভাবে। তারা রোজা বা উপবাস পালন করত নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী। এমনকি পঞ্চবার্ষিকী উপবাস রীতিও তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। পঞ্চবার্ষিকী উপবাস বা রোজা পালন করতেন ওই ধর্মের পুরোহিতগণ বা সাধু-সন্তরা। খ্রিস্টধর্মে বর্তমানকালে উপবাসরীতি তেমন একটা না থাকলেও এর প্রবর্তক যিশু একনাগাড়ে ৪০ দিন উপবাসের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছিলেন এবং তিনি প্রায়শ্চিত্ত দিবসেও ফাস্টিং (উপবাস) পালন করতেন সাচ্চা ইয়াহুদীদের মতো তার অনুসারীদেরও তিনি এই ফাস্টিং পালন করার নির্দেশন দেন। তিনি তার অনুসারীদের বলতেন ‘ডযবহ ঃযধড়ঁ ভধংঃবংঃ, ধহড়রহঃ ঃযরহব যবধফ, ধহফ ধিংয ঃযু ভধপব -যখন তুমি উপবাস থাকলে তখন তোমার মস্তক তেল মেখে পবিত্র করবে এবং তোমার মুখম-ল ধৌত করবে। (মথি, ৬ : ১৭)। হযরত দাউদ ‘আলায়হিস্ সালাম তার এক শিশুপুত্রের রোগ মুক্তির জন্য লাগাতার ৭ দিন উপবাস ছিলেন। বুখারী শরীফে আছে হযরত দাউদ ‘আলায়হিস্ সালাম একদিন পর পর সিয়াম পালন করতেন, এই সিয়ামকে দাউদী সিয়াম বলা হয়। ইয়াহুদীরা উপবাস পালন করে কৃতজ্ঞতার নিদর্শনরূপে অবশ্য তার সঙ্গে পরবর্তীকালে আত্মভর্ৎসনা ও অনুশোচনার ধারণা যুক্ত হয় তাদের এই উপবাস তারা উপবাস দিবসও পালন করে। খ্রীস্টানদের উপবাস হচ্ছে অনুশোচনা ও প্রায়শ্চিত্তের নিদর্শন। তাদের এই উপবাস হচ্ছে বিশুদ্ধ উপাস্যের ক্রোধ প্রশমনের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায়। খ্রীস্টানদের মধ্যে স্বেচ্ছায় রিপু দমনের যে প্রবণতা রয়েছে তা ক্ষেত্রবিশেষে মানসিক ও দৈহিক শক্তি ধ্বংস করার শামিল এবং তাকে অস্বাভাবিক সন্ন্যাসবাদ বললেও অত্যুক্তি হবে না। হিন্দুধর্মেও উপবাস রীতি চালু আছে একাদশীতে কিংবা সংক্রান্তিতে। তবে তাদের এই উপবাস আগুন সংস্পর্শবিহীন অন্যান্য সামগ্রী পানাহার করার অনুমতি রয়েছে। বুদ্ধের সাধনাকালের ইতিহাসে দেখা যায় তিনি পানাহার বর্জন করে দীর্ঘকাল ধ্যানমগ্ন অবস্থায় ছিলেন। যার ফলে তিনি কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিলেন। সব জাতির মধ্যে সেই প্রাচীনকাল থেকেই উপবাস পালন করার রীতি চালু আছে, কিন্তু কালের চক্রে আবর্তিত হতে হতে অনেক ক্ষেত্রেই তা তার প্রকৃত রীতির ওপর অটল থাকেনি। তাতে অনুশোচনা ও অনুতাপ সংযোজিত হয়েছে। রমাদানের সিয়াম পরিচ্ছন্নতার সৌরভে সুরভিত এক অনন্য ব্যবস্থা। মূলত সিয়াম হচ্ছে সংযমী জীবন গড়ে তোলার জন্য এক মাসব্যাপী কার্যকর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : মান লাম্ ইয়াদা কাওলায্ যুরি ওয়াল্ আমালা বিহি ফালায়সা লিল্লাহি হাজাতুন্ ফী আন্ ইদা’আ ত’আমাহু ওয়া শারাবাহু- যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা এবং তদানুযায়ী আমল করা বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারী শরীফ)। সওম বা সিয়াম শুধু উপবাসের মতো পানাহার ত্যাগ করা বা অনশন নয়। সিয়াম সায়িম সত্তাকে আত্মোপলব্ধির প্রক্রিয়ায় এনে হাতেনাতে দেহ-মনে বাস্তব প্রতিফলনের মাধ্যমে আল্লাহর কুর্বত (নৈকট্য) লাভের মহাসুযোগ করে দেয়, যার ফলে সায়িমের মধ্যে আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়, সে মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হয়। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সিয়ামকে ঢালের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন : সিয়াম হচ্ছে ঢাল, সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কর্ম করবে না। কেউ যদি ঝগড়া করতে চায়, গালি দেয় তাহলে বলবে : আমি সায়িম, আমি সায়িম। ঢাল যেমন শত্রুর মারণাস্ত্র থেকে হেফাজত করে তেমনি সিয়াম পাপ-পঙ্কিলতার খপ্পর থেকে সিয়াম পালনকারীকে হেফাজত করে। সিয়াম পালনকারী বা সায়িমের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্বের ও সহিঞ্চুতার উন্মেষ ঘটে এবং সে পরিচ্ছন্ন জীবন-জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে যায়, সে আলোকিত মানুষে পরিণত হওয়ার প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে। সিয়াম পালনের মধ্য দিয়ে সায়িম আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধে যেমন বলীয়ান হতে পারে তেমনি সামাজিক মূল্যবোধও লাভ করতে পারে। মাহে রমাদানুল মুবারকের এক মাস সিয়াম পালনকারী বা সায়িম যে আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম, মানবিকতা প্রভৃতির প্রশিক্ষণ প্রত্যক্ষ অনুশীলনের মাধ্যমে লাভ করে তার প্রতিফলন রমাদান উত্তর বাকি এগারো মাস যদি সমানভাবে ঘটে তা হলেই একটি সুখী-সুন্দর পৃথিবী গড়ে উঠতে পারে। মাহে রমাদানুল মুবারকের সিয়াম সায়িমের ভেতরকার সমস্ত খাদ পুড়িয়ে একটি নিখাদ মানবসত্তা গড়ে তোলে। আর এখানেই সিয়াম আর উপবাসের মধ্যে পার্থক্য নিহিত রয়েছে। সিয়াম পালনকারীকে কুরআন মজিদে আর একটি বিশেষ অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে আর তা হচ্ছে সায়িহ্। এর অর্থ রুহানি পথিক। সূরা তওবার ১১২ নম্বর আয়াতে কারিমায় সায়িম বা সায়িহ্র বিশেষ সুসংবাদ রয়েছে। ইলমে তাসাওউফ চর্চা করলে এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা যাবে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর
×