ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

ব্যাংকের ৬২ হাজার কোটি টাকা আটকা রিট মামলায়, উদ্ধার করুন

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১ জুন ২০১৮

ব্যাংকের ৬২ হাজার কোটি টাকা আটকা রিট মামলায়, উদ্ধার করুন

রাজস্ব আদায় ও তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের ‘ভাব’ বোঝা দায়! যেখানে রাজস্বের ছড়াছড়ি সেখানে সরকার হাত দেয় না, বিপরীতে যেখানে বিন্দু পরিমাণ রাজস্ব আছে সেখানে হাত বসায়। একটা উদাহরণ দিই। সারাদেশে কয়টা দৈনিক অথবা সাপ্তাহিক কাগজ আছে যাতে লিখলে ‘সম্মানী’ পায় লেখকরা? দেশে ‘সম্মানী’ পাওয়া কলাম লেখক কতজন? একদম আঙ্গুলে গোনা হিসাব। বছর শেষে সেই ‘সম্মানী’ থেকে উৎসে কাটা আয়করের পরিমাণ কত হতে পারে? আমার কাছে হিসাব নেই। তবে চোখ বুজে বলতে পারি এর পরিমাণ হবে যৎসামান্য। দেখা যাচ্ছে যৎসামান্য হলেও এর ওপর ১০ শতাংশ হারে আয়কর উৎসে কেটে নেয়া হচ্ছে অগ্রিম হিসাবে। এতে কী কোন লেখক, কলাম লেখক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক আপত্তি করেছে? না কেউ করেনি। তবে অনেক প্রশ্ন আছে, মানুষের মনে ক্ষোভ আছে। কেন? কেন, বলছি। কাগজে লেখলাম ৬২ হাজার কোটি টাকা আটকা পড়েছে প্রায় ৬ হাজার মামলায়। এগুলো ব্যাংকের পাওনা টাকা। প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতা, বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, ব্যাংক মালিকরা এবং এই শ্রেণীর লোকেরা হাইকোর্টে রিট করে পাওনা টাকা আটকে রেখেছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী চিঠি লিখেছেন আইনমন্ত্রীর কাছে। হাইকোর্টে বিশেষ ‘বেঞ্চ’ করতে যাতে ব্যাংকের রিট মামলাগুলোর ত্বরিত নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তি হলে কী হবে? পুরো টাকাটাই ব্যাংকের ‘প্রফিটে’ যাবে। আমি নিশ্চিত এই ৬২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে কমপক্ষে অর্ধেক টাকার মালিক সরকারী ব্যাংক। মামলা নিষ্পত্তি হলে টাকাগুলো যাবে ‘প্রফিটে’। কারণ পুরো টাকাটাই রাখা আছে ‘প্রভিশন’ হিসাবে। এবার আসুন প্রশ্নে। লেখকদের কাছ থেকে বছরে পাঁচ-সাত-দশ কোটি টাকা আদায়ে এত পারদর্শিতা দেখাতে পারলে সরকার একটা ‘বেঞ্চ’ করতে পারদর্শিতা দেখাতে পারছে না কেন? অর্থমন্ত্রীর চিঠি লিখতে হবে কেন? প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে মামলা জটের কথা, বিশেষ করে ব্যাংকের মামলা জটের কথা। হাজার হাজার কোটি টাকা আটকা। আইনমন্ত্রী কী করলেন? তিনি তো অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, তিনি জনস্বার্থে, সরকারের স্বার্থে, মামলায় প্রধানমন্ত্রীর সুনাম রক্ষার্থে পারলেন না একটা বিশেষ ‘বেঞ্চের’ ব্যবস্থা করতে? শুনেছি, এ ব্যাপারে নাকি বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বহুবার চিঠি লেখা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। গত ৮-৯ বছরেও কী কোন ব্যবস্থা নেয়া গেল না? এসব প্রশ্নের কোন জবাব নেই। আর জবাব কে দেবে? যিনি অর্থ সমস্যার জবাব দেবেন সেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকেই দেখছি হতাশা ব্যক্ত করতে। সোমবার ঢাকায় একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাতে অর্থমন্ত্রী প্রধান অতিথি ছিলেন। সেই আলোচনা সভায় অনেক কথাই নাকি হয়েছে। সব কথা জানি না। তবে কাগজের খবর পড়ে মনে হচ্ছে অর্থমন্ত্রী অনেক ব্যাপারেই হতাশ। যেমন তিনি বলছেন, ‘বিদেশে টাকা পাচার হলেও তেমন কিছু করার নেই তার।’ তিনি বলছেন, ‘এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালকের জন্যও ঋণ অনুমোদন করেন।’ কিছু ব্যাংক একীভূত করার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু তা হয়নি। কালো টাকা বিনিয়োগের ইচ্ছা নেই তার। ‘এই টাকা যদি পাচার হয়ে যায় যাক, কী আর করা?’ ‘সক্ষমতা’ নিয়ে তিনি বলেন, অনেক পরিকল্পনা তিনি করেছেন, কিন্তু কিছু করা যায়নি। সরকারী সংস্থাগুলোর দায় কমছেই না। এগুলোকে এখনও টাকা দিতে হয়। এ ধরনের অনেক কথাই তিনি বলেছেন যাতে স্পষ্টতই ‘হতাশার’ একটা সুর আছে। এখন প্রশ্ন, যেসব বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর হতাশা সেসব বিষয়ে তো সমাধান দরকার। দীর্ঘদিনের এত প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী যদি অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাতের মৌল সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে হতাশা দেখান তাহলে এমন কে আছে যিনি এসব জটিল সমস্যার সমাধান করবেন? এটা শুধুই প্রশ্ন, আমার কাছে কোন জবাব নেই। এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেন এটা তো ‘বহুত’ পুরনো কথা। আমাদের ব্যাংকের মালিকরা প্রায় সবাই রাজনীতিবিদ-কাম-ব্যবসায়ী। তাদের অনেকেই ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের টাকায় ব্যাংক করেছেন। এর উদাহরণ ভূরি ভূরি। যেহেতু তারা ব্যবসায়ী কাজেই তাদের ঋণ দরকার। ঋণ পাওয়া তাদের অধিকারও। একজন ব্যাংক পরিচালক কিভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নেবেন তার নিয়ম-কানুন আছে। এসব নিয়ম কানুন বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক মালিকরা কী সেসব নিয়ম-কানুন না মেনে ঋণ নিচ্ছেন? যদি তাই হয় তাহলে তা গর্হিত অন্যায়। এর বিচার আছে। এই বিচারও করতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক পরিচালনা, ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক প্রশাসন, সুশাসন ইত্যাদি কায়েম রাখার জন্য এই ব্যাংককে অফুরন্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ব্যাংক-পরিচালকদের’ ব্যাংক থেকে বহিষ্কার করতে পারে। ওইসব ব্যাংকের বোর্ড বাতিল করতে পারে। এসব তো অর্থমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে। তবে কী পরিস্থিতি এমন যে, ব্যাংক পরিচালকরা এখন সর্বেসর্বা হয়ে গেছেন? একটি কাগজের রিপোর্টে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। গত এক বছরের মধ্যে বেসরকারী ব্যাংকের মালিকরা নানা ধরনের সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে করিয়ে নিয়েছেন। একটি দুইটি সিদ্ধান্ত নয়, ডজন খানেক সিদ্ধান্ত। দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারী ব্যাংক মালিকদের হুকুমমতো কাজ করছে। পরিস্থিতি এমন দ-ায়মান যে, ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি’ বড় হয়ে গেছে। যেখানে ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করছে ব্যাংক মালিকরা। দোষের কিছু ছিল না যদি তা দেশের উপকারে হতো। তবে স্পষ্টই তা নয়। অর্থমন্ত্রী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, রাজস্ব নিয়ে যে সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। বলছিলাম যেখানে রাজস্ব আছে, রাজস্বের সম্ভাবনা আছে সেখানে সরকার যেতে পারছে না, সরকার দৌড়াচ্ছে রাজস্বের চারদিকে। রাজস্বের ‘ডিপো’ বন্ডেড ওয়ারহাউস। এখান থেকে মাল নিয়ে খোলা বাজারে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে দিচ্ছে। কর ফাঁকির ঘটনা ঘটছে। তাই যদি হবে তবে এর ওপর কর বসানো ও আদায় করা হোক। এক হিসাবে দেখা যায় এই উৎস থেকে কমপক্ষে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসতে পারে। আর না হয়, বন্ডেড ওয়ারহাউস থেকে মাল যাতে খোলা বাজারে না আসতে পারে তার ব্যবস্থা করা হোক। বোঝাই যায়, এই আমদানি করা কাপড় পোশাক মালিকদের লাগে না। তারা বেশি বেশি আমদানি করেছেন খোলা বাজারে বিক্রি করে লাভবান হওয়ার জন্য। পোশাক মালিকদের এই বেআইনী কাজ বন্ধ করতে পারলে আমার ধারণা ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকার আমদানি হ্রাস করানো যায়। হিসাব খুবই সোজা। পোশাক তৈরিতে কাপড় লাগে না বলেই তারা তা বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছে। এই লিকেজ বন্ধ করতে পারলে সরকারের চারদিক থেকে লাভ। আমদানি বিল কম হবে। দেশীয় শিল্পের বাজার সুরক্ষিত হবে, ডলারের ওপর চাপ কমবে। সর্বোপরি ফের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। দ্বিতীয় যে খাতটির ওপর নজর দেয়া উচিত তা হচ্ছে ‘ভ্যাট’। প্রতিদিন কাগজে কোন না কোন কোম্পানির ভ্যাট ফাঁকির খবর ছাপা হচ্ছে। আমি কিছুদিন হিসাব রেখেছিলাম। শেষ পর্যন্ত দেখলাম আমার এই কাজ অহেতুক। প্রশ্ন কোন কোম্পানি, প্রতিষ্ঠান ভ্যাট ফাঁকি দেয় না? আমাকে একজন প্রাক্তন ভ্যাট কর্মকর্তা বলেছেন, এই মুহূর্তে ভ্যাট খাত থেকে কমপক্ষে এক লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব। এর জন্য দরকার অবকাঠামো এবং সরকারী সদিচ্ছা আর দরকার রাজস্ব আদায়কারী কর্মকর্তা যারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবে। অথচ দেখা যাচ্ছে এই কাজটিই হচ্ছে না। এটা না পেরে সরকার ঝুঁকেছে উৎসে কর কাটার কার্যক্রমে। এটা মন্দ নয়। নিশ্চিত আদায় সম্ভব এতে। আদায়কারী লাগে কম। অর্থাৎ আদায় খরচ কম। যদি এটাই আমাদের নিয়তি হয় তাহলে আয়করের দিকে এত নজর কেন? আয়করের ক্ষেত্রে দেখা যায় চাকরিজীবীরাই বন্দী। কী সরকারী, কী বেসরকারী তাদের আয় হিসাবের মধ্যে আছে। তাদের অফিস আছে। তাদের কাছ থেকে উৎসেই কর কেটে নেয়া যায়। তাই তারাই হচ্ছে আয়করের শিকার। অথচ দোকানি, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, মুদি ব্যবসায়ী, মিষ্টি দোকানদার থেকে শুরু করে হরেক প্রকারের লাখ লাখ লোক আয়করের আওতায় নেই। কৃষি খাত আয়করের বাইরে। ধনীরা আয়করের বাইরে। কোম্পানিওয়ালাদের চার্টার্ড এ্যাকাউন্টে আছে। কয়েক লাখ বিদেশী এ দেশে কাজ করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে ট্যাক্স দিচ্ছে না। এরপরে আয়করের অর্থ কর্তাসহ চাকরিজীবী কিছুসংখ্যক লোকের ওপরই আয়করের যত চাপ। এতে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। আয়করের বাইরে রাজস্বের অনেক উপায় আছে। বিকল্প শত শত। দুঃখের বিষয আমাদের অর্থনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারকরা এসব বিষয়ে ভাবতে রাজি নয়। তাদের সামনে গতানুগতিক যত পথ। আয়কর যে একটা আইন যার মূলত কোন সংস্কারই হয়নি এই কথাটিই আমরা বলছি না। আয়কর ব্যবস্থা রাখতে হলে সুশাসন ও ন্যায্যতার খাতিরে তা সকলের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। দেখলাম একজন প্রাক্তন সচিব বলেছেন, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র আছে তাদেরই আয়কর দিতে হবে। এর জন্য আলাদা টিআইএনের দরকার নেই। এটা উত্তম প্রস্তাব! বর্তমানে করমুক্ত একটা আয়সীমা আছে। এর আওতায় পড়ে লাখ লাখ লোক। তাদের কাছ থেকেই আয়কর আদায় করা যাচ্ছে না। আর প্রাক্তন প্রভাবশালী সচিব বলছেন, ১৮ কোটি লোকেরই কর দিতে হবে। কারণ জাতীয় পরিচয়পত্র তো সবারই থাকতে হবে। তাই নয় কি? আমি বরং উল্টো একটা সম্ভাবনার কথা বলি। তাকে বলি প্রতিবেশী দেশের একটা বিতর্ক আমলে নিতে। সেখানকার ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’ আয়কর তুলে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে খবরে দেখছি। তাকে এসব বিষয়ে বিতর্ক করতে অনুরোধ করব। মূল কথা রাজস্ব বৃদ্ধি। আয়কর, অর্থাৎ ব্যক্তিগত আয়কর তুলে দিয়েও যে রাজস্ব বৃদ্ধি করা যায় সেদিকে নজর দেয়া দরকার। এতে সঞ্চয় বাড়বে। বাজার সম্প্রসারিত হবে। ভয়ভীতি মুক্ত হবে অগণিত লোক। জিডিপি বাড়বে দ্রুতগতিতে। সরকার রাজস্ব পাবে বেশি বেশি। লেখক : প্রাক্তন শিক্ষক, ঢাবি
×