ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ট্রাফিক আইন মেনে চলা, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি উচ্ছেদ ও ট্রাফিক ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ থাকবে

বাজেটে গণপরিবহন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হবে

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৩১ মে ২০১৮

বাজেটে গণপরিবহন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হবে

এম শাহজাহান ॥ ঢাকার যানজট নিরসনে গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়িয়ে সেবার মান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে। এক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে তাতে শুল্ক বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। স্বতন্ত্র মেট্রোপলিটন যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ গঠনের ঘোষণা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নিবে সরকার। রাজধানীর যানজট নিরসনে কঠোরভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলা, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি রাস্তা থেকে উচ্ছেদ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হবে। এছাড়া নারী, সিনিয়র সিটিজেন, মুক্তিযোদ্ধা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক বাস সার্ভিস চালুসহ গণপরিবহনে বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত সিট রাখা হবে। কর্মজীবী নারীরা যাতে সময়মতো অফিসে পৌঁছাতে ও ছুটির পর নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারেন সেজন্য পরিবহনের সংখ্যা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হবে আসন্ন বাজেটে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, ঢাকা মহানগরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহরের যানজট নিরসনে আগামী বাজেট ঘোষণার পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ শুরু করা হবে। প্রতিনিয়ত খানাখন্দ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ঢাকার যানজট এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ঈদ সামনে রেখে তীব্র যানজটে নাকাল নগরবাসী। শুধু তাই নয়, যানজটের কারণে রোগীর এ্যাম্বুলেন্স সময়মতো পৌঁছাতে পারে না হাসপাতালে। কর্মজীবী নারী-পুরুষ ঠিক সময়ে অফিসে হাজির হতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। এমনকি যারা পরিবহন সেবা দিচ্ছেন তারা যানবাহন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় পার করে দিচ্ছেন। যানজটের মুখে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী সঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এই বাস্তবতায় দেশের প্রধান সমস্যাগুলোর অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে যানজট সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যা নিরসনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বাজেটে কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকেন। সেই পরিকল্পনার আওতায় ইতোমধ্যে ঢাকায় একাধিক ফ্লাইওভার নির্মাণ, মেট্রোরেলের কাজ শুরু এবং সড়কে গণপরিবহন বাড়ানোর মতো কর্মসূচী রয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি ফ্লাইওভার চালু করা হলেও যানজট নিরসন তেমন কমেনি; বরং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যানজট নিরসনে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যানজট নিরসনে এজন্য একটি স্বতন্ত্র মেট্রোপলিটন যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন, যানজট নিরসনে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, পরিকল্পনা প্রণয়ন, যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, যানবাহনের লাইসেন্সিং ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের পরিচালনায় সমন্বয় সাধন এবং একই সঙ্গে উড়াল সেতু বা পাতাল রেল স্থাপনের মধ্যে সমন্বয়সাধন হতে এ কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্ব। আশা করা যায় যে, আগামী অর্থবছরের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর করা সম্ভব হবে। সরকারী উদ্যোগে ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরের যানজট নিরসনে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) এর ডিপো নির্মাণের পূর্ত কাজ শুরু করা হয়েছে। শুরু হবে ডেডিকেটেড লেন নির্মাণের কাজ। এছাড়া স্ট্র্যাটিজিক ট্রানসপোর্ট প্লান হাল নাগাদ করে এর আওতায় ৩ স্তর বিশিষ্ট সার্কুলার রুট, ৫টি এমআরটি লাইন ও ২টি বিআরটি লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়া গণপরিবহন ব্যবস্থায় স্বাচ্ছন্দ্য আনার লক্ষ্যে বিআরটিসি বহরে ৬০০টি বাস ও ৫০০টি ট্রাক সংগ্রহের যে পদক্ষেপ রয়েছে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে আগামী বাজেটে। ঢাকার পাশাপাশি যানজট নিরসনে চট্টগ্রাম সিটিকে আউটার রিং রোড, ইউলুপ ও ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলমান কাজ অব্যাহত রাখা হবে। এছাড়া লালখান বাজার হতে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগও সরকারের পক্ষ থেকে গ্রহণ করা হয়েেেছ। জানা গেছে, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি বিভাগীয় শহরের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি অন্যতম আলোচিত বিষয় হচ্ছে যানজট। যানজটের কারণে নগরবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, যানজটে ঢাকা সিটিতে বছরে আর্থিক হিসাবে ৩২ হাজার কোটি টাকার কর্মঘণ্টা ক্ষতি হয়। এ হিসাবে প্রতিদিন ৮৭ কোটি ৬৭ লাখ ১২ হাজার টাকা আর ঘণ্টা হিসেবে প্রতি ঘণ্টায় ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৬৫ লাখ ২৯ হাজার টাকা। সংস্থাটির ওই গবেষণায় ২৩টি বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় যাত্রীদের কাছ থেকে। যাত্রীদের ৮৬ শতাংশ তাদের বাসযাত্রার অভিজ্ঞতার কথা খারাপ উল্লেখ করে তা উন্নত করার কথা বলেছেন। গণপরিবহন বাড়িয়ে টিকিটিং সিস্টেম আরও উন্নত করার তাগিদ দিয়েছেন তারা। এদিকে ঢাকার যানজট নিরসনে পূর্বাচল জলসিঁড়ি এলাকায় নবনির্মিতব্য মহানগরসহ রাজধানী ঢাকা এবং এর নিকটস্থ নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী এলাকার যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য মনে করা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহানগরের যানজটের কারণ শুধু রাস্তা বা উড়াল সেতুর অভাবই নয় যানজট নিয়ন্ত্রণ নিরসনে পরিকল্পিত এবং সমন্বিত ব্যবস্থার দুর্বলতাও এর অন্যতম কারণ। শুধু তাই নয়, যানজট নিরসনে কয়েকটি আইনী কাঠামোর হালনাগাদ করা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনী কাঠামো হালনাগাদ করার লক্ষ্যে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) আইন ২০১৬, সড়ক পরিবহন আইন ২০১৬, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৬ মেট্রোরেল বিধিমালা ২০১৬। এসব আইন প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কাগজপত্রে ঢাকায় প্রায় ১৩ লাখ রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পরিবহনের মধ্যে গণপরিবহনের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৬৫ হাজার। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস-মিনিবাস, অটোরিক্সা, টেক্সি, হিউম্যান হলার মিলিয়ে সড়কে ১৫ হাজারের বেশি গণপরিবহন নেই। যদিও ঢাকার দুই কোটির বেশি মানুষের এ শহরে প্রয়োজন অন্তত ২০ হাজার সচল বাসসহ লাখের বেশি গণপরিবহন। অথচ প্রায় তিনলাখ প্রাইভেটকার চলছে রাজধানীতে। দিন দিন ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। এছাড়া প্রাইভেটকার নিয়ন্ত্রণ আইন করার চেষ্টা করছে সরকার। গত বাজেটে ব্যক্তিগত ব্যবহারে একাধিক গাড়ির জন্য বিদ্যমানের চেয়ে শতকরা ৫০ ভাগ বেশি কর পরিশোধের প্রস্তাব করা হয়। এতে নতুন গাড়ি কিনলে বিদ্যমানের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি কর দিতে হচ্ছে। বর্তমানে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহারে কড়াকড়ি নীতি আরোপ করেছে এনবিআর। কোন প্রতিষ্ঠান তার পরিশোধিত মূলধনের ১০ ভাগের বেশি টাকা গাড়ি কেনায় খরচ করতে পারবে না। নির্ধারিত পরিশোধিত মূলধনের বেশি খরচ করলে ওই কোম্পানিকে বিদ্যমানের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি কর দিতে হবে। প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আগামী বাজেটে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে।
×