ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঈদের কেনাকাটা

ফেসবুক পেজে ছবি দেখে পণ্য বাছাই, দু’একদিনের মধ্যে হোম ডেলিভারি

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৩১ মে ২০১৮

ফেসবুক পেজে ছবি দেখে পণ্য বাছাই, দু’একদিনের মধ্যে হোম ডেলিভারি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘ঈদ উপলক্ষে বেশিরভাগ পণ্যই এবার অনলাইনে অর্ডার দিয়ে কিনেছি। বর্তমানে অনলাইনে কেনাকেটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। হাতের নাগালে প্রয়োজনীয় পণ্য-সামগ্রী পেলে আর কষ্ট করে মার্কেট ঘুরে সময় নষ্ট করতে হয় না।’ কথাগুলো বলছিলেন আফিরনা হোসাইন নামের এক ক্রেতা। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে ফেসবুক পেজে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন পণ্যের ছবি দেখে সহজেই পছন্দেরটি বেছে নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া পণ্য অর্ডার দেয়ার দু’একদিনের মধ্যেই হোম ডেলিভারির মাধ্যমে হাতে এসে যাচ্ছে। এতে যেমন সময়টা বেঁচে যাচ্ছে ঠিক তেমনি ঘুরে ঘুরে শপিং করার কষ্ট লাঘব হচ্ছে।’ রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে ঈদ উপলক্ষে দেশী-বিদেশী সব পোশাকে সাজানো দোকান থাকলেও ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইটের ঈদ বাজারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন অনেক উদ্যোক্তা, অনলাইন থেকেই বেশি ক্রেতা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। অপরদিকে আফরিনার মতো অনলাইনে কেনাকাটা করা কয়েকজন বলছেন, সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর ঢাকার যানজট ঠেলে মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটার চেয়ে বিশ্বস্ত ফেসবুক পেজগুলোতে পোশাকের ছবি দেখে কোন ঝামেলা ছাড়াই কিনতে পারছেন তারা। এবারের ঈদে অনলাইন ক্রেতারা দেশী তাঁতে বোনা শাড়ি, থ্রি পিসের পাশাপাশি জর্জেট কিংবা সিল্কের কাপড়ের ওপর কাজ করা থ্রি-পিস, গাউন, গজ কাপড় ও গহনার দিকে বেশি ঝুঁকছেন বলেও জানিয়েছেন কয়েকজন উদ্যোক্তা, যাদের নিজেদের দোকানের পাশাপাশি অনলাইনে রয়েছে লাখের বেশি ক্রেতা। শুধু নারীদের জন্যই নয় পুরুষদের জন্য এমনকি শিশুদের পোশাক, জুতাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই এখন বিভিন্ন পেজের মাধ্যমে ফেসবুকে অর্ডার দেয়া যাচ্ছে। দেশী সিল্ক, জামদানি, কাতান ও মনিপুরী শাড়ির জন্য জনপ্রিয় পেজ ‘নন্দিনী’ গতবছর মিরপুরের শামীম সরণির অনামিকা কনকর্ড শপিং সেন্টারে তাদের দোকান খোলে। নন্দিনীর উদ্যোক্তা ঊর্মী রুবিনা জনকণ্ঠকে জানান, ‘ শুধু ঈদ নয় বরং পহেলা বৈশাখসহ অন্যান্য সময়েও আমরা ক্রেতাদের সাড়া পাই। রোজার আগে থেকেই পেজে ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। দোকানেও ক্রেতা আসছেন পেজ দেখেই। তিনি আরও বলেন, ‘ফেসবুক পেজে ক্রেতাদের আগ্রহ দেখেই মূলত শো-রুম নেয়ার সাহস জুগিয়েছি। ঈদের কেনাকাটায় বেশি বিক্রি মূলত পেজেই হয়। ঘরে বসেই যখন মানুষ ৫০০ শাড়ির ছবি দেখে একটি পছন্দ করতে পারছেন, এই সহজ কেনাকাটাই মানুষকে অনলাইনে বেশি আগ্রহী করে তুলেছে। সেইসঙ্গে অনলাইন মার্কেটিংয়ে বিশ্বস্ততা মূলে। আমার পণ্য পেয়ে যদি ক্রেতা সন্তুষ্ট না হয় তবে কিন্তু আমি পরবর্তীতে তার কাছ থেকে কোন অর্ডার পাব না। কিন্তু আমার পণ্য হাতে পেয়ে ক্রেতারা ইনবক্স করে জানিয়ে দেন যে শাড়িটি খুব সুন্দর। পরবর্তীতে তারা অনেকবার অর্ডার দিয়েছেন।’ তিনি জানান, গত ঈদের চেয়ে এবার তাদের শাড়ির আয়োজন বেড়েছে। বিক্রিও হচ্ছে বেশি। ‘ফিউশন বাই চৈতী’ নামক ফেসবুক পেজের কর্ণধার আয়েশা চৈতী। নিজের ডিজাইন করা ব্লক-বাটিক ও সুতির বিভিন্ন থ্রি-পিস ও শাড়ি ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতে তার এই প্রয়াস। মাত্র এক বছর আগে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করা তার এই অনলাইন ব্যবসার পুঁজি এখন দাঁড়িয়েছে তিন লাখ টাকায়। ঈদ উপলক্ষে বরাবরই ক্রেতাদের কাছ থেকে সাড়া পান বলে জনকণ্ঠকে জানান চৈতী। তিনি বলেন, ‘ফিউশন বাই চৈতীতে মূলত সুতির ব্লক-বাটিকসহ বিভিন্ন কারুকাজ কাজ করা থ্রি পিস বিক্রি করা হয়। এখন যেহেতু গরম এজন্য অনেক থ্রি পিসে অর্ডার পেয়েছি গত তিন মাসে। ঈদ উপলক্ষে এখনও প্রচুর অর্ডার পাচ্ছি। আমার টার্গেট হলো ক্রেতাদের আগ্রহ ধরে রাখা। এজন্য কোন সময় কোন ডিজাইনটি ক্রেতারা পছন্দ করবেন এবং ড্রেসের কাপড়সহ ডিজাই কালার সব দিকেই লক্ষ্য রাখতে হয়। মূলত আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে পারলে অনলাইনেই মূল বেচাকেনাটা হয়।’ জর্জেট, সিল্ক ও বাটারফ্লাই সিল্কের ওপর সুতার এ্যাম্ব্রয়ডারি করা থ্রি-পিস বিক্রি করে ‘কালার ব্লাস্ট’ নামক পেজটি। মিরপুর-২ নম্বরের মধ্য পীরেরবাগে রয়েছে ‘কালার ব্লাস্ট’র নিজস্ব শো-রুম। এই পেজটি চালান তাপসী নামের এক উদ্যোক্তা। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে দু’মাস আগ থেকেই অর্ডার পাচ্ছি। আমরা মূলত ওয়েটলেস জর্জেট কাপড়ের ওপর এ্যাম্ব্রয়ডারি কাজ করা থ্রি পিস বিক্রি করি। যদি ক্রেতারা থ্রি-পিস নিতে চান তবে আমরা তা করে। অন্যদিকে শুধু সিঙ্গেল কামিজ বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। কারণ সালোয়ার আর ওড়নার রঙের সঙ্গে জামার কাপড়ের রং একটু উনিশ বিশ হয়ে থাকে। এজন্য অবশ্য অনেকেরই ফুল সেট নিতে আপত্তি। তারা সিঙ্গেল কামিজ অর্ডার করেন।’ ‘কালার ব্লাস্ট’ এ ৯৯৯ টাকা থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত সিঙ্গেল কামিজ পাওয়া যাবে। এই উদ্যোক্তা জানান, ‘বর্তমানে অনলাইনে অনেক পেজ রয়েছে। ক্রেতাদের হাতে অনেক অপশন। এজন্য ক্রেতা ধরে রাখতে অবশ্যই প্রত্যেকটি অনলাইনের শপের নিজস্বতা ও বিশ্বস্ততা ঠিক রাখতে হবে।’ তথ্য প্রযুক্তির এই সম্ভাবনার যুগে অনলাইন ব্যবসায় উদ্যোক্তা ক্রমাগত বাড়ছে বলে জানান বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার এ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) জনসংযোগ কর্মকর্তা বদরুদ্দোজা মাহমুদ তুহিন। তিনি জনকণ্ঠকে বললেন, ‘ই-কমার্স বর্তমানে নারী-পুরুষ সব উদ্যোক্তাদের জন্য সুফল বয়ে এনেছে। বর্তমানে বেসিসের তালিকাভুক্ত প্রায় তিন হাজার ফেসবুক পেজ আছে যার মধ্যে ধারণা করা যায় প্রায় তিন শ’ পেজ নারী উদ্যোক্তাদের। এছাড়া একহাজার অনলাইন শপিং সাইট আছে এগুলোর মধ্যে প্রায় দুশটি ওয়েবসাইট নিয়মিত চলছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক। ই-কমার্সের সুবিধা হলো- অল্প পুঁজিতে এমনকি বিনা পুঁজিতেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াই ব্যবসা করা যায়। উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি অনলাইনে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে বলে জানান তিনি। বেচাকেনার জন্য নির্দিষ্ট সাইটগুলোর পাশাপাশি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও জমে উঠেছে এই কেনাবেচা। বিশেষ করে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন পেজ। আর তা থেকেই ক্রেতারা খুঁজে নিচ্ছেন পছন্দের পণ্য। উদ্যোক্তাদের মতে, নতুনদের পাশাপাশি বিশ্বের বড় মাপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করছে ফেসবুক। অল্প পুঁজিতে, এমনকি বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায়। ব্যবসা করতে লাগে না কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ব্যবসা পরিচালনা করা যায় ঘরে বসেই। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে এ মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনলাইনে নিয়মিত কেনাকাটা করেন তানজিনা। তিনি রোজার আগেই অর্ডার করে কিনেছেন ঈদের জামা সঙ্গে জুতা ও জুয়েলারি। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান পেলে অনলাইনে কেনাকাটার বিকল্প নেই। অনলাইনে দেশী পণ্যগুলোর দাম একটু বেশি মনে হয়। তবে এখানে রাস্তার ঝক্কি নেই। আগে কিনেছি, প্রডাক্ট ভাল ছিল- এমন পেজ থেকে ঈদ শপিং করতে ভরসা পাই।’ আরেক ক্রেতা ইমরান হোসাইন জানান, ‘আমি বেশিরভাগ সময়ই অনলাইনে পণ্য পছন্দ করে অর্ডার করি। এতে সময় বাঁচে। দামে একটু হেরফের থাকতে পারে যেখানে আস্থা পাই সেখান থেকেই পরবর্তীতে কেনাকাটা করি।’ ঈদ উপলক্ষে শার্ট, পাঞ্জাবি, ঘড়ি এমনকি জুতাও তিনি অনলাইন থেকে কিনেছেন বলে জানান এই ক্রেতা। অনলাইনে অর্ডার করলে পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে বাসায়। মূল্য পরিশোধে পাওয়া যাচ্ছে ব্যাংকের সহায়তাও। অনেকেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই পরিশোধ করছেন মূল্য। ক্যাশ অন ডেলিভারি পদ্ধতিতে বা গ্রাহক পণ্য হাতে পাওয়ার পর দাম মেটানোর সুযোগও রয়েছে। তাই ক্রেডিট কার্ডে কেনার বাধ্যবাধকতা নেই। অনলাইনে কেনাকাটায় যেমন মানুষের আগ্রহ বাড়ছে ঠিক তেমনি মানুষের এখানে কেনাকেটা নিয়ে কিছুটা অসন্তোষও রয়েছে কোন কোন ক্রেতার মনে। তাসলিমা হোসেন নামের এক ক্রেতা জানান, ‘কয়েকদিন আগে এক পেজে দেয়া একটি ড্রেসের ছবি দেখে পছন্দ হওয়ায় সেটি অর্ডার করি। সেখান থেকে বলা হয়েছিল ৫০০ টাকা এ্যাডভান্স করতে হবে আর ড্রেসটি এক সপ্তাহের মধ্যে পেয়ে যাব। এ্যাডভান্স করার পরও যখন এক সপ্তাহ পর সেখান থেকে ডেলিভারির জন্য ফোন আসল না তখন আমি ফেসবুকে ইনবক্স করতে গিয়ে দেখি আমার আইডি তারা ব্লক করে দিয়েছে।’ আরেক ক্রেতা আরিফ হোসেন জানান, ‘একমাস আগে আমি একটি জিন্সের প্যান্টের অর্ডার দিয়েছিলাম। ডেলিভারির পর দেখলাম ছবির কালারের সঙ্গে নিজেরটার কোন মিল নেই। সেখানে পরবর্তীতে অভিযোগ জানানোর পরও বিষয়টি তারা অস্বীকার করেন।’ একরকম জিনিস চেয়ে অন্যরকম জিনিস পাওয়ার কথা যেমন শোনা যায় অনেকের কাছে, আবার বাসায় পণ্য ডেলিভারি নিয়ে বিড়ম্বনার কথা বললেন অনেকেই। নওরিন সুলতানা জানান, ‘জিনিসটা না আসা পর্যন্ত সারাদিন বাসায় বসে অপেক্ষা করতে হয়। এতে সময়ের অপচয় হয়।’
×