আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় জার্মানিকে উদ্বিগ্ন নাগরিক ও স্থবির রাজনীতির দেশ হিসেবে দেখা হয়। এঞ্জেলা মার্কেল হলেন ইউরোপে সবচেয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা জননেত্রী যিনি জার্মানির ঐতিহ্যগত সতর্কতার মূর্তরূপ। গত সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে চরম দক্ষিণপন্থীদের প্রতি জনসমর্থনের জোয়ার দেখা গেছে। সমগোত্রীয়দের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠন করতে এঞ্জেলার ছয় মাস সময় লেগে গিয়েছিল। রক্ষণশীল পর্যবেক্ষকদের চোখে জার্মানি হলো বল্গাহীন উদ্বাস্তু নীতির আরেক নাম। অন্যদের কাছে জার্মানি হলো এমন দেশ যা ঋণগ্রস্ত দক্ষিণ ইউরোপীয়দের উদ্দেশ্যে তর্জন গর্জন করে থাকে।
কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী বিচারে দেখলে জার্মানি কিভাবে বদলে গেছে ও যাচ্ছে তা চোখে পড়ার মতো। যুদ্ধোত্তর জার্মানির ইতিহাসে প্রায় ২৫ বছরের এক একটি চক্র অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রথমে আসে পুনর্গঠনের যুগ। পরে ১৯৬০ এর দশকের শেষ ভাগ থেকে জার্মানি বিশ্বযুদ্ধের জন্য নিজের অনুশোচনা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতে থাকে। ১৯৯০ এর দশক থেকে শুরু হয় তার সর্বশেষ অধ্যায় যেখানে জার্মানি পুনরেকত্রিত হয়, আবার স্বাভাবিক দেশ হয়ে দাঁড়ায় এবং অতীতের অনেক শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে। এখন এক নতুন অধ্যায়। শুরু হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে জার্মানি। কারণ মার্কেল অধ্যায় শেষ হতে চলেছে দেশটির অনেক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য যেমন এর জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সমস্বত্ব; প্রথানুবতির্তা সমাজগত রক্ষণশীলতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির অঙ্গনে সবেগে নিজের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠায় অনীহা সহসা দ্রুত পরিবর্তনশীল হয়ে উঠছে।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে উদ্বাস্তুদের প্রতি মার্কেলের ‘মুক্তদ্বার’ নীতি থেকে এই নীতির বদৌলতে ২০১৫-১৬ সালে জার্মানিতে ১২ লাখ নতুন অভিবাসীর আগমন ঘটে। এ থেকে নিশ্চিত হয়ে ওঠে একদা সমসত্তার দেশ জার্মানিতে এখন নানা শ্রেণী, বর্ণ, গোত্র, ধর্মের মানুষ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। জার্মানিতে এখন পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি অধিকতর লিঙ্গ ভারসাম্যমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ১৫ বছরে কর্মজীবী মহিলার সংখ্যা ৫৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭০ শতাংশ হয়েছে। জার্মানরা এখন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছে বেশি, বিবাহ করছে কম। অনেক শিল্প ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তি অবলম্বন করেছে। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অর্ধ শতাব্দীতে জার্মানি বিদেশের মাটিতে কোন সামরিক অভিযানে অংশ নেয়নি, এখন নিচ্ছে। জার্মানি মালি, আফগানিস্তান ও লিথুয়ানিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছে।
এ সব কিছু জার্মান সমাজকে নাড়া দিচ্ছে। পার্লামেন্টে নতুন প্রজন্মের অধিকতর মারমুখী চরিত্রের আইন প্রণেতাদের অভ্যুদয়, বুন্দেসটাগে অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি)-এর মতো চরম দক্ষিণপন্থী দলের আগমন এবং এঞ্জেলা মার্কেলের ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভবিষ্যত গতিপথ নিয়ে লড়াইÑ এসব কিছুই প্রমাণ করে যে জার্মানির সত্তা নিয়ে এখন জোর বিতর্ক চলছে। এই বিতর্কের ফলাফল থেকে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে। ব্যাপারটির গুরুত্ব জার্মানির সীমান্তকে ছাড়িয়ে বাইরেও অনুভূত হবে। দেশটা অধিকতর বহুত্ববাদী সমাজের উত্থানের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে যেমনটি করছে অন্যরাও। জার্মানরা মনমানসিকতায় মধ্যপন্থী এবং ইতিহাসগতভাবে তারা বাগাড়ম্বের বিপদ সম্পর্কে বিশেষভাবে স্পর্শকাতর। কিভাবে তারা দেশটিকে উত্তরণের পথ ধরে এগিয়ে নিয়ে যায় তা অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
নতুন জার্মানি পুনরেকত্রীকরণ উত্তর অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এখন তেজীভাব অর্জন করেছে। তবে ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা ভাবলে প্রগতিমুখী কিছু সংস্কার দরকার। ইন্টারনেটের সুযোগ এখনও জটিল ও মন্থর। রাস্তাঘাট ও ক্লাসরুমগুলো আশ্চর্য রকমের জীর্ণ। লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে সেবামূলক শিল্পের প্রসার সীমিত। মার্কেলের শাসনামলে অবসর গ্রহণের বয়স কারোর কারোর ক্ষেত্রে হ্রাস পেয়েছে এবং তা শীঘ্রই ফ্রান্সের চেয়েও কমে দাঁড়াবে।
এবারের নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক ৭টি দল ফেডারেল পার্লামেন্টে এসেছে। গতবারে এসেছিল ৫টি দল এবং যুদ্ধোত্তর যুগের অধিকাংশ সময়জুড়ে ছিল ৪টি দল। অর্থাৎ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়েও জার্মানরা স্বচ্ছন্দে আছে। দেশটির রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত আছে। বেকারত্বের হারও রেকর্ড নিম্নে। গত বছর বাজেটে উদ্বৃত্ত ছিল জিডিপির ১.১ শতাংশ। কিন্তু তার পরও এক ধরনের উদ্বেগ ও অস্বস্তি জার্মানদের তাড়া করে ফিরছে। বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তি জার্মান শ্রমবাজারকে শূন্যগর্ভ করে ফেলছে এবং বিত্তবান ও বিত্তহীনের মধ্যে নতুন বিভাজন সৃষ্টি করেছে। জার্মানির যাবতীয় সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি মহাশক্তিধর প্রকৌশল শিল্প নতুন প্রযুক্তি ও প্রতিযোগীদের কারণে মার খাচ্ছে। শহরাঞ্চল ও অধিকতর রক্ষণশীল শহরতলি এবং গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। মিউনিখ, কোলন ও বার্লিনের মধ্যে এখন তাদের নিজ নিজ পশ্চাদভূমির তুলনায় নিজেদের অধিকতর অভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সোজা কথায় জার্মানি যতই উন্মুক্ত হচ্ছে ততই বিভাজন বাড়ছে আর ততই উদ্বেগ ও অস্বস্তি সৃষ্টি হচ্ছে।
চলমান ডেস্ক
সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: