ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ ঈদকে আনন্দময় করতে যানজট নিরসন জরুরী

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৩০ মে ২০১৮

অভিমত ॥ ঈদকে আনন্দময় করতে যানজট নিরসন জরুরী

এটা রমজান মাস। সামনে ঈদ। যানজটের ঢাকা শহর রমজান মাসে যেন একটু বেশিই স্থবির হয়ে পড়ে। গাড়ি চলতেই চায় না। বাড়ে চুরি ছিনতাই ডাকাতিও। জনদুর্ভোগের যেন শেষ সীমা ছাড়ে। প্রতিবারের মতো এবারও তাই হয়েছে। এবার ছিনতাই ডাকাতি কমলেও, যানজট যেন একটু বেশিই মনে হচ্ছে। যানজট নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক চেষ্টা চলছে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সিগনাল বাতির কৌশলেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। একটি লক্ষণীয় যে, যানজট নিরসনের জন্য যখনই সেনাবাহিনী মাঠে নামানো হয় তখনই রাজধানী ঢাকা থেকে যানজট অনেকটা উধাও হয়ে যায়। প্রশ্ন হলোÑ সেনাবাহিনী যানজট নিরসন করতে পারে, তবে কেন ট্রাফিক পুলিশ তা পারে না? সেনাবাহিনী তো ভিন গ্রহের বাহিনী নয়। ট্রাফিক পুলিশের মতো এ সরকারের একটি বাহিনী। সে যাই হোক রোজা আর ঈদকে নির্বিঘœ করতে ঢাকার যানজট যে কোন মূল্যে কমাতে হবে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা যানজটে যেভাবে আটকে থাকে যানবাহন ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। যেহেতু তারা বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে তাই ঈদ উৎসবকে আনন্দময় করে তুলতে যানজট নিরসনে ঢাকার সেনাবাহিনী নামানো জরুরী। ঢাকাকে বলা হয় যানজটের শহর। রোজা আর ঈদ ছাড়াও বারমাসই এই শহরে যানজট লেগেই থাকে। বিশ্বের মেগাসিটিগুলোর মধ্যে ঢাকার মতো আর কোথাও বিরক্তিকর যানজটের আবির্ভাব হয় কিনা আমাদের জানা নেই। যানজটের কারণে ঢাকা আজ এক গুরুতর অসুস্থ নগরী। যাতায়াত দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে নিরবচ্ছিন্ন যানজটে। যানজট সমস্যার সমাধানের জন্য নগরীর বিভিন্ন জায়গায় ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। এত কিছুর পরও যানজট সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে কার্যকর অগ্রগতি এখনও লক্ষ্য করা যায়নি। যানজট রাজধানী ঢাকার দেড় কোটি মানুষের মেগাসিটিকে স্থবির করে দিচ্ছে। প্রতিদিন যানজটে লাখ মানুষের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। জ্বালানি অপচয় হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। রাজধানী ক্রমান্বয়ে অচল নগরীতে পরিণত হচ্ছে। জনসংখ্যার তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা এবং স্বল্পগতির অযান্ত্রিক যানবাহনের আধিক্যকে এ স্থবির অবস্থার জন্য দায়ী করা হয়। ট্রাফিক আইন না মানা, পরিকল্পনার অভাব, ফুটপাত দখল, প্রাইভেটকারের সংখ্যা স্পুটনিক গতিতে বৃদ্ধি পাওয়াও যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। তবে সম্প্রতি যানজটের কারণ হিসেবে ভাঙাচোরা রাস্তা এবং কারণে-অকারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িকেও দায়ী করা হচ্ছে। যেখানে-সেখানে পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে দোকান বসানো ইত্যাকার সমস্যা তো বহু পুরনো। কিছুতেই রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। যানজট পরিস্থিতি দিনই দিনই জটিল হচ্ছে। আসলে আমাদের দেশটার কোন গতি নেই; আছে দুর্গতি। যানজটের যে অবস্থা তাতে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ঢাকার মানুষকে মোটমাট কত বছর রাস্তায় আটকে থাকতে হয়? এক হিসাবে তা সাড়ে সাত বছর। অস্ট্রেলিয়ার যাত্রীরা যাতায়াতে সাপ্তাহিক ব্যয় করেন তিন ঘণ্টা ৩৭ মিনিট। ঢাকায় প্রতিদিনই লাগে কমপক্ষে তিন ঘণ্টা। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৬৮ বছর। এ হিসাবে দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত যাতায়াতের সময়ের আনুমানিক যোগফল হবে কমসে কম সাড়ে সাত বছর। এটা গায়েবি গজব না, মনুষ্যসৃষ্ট আজাব। এ আজাব থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমাদের যতটুকু সড়কপথ আছে তাতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে নানাবিধ পদক্ষেপ নিলে যানজট ৮০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। আমরা বিশ্বের বড় বড় শহর এমনকি হজকালীন সময় মক্কা মদিনা, অলিম্পিক গেমসহ নানা বড় আসরের সময় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সে সময় কত সহজেই না যানজট নিয়ন্ত্রণ করছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো। অলিম্পিকের মতো আসরে দিন গুনে জোড়-বেজোর নম্বরের প্রাইভেট গাড়িগুলো চলাচল করতে দিচ্ছে। একদিন জোড় সংখ্যার গাড়িগুলো রাস্তায় চলার অনুমতি পাচ্ছে তো পরদিন পাচ্ছে বেজোড় সংখ্যার গাড়িগুলো। বিশেষ মুহূর্তগুলোতে বাইরের শহরের গাড়িগুলো শহরে ঢোকার অনুমোতি পাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে পূর্ব থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে পত্র-পত্রিকায় ঘোষণা দেয়া হচ্ছে ফলে দুর্ভোগ হচ্ছে না, হচ্ছে না যানজটও। জোড়-বেজোড় গাড়িগুলো রাজধানীতে চলাচলের ক্ষেত্রে দিন গুনে চলাচল করতে দেয়া যেতে পারে। ঢাকা মহানগীর যানজট, পার্কিং সমস্যা, পরিবেশ দূষণ ও জনদুর্ভোগের পরিপ্রেক্ষিতে আশু করণীয় হলো পার্কিং চাহিদা নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন, বিনামূল্যে পার্কিং বন্ধ করা এবং অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য জরিমানার ব্যবস্থা করা, সর্বত্র জায়গা ও সময়ের মূল্যানুসারে পার্কিং ফি নেয়া, পার্কিং থেকে প্রাপ্ত অর্থ পাবলিক পরিবহনের মানোন্নয়নে ব্যয় করা। যানজট রাজধানীর নগরজীবনকেই শুধু বিপর্যস্ত করে তুলছে তা নয়, ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য নগরী হিসেবেও পরিচিতি এনে দিয়েছে। যানজট সমস্যার সমাধানে আরও বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ চলছে। এ নির্মাণ কাজের জন্য ব্যস্ত সড়কের একাংশ ব্যবহৃত হওয়ায় ধারেকাছের সব সড়কে যানজট অনিবার্য হয়ে উঠছে। নির্মাণ কাজের শম্বুকগতি মানুষের ভোগান্তিকে দীর্ঘস্থায়ী করছে। যানজটে এমনই অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে যে, আধা ঘণ্টা দূরত্বের সড়ক অতিক্রম করতে গড়ে সাত-আটগুণ পর্যন্ত সময় লাগছে। রাজধানীর যানজটের জন্য প্রাইভেট কারের মাত্রাতিরিক্ত সংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, রিকশার পাশাপাশি প্রাইভেটকারের আধিক্য অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে। তবে অভিজ্ঞজনদের মন্তব্য, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা যানজটের জন্য প্রধানত দায়ী। ঢাকার রাজপথের এক বড় অংশ অবৈধ দখলকারীদের দখলে চলে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই অবৈধ দখলদারিত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক টাউট, পাড়া-মহল্লার মস্তান এবং পুলিশের সম্পর্ক থাকায় রাজধানীর সড়কগুলো দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। রাজধানীর সড়ক ও ফুটপাথ থেকে অবৈধ দোকানপাট উঠিয়ে দেয়া সম্ভব হলে যানজট এমনিতেই সহনীয় হয়ে উঠবে। এর পাশাপাশি কঠোরভাবে ট্রাফিক আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হলে যানজটের রাশ টেনে ধরা সম্ভব হবে। যানজটের কারণে ঢাকার নাগরিক জীবনের কোন সময়সূচী মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে না। কর্মজীবী মানুষকে কর্মস্থলে যেতে এবং কাজ শেষে ফিরতে প্রতিদিন এতটা সময় ব্যয় করতে হচ্ছে যে, বিমানে করে সে সময়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া শুধু নয়, ফিরে আসাও সম্ভব। রাজধানীর যানজট নাগরিকদের মনোরাজ্যে প্রতিদিনই সৃষ্টি করছে বিরূপ প্রভাব। কেড়ে নিচ্ছে মনের শান্তি। অর্থনীতির জন্য সর্বনাশা প্রভাবও সৃষ্টি করছে এ সমস্যা। রাজধানীতে প্রতিটি যান্ত্রিক যানবাহনে যে পরিমাণ জ্বালানি তেল বা সিএনজি ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় অর্ধেকটাই অপচয় ঘটে যানজটের কারণে। অথচ চরম বিরক্তিকর এ সমস্যা থেকে নগরবাসীকে রেহাই দেয়ার তৎপরতা নেই বললেই চলে। রাজধানীর যানজট নিরসনে ট্রাফিক ব্যবস্থাকে গতিশীল করার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসবেও লাগাম পরাতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, দেশের সবকিছুতে রাজধানীমুখী যে প্রবণতা রয়েছে তাতেও বাদ সাধতে হবে। সরকারী-বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ অফিসের বিকেন্দ্রীকরণ করেও ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব। যানজটের কবল থেকে ঢাকাকে রক্ষা করতে ঘন ঘন মেট্রো ট্রেন সার্ভিস, পাতাল রেল, ট্রানজিট সুবিধা, পার্কিং মিটার, দ্বিতল বাস সার্ভিস চালুর বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতায়ন জরুরী। অন্যথায় পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া প্রাইভেটকার, রিক্সা, বেবিট্যাক্সিসহ বিভিন্ন পরিবহনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। মতিঝিলকে বাণিজ্যিক জোন ঘোষণা করে বাস ছাড়া সকল পরিবহন বন্ধ করে দিতে হবে। রাজধানী ঢাকার মোট আয়তনের ৬-৭ ভাগ রাস্তা। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী রাস্তা ২৫-৩০ ভাগ থাকার কথা থাকলেও ঢাকায় তা নেই। যেটুকু রাস্তা আছে এর অনেকাংশই দখলে। ফেরিওয়ালা, যত্রতত্র পার্কিংসহ অবৈধ স্থাপনার দখলে চলে গেছে রাজধানীর অনেক রাস্তাই। এছাড়া প্রায় ৩০ ধরনের যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন যার প্রত্যেকটির গড় গতিবেগ আলাদা হলেও ঢাকার রাস্তার একসঙ্গে চলে। যানজটের পেছনে এটি একটি অন্যতম কারণ। ঢাকা সিটি করপোরেশন ও বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের সংখ্যা ৭২ লাখ সাত হাজার ২৮৫। ২০০৩ সালে এর সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ তিন হাজার ২১৫টি। অর্থাৎ ৯ বছরে রাজধানীতে যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে ৪২ লাখের বেশি। কারের সংখ্যা এক লাখ ৪৭ হাজার ২৮৩, জিপ পাঁচ লাখ ৮ হাজার ৬০৮, ট্যাক্সি ৬৮২টি, বাস ৮ হাজার ২১০, মিনিবাস ৮ হাজার ৩১৭, ট্রাক ৩০ হাজার ১৫টি, সিএনজি ও থ্রি গুইলার ১৪ হাজার ৮২০টি, মোটরসাইকেল ২ লাখ ১৯ হাজার ৪৪৩টি, ইঞ্জিনচালিত অন্যান্য গাড়ি প্রায় ৩০ হাজার। সিটি কর্পোরেশন থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশার সংখ্যা বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে পাঁচ লাখের বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগই লাইসেন্সের আওতার বাইরে। এই প্রেক্ষাপটে ঢাকায় প্রকৃত অর্থে পরিবহনের সংখ্যা কত তা নির্ধারণ করা কঠিন। এছাড়া যানজট নিরসন ও জনপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ডকে (ডিটিসিবি) আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব দেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের যথাযথ দায়িত্ব না দেয়ার কারণে বোর্ডের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। যানজট নিরসনের কথা ভাবার আগে প্রশ্ন এসে যায়, রাজধানীতে কত মানুষের নাগরিক সুবিধা দেয়া সম্ভব? ঢাকা শহরের আয়তন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৩০ লাখ মানুষ বসবাস করতে পারে। অর্থাৎ এই শহরে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ মানুষকে নাগরিক সুবিধা দেয়া সম্ভব। তাহলে ঢাকায় জনসংখ্যা কত? এ নিয়ে আছে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ২০৩০ সালে রাজধানীতে জনসংখ্যা হবে দুই কোটি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বলছে সোয়া কোটি। জাতিসংঘের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ২২ লাখ ২১ হাজার। বর্তমানে ঢাকায় লোকসংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছয় শতাংশ। ১২ বছর পর ঢাকার জনসংখ্যা হবে প্রায় আড়াই কোটি। বিশ্বব্যাংকের মতে রাজধানীর বর্তমান পরিস্থিতিতে যানজট নিরসন অসম্ভব। তাহলে ঢাকাবাসীর কি হবে? যানজটেই আটকে থাকবে ঢাকাবাসী। না এই দুঃসহ যানজট থেকে ঢাকাবাসীকে মুক্ত করতেই হবে। বিশেষ করে রোজা আর ঈদকে নির্বিঘœ করতে যানজট মুক্ত ঢাকা চাই আমরা। আর এ জন্য অবশ্য ঢাকার রাস্তায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
×