ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাদক কারবারিদের তালিকা ফাঁস করেছে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩০ মে ২০১৮

মাদক কারবারিদের তালিকা ফাঁস করেছে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ

শংকর কুমার দে ॥ দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাঁস হয়ে গেছে মাদক কারবারিদের নামের তালিকা। মাদক কারবারির তালিকা ফাঁস করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক কানেকশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ, অসৎ কর্মকর্তারা। এ কারণে মাদকবিরোধী অভিযান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পুলিশ সদর দফতর ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, ইয়াবাসহ মাদকের ব্যবসা করতে হলে প্রশাসনকে উৎকোচ দিতেই হয়। তবে এই উৎকোচের পরিমাণ প্রতি মাসে কোটি টাকার বেশি। স্থানীয় প্রশাসন, রেঞ্জ, জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় ও গোয়েন্দা বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার নিয়মিত উৎকোচ গ্রহণের ফলেই দেশব্যাপী মাদকের দ্রুত বিস্তার ঘটেছে, যা থেকে প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিচ থেকে অনেক উপরে যায় যা কাঁচা টাকা হিসেবে পরিচিত। এই কাঁচা টাকা এক শ্রেণীর স্থানীয় রাজনীতিকদের পকেটেও যায়। কোন কোন রাজনীতিকদের নির্বাচনী ব্যয়ভার ও মাস্তান নিয়োগের কাজটিও করেন মাদক ব্যবসায়ীরা। সারাদেশে মাদকের কানেকশনের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় প্রশাসন, রেঞ্জ, জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয় ও গোয়েন্দা বিভাগ এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তারা যারা নিয়মিত উৎকোচ গ্রহণ করে আসছে তা অনেকটাই ওপেন সিক্রেটের মতোই। এসব দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের পারিবারিক অনুষ্ঠান, বিদেশ ভ্রমণ ও স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সব ব্যয়ভার বহন করে থাকে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা, যারা মাদকের গডফাদার হিসেবে পরিচিত। মাদকের এই কাঁচা টাকা যাদের পকেটে যায় তাদের মধ্য থেকেই মাদক অপরাধের তালিকা ফাঁস করে দেয়া হয়েছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানান, পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সম্প্রতি পুলিশের ত্রৈমাসিক অপরাধ বিষয়ক সভায় পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্য ও কর্মকর্তারা জড়িত। দেশের বিভিন্ন থানায় ওসি, এসআই, এএসআই পদায়নে রেঞ্জ ডিআইজিরা ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ গ্রহণ করেন। মাঠ পর্যায়ের এসব কর্মকর্তারা ঘুষের এই টাকা মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করে করে থাকেন। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ২৪ দিনের মাদকবিরোধী অভিযানে তালিকাভুক্ত অনেকের নাগাল পাচ্ছে না পুলিশ। শতভাগ সফলতা মিলছে না অভিযানে। আবার অনেকেই সটকে পড়েছেন, এমন তথ্যে তার বাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে না। মূলত বড় পরিসরে চালানো এই অভিযানে তালিকাভুক্তদের নাম ফাঁস হয়ে যাচ্ছে নানাভাবে। পুলিশ ও র‌্যাবের সোর্সরা মাদক ব্যবসায়ী ও ডিলারদের জানিয়ে দিয়েছে তালিকার খবর। মাদক ব্যবসায় জড়িত অনেক পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যও অভিযানের আগামবার্তা পৌঁছে দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের কানে। এ ছাড়া গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধ এড়াতে চিহ্নিতরা অভিযানের শুরুতেই গা-ঢাকা দিয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ট্যাবলেটের পাশাপাশি হেরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজা উদ্ধারের আশা করা হলেও তেমন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ উদ্ধার হচ্ছে না। মাদকের তালিকার নাম ধরে ধরে অভিযান চলার মধ্যেই অনেকেই সটকে পড়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তাই স্বীকার করছেন। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অপরাধী ধরতে র‌্যাব-পুলিশ সোর্সের সহায়তা নিয়ে আসছে। সোর্সরাও অপরাধীদের পরিচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীদের মধ্য থেকে সোর্স বানানো হয়। এ অবস্থায় সোর্সমানি দাবি করে। তা না পেলে তারা উদ্ধারকৃত মাদক থেকে কিছু (ইয়াবা কিংবা ফেনসিডিল) দাবি করে থাকে। পরে ওইসব ইয়াবা, ফেনসিডিল তারা বাইরে বিক্রি করে থাকে। পুলিশ-র‌্যাব কর্মকর্তাদের দেয়া সোর্সমানিতে তারা সন্তুষ্ট না হলে অপরাধীদের কাছে তথ্য দিয়ে সুযোগ নিয়ে থাকে। যদিও পুলিশের বরাদ্দকৃত সোর্সমানি মাঠ পুলিশ পায় না এমন গুঞ্জনও রয়েছে। সবমিলিয়ে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা চলমান অভিযানে সোর্সদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন মাঠ পুলিশের কর্মকর্তাদের। অবশ্য মাঠ পুলিশ দাবি করছে, সোর্স ছাড়া অভিযানে গিয়ে সাফল্য মিলছে না, খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে। এমনকি দেখা যাচ্ছে, ইউনিয়ন ও থানা, জেলা পর্যায়ে মাদক অপরাধীদের গ্রেফতারের আগে পরে তদ্বির যাচ্ছে বলে অভিযোগ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্তৃপক্ষ। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মাদকবিরোধী অভিযানে আটক করে যাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে তাদের মধ্যে মদ, গাঁজা, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের খুচরা বিক্রেতারা রয়েছে। রয়েছে মাদকসেবীও। র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দ-প্রাপ্তদের মধ্যেও খুচরা বিক্রেতা ও মাদকসেবী রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, মাদক অপরাধের সঙ্গে জড়িত পুরো তালিকা ফাঁস হয়ে গেছে। গণমাধ্যমে চলে এসেছে তালিকাভুক্তদের নাম পরিচয়। আবার র‌্যাব-পুলিশের সোর্সরাও মাদক ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে জানিয়ে দিয়েছে তালিকা ধরে অভিযানের খবর। সটকে পড়েছে তারা। পুলিশ, ডিবি ও র‌্যাবের বিতর্কিত সদস্য হিসেবে যারা মাদক ব্যবসা ঘনিষ্ঠ, তারাও তালিকা এবং অভিযানের খবর ফাঁস করে দিয়েছে। শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকাই নয়, সারাদেশের মহানগর, জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে মাদক অপরাধীদের তালিকা ফাঁস হয়ে গেছে। এতে মাদক অপরাধীদের গ্রেফতারের বিষয়টি অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, জঙ্গী দমনের কায়দায় মাদক দমনের চিন্তা-ভাবনা যে ভুল তা চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। জঙ্গী দমনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিবাজ, অসৎ কর্মকর্তার কোন ধরনের টাকা পয়সা বা লেনদেনে কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু মাদক দমনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব দুর্নীতিবাজ, অসৎ কর্মকর্তার মাদকের কানেকশন আছে তারাই মাদকের তালিকা ফাঁস করে দিচ্ছে। এতে মাদক বিরোধী শতভাগ সফল অভিযানে পরিণত করাটা এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি মাদকবিরোধী অভিযানের জন্য যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তাতেও অনেক অসঙ্গতি থাকার অভিযোগ আসছে, যা মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যেই তার সংশোধন, সংযোজন ও মাদকবিরোধী অভিযানকে দীর্ঘায়িত করে মাদক সংক্রান্ত অপরাধীদের যে কোন মূল্যে নির্মূল করা অপরিহার্য বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
×