ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কেরানীগঞ্জে নানা রং ও ডিজাইনের বাহারি পোশাকের সমাহার

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩০ মে ২০১৮

কেরানীগঞ্জে নানা রং ও ডিজাইনের বাহারি পোশাকের সমাহার

রহিম শেখ, কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে ॥ বিরামহীন চলছে সেলাই মেশিন। দিন-রাত কর্মব্যস্ত কারিগররা। তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন রং ও ডিজাইনের প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, থ্রি পিসসহ বাহারি সব পোশাক। এটি কারখানার ভেতরের চিত্র। আর বাইরে এসে চোখে পড়ল ছোট-বড় দোকানে বাহারি সব পোশাকের স্তূপ। বলছি বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা কেরানীগঞ্জের পোশাক পল্লীর কথা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিদিনই পাইকাররা আসছেন এখানে। ঘুরে ঘুরে কিনছেন পছন্দসই পোশাক। তারপর ছুটছেন নিজ গন্তব্যে। শুধু মার্কেট কিংবা দোকান নয়, ফুটপাথও বাদ যায়নি বেচাকেনার এই আয়োজনে। রমজানের অন্তত ১৫ দিন আগে থেকে এই বেচাকেনা শুরু হয়েছে। চলবে ঈদের চাঁদ রাত পর্যন্ত। তবে পাইকারদের আনাগোনা কমে যাবে ২৫ রমজানের পর। জানা গেছে, দেশের সর্ববৃহৎ পোশাক তৈরির পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ, আগানগর ও শুভাঢ্যা এখন সারাদেশের ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর। পোশাক তৈরির পাইকারি বাজার হওয়ার কারণে এ এলাকার বাজার জমতে শুরু করে শব-ই-বরাতের পর থেকেই। কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের প্রায় ৫০ শতাংশ বেচাবিক্রি রমজান শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। আগামী ২৫ রমজান পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি ও চাঁদ রাত পর্যন্ত খুচরা বিক্রি করেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে হাজার দশেক কারখানা এবং দুই হাজারের মতো শোরুম রয়েছে। এসব কারখানা ও শোরুমে অন্তত দুই লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেন। অবশ্য এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করতে পেরেছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মফস্বল শহরগুলোর বিপণিবিতান তো বটেই, রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতেও এখন বিদেশী কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতাদের হাতে উঠছে এখানকার তৈরি পোশাক। পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, স্যুট-ব্লেজারসহ সব ধরনের শীতবস্ত্র, শিশুদের কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্ট আইটেম পাওয়া গেলেও এই ক্ষুদ্র গার্মেন্টপল্লী বিশেষভাবে বিখ্যাত জিন্স ও গেভাডিন প্যান্ট ও ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবির জন্য। কেরানীগঞ্জের জিলা পরিষদ মার্কেট, তানাকা মার্কেট, এস আলম সুপার মার্কেট, নুর সুপার মার্কেট, চৌধুরী মার্কেট, আলম সুপার মার্কেট, ইসলাম প্লাজা, আনোয়ার সুপার মার্কেট, কদমতলী গোলচত্বর এলাকার লায়ন সুপার মার্কেট, জিঞ্জিরার ফ্যামিলি শপিং মলসহ বেশ কয়েকটি পাইকারি মার্কেটে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার মার্কেটগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৫০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। তবে ঈদে স্বাভাবিক সময়ের বেচাকেনার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। জেলা পরিষদ মার্কেটের খান গার্মেন্টে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট একটি ঘরে ১৫ কারিগর জিন্স প্যান্ট তৈরির কাজ করছেন। কারখানার মালিক উবায়দুল ইসলাম রাজু শ্রমিকদের নিয়ে তৈরি হওয়া প্যান্ট নিজ দোকানসহ বিভিন্ন পাইকারি দোকানে সরবরাহ করতে প্যাকিং করে থরে থরে সাজিয়ে রাখছেন। তিনি জানান, গেল রমজানের ঈদ ঘিরে ৪৫ হাজার প্যান্ট তৈরি করেছিলেন। এবার ৫০ হাজার প্যান্ট তৈরি করবেন। তাই কারখানায় কাজের ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। আশা কমপ্লেক্সের মোবারক হোসেন জানান, এবার ঈদ ঘিরে মেয়েদের ৩০ হাজার থ্রিপিস তৈরি করবেন তারা। আর এতে বাজেট রেখেছেন প্রায় দেড় কোটি টাকা। তিনি আরও জানান, ঈদে দেশী কাপড়ের তৈরি পণ্য বিক্রি কিছুটা কম হয়। পূর্ব আগানগর খাজা সুপার মার্কেটের ওমর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও আলিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক নুরুল আমীন লিটন জানান, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকের মার্কেট এটি। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিদ্যুত সমস্যার কারণে তাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হতো। কিন্তু কেরানীগঞ্জে এখন আর কোনো বিদ্যুত সমস্যা নেই। যে কারণে তাদের উৎপাদন এ বছর আগের তুলনায় অনেকটাই বেশি। আলম শপিংমলের বেবি পয়েন্ট ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী জয়নাল দেওয়ান বলেন, ঈদ মৌসুম সামনে রেখে এরই মধ্যে পাইকার সমাগম শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, যে কোন রুচিশীল তৈরি পোশাক এখানে অত্যন্ত সহজ মূল্যে পাওয়া যাওয়ার কারণে পাইকারদের তেমন বেশি ঘোরাঘুরি করতে হয় না। তাছাড়া রাজধানীর যে কোন পাইকারি বাজারের তুলনায় আমাদের এখানে কেনাকাটা করে পাইকার সাধারণরা কোনরকম যানজট ছাড়াই নিরাপদে তাদের গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। যে কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পাইকারদের কাছে দিন দিন আমাদের কদর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে পূর্ব আগানগরের আল-মদিনা পাঞ্জাবির কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে, ৩০ কারিগর বাহারি ডিজাইনের পাঞ্জাবি তৈরি করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিপিস পাঞ্জাবি সেলাই করতে কারখানার মালিক তাদের ডিজাইনভেদে ২৫ থেকে ৩০ টাকা দিয়ে থাকেন। কারখানার মালিক সুমন বলেন, এবারের ঈদের বাজার ধরতে তারা ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার পিস পাঞ্জাবি তৈরি করবেন। এ পাঞ্জাবি তৈরি করতে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আর এ বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। বাকি ২০ শতাংশ আগের বছরের লাভের থেকে বিনিয়োগ করেছেন। তিনি জানান, মার্কেটে ভারতীয় পণ্য আসাতে ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছে। কথা হয় আলম সুপার মার্কেটের গ্রুভি পাঞ্জাবির মালিক জহির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রং আর ডিজাইনের দিকে খেয়াল রেখে আমরা একটু ভিন্ন স্টাইলের পাঞ্জাবি বাজারজাত করে থাকি। ঠিক একই ধরনের মন্তব্য ওই মার্কেটের আরেক ব্যবসায়ী জিলাস গার্মেন্টের মালিক হাজী নাজিম উদ্দিনের। তার মতে, আমরা বর্তমান সময়ের সঙ্গে রুচিশীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে পোশাক তৈরি করে থাকি। এ মৌসুমে তাদের বিক্রির টার্গেট প্রায় ২ কোটি টাকা। জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম নূরু বলেন, এখানে কোন শ্রমিক অসন্তোষ নেই । নেই কোন চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী । নৌ-পথ ও সড়ক পথে দেশের যে কোন অঞ্চলে সহজে যোগাযোগ এবং যানজটমুক্ত এলাকা হওয়ায় দেশের সব এলাকার পাইকাররা মন খুলে পছন্দ মাফিক কেনাকাটার জন্য এখানে আসছেন।
×