ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে খুনের বদলে খুন

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩০ মে ২০১৮

পাহাড়ে খুনের বদলে খুন

মোয়াজ্জেমুল হক/জীতেন বড়ুয়া ॥ পাহাড়ে দুই আঞ্চলিক সংগঠনের বিভক্ত চার গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডারদের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ক্রমশ বাড়ছে। অস্ত্রের ঝনঝনানির এই লড়াইয়ে খুনের বদলে খুনের পথই বেছে নিয়েছে সশস্ত্র ক্যাডাররা। পাহাড়ে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) থেকে বের হয়ে প্রসিত খিসার নেতৃত্বে হয়েছে ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির সঙ্গে প্রসিত খিসার সম্পৃক্ততা ছিল দীর্ঘ সময়জুড়ে। ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর প্রসিত খিসার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউপিডিএফ। সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিডিএফের মধ্যে ভাঙ্গন ধরেছে। গঠিত হয়েছে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)। অপরদিকে, সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস খ-িত জেএসএস আরেক দফা ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে জেএসএস (সংস্কারবাদী এমএন লারমা গ্রুপ)। শান্তিপ্রিয় পাহাড়ের বাঙালী-পাহাড়ী সাধারণ মানুষ এই দুই সংগঠন ও উপ-গ্রুপের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে চরম আতঙ্কে রয়েছে। অনেকেই ঘর ছেড়েছে। এদের মধ্যে যুবকদের সংখ্যাই বেশি। সর্বশেষ গত ২৮ মে সোমবার সকালে রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ির সাজেকে সশস্ত্র এসব ক্যাডারদের অন্তর্কোন্দলের জের হিসেবে খুন হল আরও ৩ জন। এ নিয়ে বিভক্ত জেএসএস ও ইউপিডিএফের আধিপত্য বিস্তার ও শক্তির মহড়ায় গত ৬ মাসে জনপ্রতিনিধিসহ ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। প্রতিনিয়ত খুন, বদলা খুন ও প্রকাশ্য গোলাগুলিতে এসব সংগঠনের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পাহাড়ী জনপদের প্রায় সহস্রাধিক যুবক এখন ঘরছাড়া। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও অস্ত্রের ঝনঝনানিতে পাহাড়ী পল্লীগুলোতে চলছে স্বজনহারাদের আহাজারি। অপরদিকে, অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা প্রতিশোধের নেশায় খুনের বদলা খুনের পথই চালিয়ে যাচ্ছে। ভারি অস্ত্রের ব্যবহারে এসব খুনের হোলিখেলায় সবুজ পাহাড় রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে প্রতিনিয়ত সবুজ পাহাড় রক্তে লাল হয়ে উঠছে, অস্ত্রের কাছে হেরে যাচ্ছে মানুষের মানবতা আর মানবিকতা। অস্ত্রধারীদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে বিপুলসংখ্যক পাহাড়ী-বাঙালী পরিবার। উল্লেখ করা যেতে পারে গত বছরের ১৫ নবেম্বর পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন প্রসিত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ ভেঙ্গে ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ নামে নতুন ইউপিডিএফ আত্মপ্রকাশ করার পর আধিপত্য লড়াইয়ে প্রতিশোধমুখী হয়ে ওঠে ইউপিডিএফ। শুরু হয় পাহাড়ে আবারও চরম ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। ভ্রাতৃঘাতী এ সংঘাতে রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমাসহ গত ১ মাসে ৯ জন খুন ও ৯ জন হতাহত হয়। বলি হয় সাধারণ বাঙালী এক মাইক্রোচালক। এর আগে খাগড়াছড়ি জেলা শহরে স্লুইসগেট এলাকায় ইউপিডিএফ সংগঠক মিথুন চাকমা খুন হন। এ খুনের পর হতে ইউপিডিএফ ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক মধ্যে শুরু হয় অঘোষিত যুদ্ধ। এ যুদ্ধে প্রতিনিয়ত ঝরছে তরতাজা প্রাণ। স্থানীয়রা জানান, ইউপিডিএফ ও তাদের প্রতিপক্ষদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে খাগড়াছড়ি জেলার পেরাছড়া, তেঁতুলতলা, পানছড়ি উপজেলার লোগাং, কুড়াদিয়াছড়া, লতিবানসহ চাকমা অধ্যুষিত পাহাড়ী পল্লীগুলোতে এখন যুবকরা ঘরছাড়া। অভিযোগ রয়েছে, এসব যুবকদের আধিপত্য লড়াইয়ে ইউপিডিএফ তাদের সংগঠনে জোরপূর্বক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে দলে ভিড়তে বাধ্য করছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইউপিডিএফ। এদিকে, এসব ঘটনায় যেমনি সাধারণ পাহাড়ী জনপদে আতঙ্ক ছড়িয়েছে তেমনি স্থানীয় পাহাড়ী জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছে চরম আতঙ্কে। বিশেষ করে পানছড়ি উপজেলা, সদর উপজেলার বেশ কিছু ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এখন নিয়মিত নিজ কার্যালয়ে যাওয়া বন্ধ রেখেছেন। চলতি বছরের ৩ ও ৪ মে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা, একই দলের কেন্দ্রীয় নেতা কনক চাকমা, সুজন চাকমা ও সেতু লাল চাকমা। এ ঘটনায় নিহত হয় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের চালক মোঃ সজীব। সূত্র জানায়, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করলে এর বিরোধিতা করে প্রসিত চাকমার নেতৃত্বাধীন একদল পাহাড়ী ছাত্র ও যুবক। পরে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ২০০৭ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ভেঙ্গে রূপায়ন দেওয়ান, সুধাসিন্ধু খিসা, শক্তিমান চাকমা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমাসহ কিছু নেতাকর্মীর নেতৃত্বে গঠিত হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা)। সর্বশেষ ইউপিডিএফ ভেঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। এসব দলের নেতাকর্মীরা মরিয়া হয়ে আছে পাহাড়ে আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে। এ নিয়ে চলছে খুনের বদলা খুন। বলি হচ্ছেন অনেকে। গত দুই দশকে প্রাণ হারিয়েছে এসব দলের প্রায় ৫ শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক। দল প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মাথায় খুন হলেন ৩ সহকর্মীসহ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা। এর ১০ দিনের ব্যবধানে ১৫ ডিসেম্বর রাতে নানিয়াচরের সীমান্তে বন্দুকভাঙ্গা ইউনিয়নের ধামাইছড়া এলাকায় ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের সংগঠক অনল বিকাশ চাকমা ওরফে প্লুটোকে। সূত্র জানায়, তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা ছিলেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) প্রভাবশালী শীর্ষনেতা। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধের জেরে দল থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে। জানা যায়, পাহাড়ের সাধারণ মানুষ সংঘাতের অবসান চাইলেও আঞ্চলিক দলগুলো একে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বলতে রাজি নয়। শান্তি চুক্তির পর ২০১৫ সালে জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফের মধ্যে অলিখিত সমঝোতা হলে সংঘাত বন্ধ থাকে। কিন্তু ২০১৭ সালে নবেম্বরের ১৫ তারিখ ইউপিডিএফ ভেঙ্গে গণতান্ত্রিক ইউপিডিফের জন্ম হয়। নবগঠিত ইউপিডিএফের হাতে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ৪ মে পর্যন্ত আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে উভয় পক্ষের অন্তত ৩৫জন নিহত হয়েছে। দীর্ঘ দু’দশকের সশস্ত্র সংঘাত নিরসনে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সবার প্রত্যাশা ছিল পাহাড়ে প্রতিষ্ঠিত হবে বহুল কাক্সিক্ষত শান্তি। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের সময় পাহাড়ীদের একটি অংশ এর বিরোধিতা করে ইউনাইটেড পিপলস অব ডেমোক্র্যাটিকস ফ্রন্ট ইউপিডিএফ নামের সংগঠনটি জন্ম নেয়। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রসিত বিকাশ খিসা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সন্তু লারমার একক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে জনসংহতি সমিতি ভেঙ্গে আরেকটি জেএসএস এমএন লারমা নামে সংগঠন জন্মলাভ করে। ইউপিডিএফ ভেঙ্গে ২০১৭ সালের ১৫ নবেম্বর জন্ম নেয় গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নামে আরেকটি সংগঠন। যার পাঁচ মাসের মাথায় প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা। ২০১৭ সালে ১২ মাসে খাগড়াছড়িতেই অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় ২৪টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারিতেই তিনবার অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশ্যে জেলা শহরের স্বনির্ভর বাজারে শতাধিক ভারি অস্ত্রের গোলাগুলি করে ইউপিডিএফ ও তাদের প্রতিপক্ষ ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর দাবি, খাগড়াছড়ি জেলাসহ তিন পার্বত্য জেলায় চারটি সংগঠনের অপতৎপরতা বন্ধ ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলমান রয়েছে।
×