ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নত মানের চালের সঙ্গে নিম্নমানের চাল

শরীয়তপুরে চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২৯ মে ২০১৮

শরীয়তপুরে চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়ম

নিজস্ব সংবাদদাতা, শরীয়তপুর, ২৮ মে ॥ সদর উপজেলার আংগারিয়া খাদ্য গুদামে সরকারী চাল সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। ২৫ মে তারিখের মধ্যে ২ হাজার মেঃ টন চাল সংগ্রহের কথা থাকলেও মেয়াদ শেষ হলেও পুরো চাল সংগ্রহ করা হয়নি। অভিযোগ ওঠেছে, ব্যবসায়ী ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সরবরাহকৃত উন্নত মানের চালের সঙ্গে নিম্নমানের চাল রদ-বদল করে সংগ্রহ করার কারণেই নির্ধারিত সময়ে খাদ্য গুদামে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। জানা গেছে, সরকার দরপত্রের মাধ্যমে প্যাকেজ-৩ এর আওতায় বিদেশ থেকে ১ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করছে। চুক্তি অনুযায়ী রশিদ অটোমেটিক রাইচ মিলস্ লিমিটেড দেশের বিভিন্ন জেলার ৫৪টি খাদ্য গুদামে এ চাল সরবরাহ করবে। এর আওতায় শরীয়তপুর জেলা সদরের আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদাম ২ হাজার মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার কথা। ২৫ মে ২০১৮ তারিখের মধ্যে ওই গুদামে ২ হাজার মেট্রিক টন চাল পৌঁছানোর কথা থাকলেও মেয়াদ শেষ হওয়ার ২ দিন পরেও সম্পন্ন হয়নি চাল সংগ্রহ। অথচ শরীয়তপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক খাদ্য অধিদফতরের কাছে ২০ মে এক লিখিত তালিকায় পুরো চাল বুঝে পাবার তথ্য পাঠিয়েছে। নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও গুদামে সম্পূর্ণ চাল না পৌঁছানোর কারণে জেলা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠেছে। এ বিষয়ে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রান্ত কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ আলম দীনাকে সন্তোষজনক লিখিত জবাব দিতে আদেশ প্রদান করেছেন। জানা গেছে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি রশিদ অটোমেটিক রাইস মিলস্ এর সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয় ২৩ মার্চের মধ্যে সকল কেন্দ্রে চাল পৌঁছে দেয়ার জন্য। নির্ধারিত সময়ে চাল সরবরাহ করতে না পারায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার চাল হস্তান্তরের সর্বশেষ তারিখ নির্ধারণ করেন ২৫ মে পর্যন্ত। ৪ মে থেকে আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদাম চাল সংগ্রহ শুরু করে। সূত্র জানিয়েছে, সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ৫০ কেজি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ডাবল সেলাইযুক্ত পলি ব্যাগে চাল সরবরাহ করতে হবে। প্রতিটি ব্যাগের গায়ে খাদ্য অধিদফতর ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সীলমোহর সংযুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক । সরবরাহকৃত চাল বুঝে নিতে গুদামভিত্তিক একটি কোয়ালিটি ভেরিফিকেশন কমিটি (চালের মান যাচাই কমিটি) গঠন করতে হবে। এ কমিটিতে থাকবেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা, একজন কারিগরি খাদ্য পরিদর্শক ও খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। উল্লেখিত কমিটি সংগ্রহ নীতিমালার নির্দেশনা অনুযায়ী গুদামে চাল গ্রহণপূর্বক খামাল গঠন করবেন। চাল খামালীকরণের পর চালের আদ্রতা (চালের প্রাকৃতিক জলীয় অংশ) সর্বোচ্চ ১৪ শতাংশ আছে কী না তা নিশ্চিত করবেন। চালের ভাঙ্গাদানা, আস্তদানা ও মরাদানা যাচাই করবেন। এরপর শতভাগ বস্তা গণনা নিশ্চিত করে কমিটি তিনটি প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা সংগ্রহ করবেন। প্রথম নমুনা সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদামে, দ্বিতীয় নমুনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাছে এবং তৃতীয় নমুনাটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে পাঠাবেন। এতগুলো ধাপ অতিক্রমের পরে খাদ্য বিভাগ নির্ধারিত ট্রেজারি ব্যাংক বরাবরে ডব্লিউ কিউ এস সি (ওজন মান যাচাই সনদ) প্রদান করার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সরবরাহকারীকে প্রতি মেট্রিক টন চালের বিপরীতে ৪২ হাজার ২শ’ ৭৫ টাকা পরিশোধ করবেন। খাদ্য গুদামের তথ্য মতে, গত ২০ মে পর্যন্ত গুদামে ১ হাজার ২০ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী শরীয়তপুর সোনালী ব্যাংক রশিদ অটো রাইচ মিলস্ লিমিটেডকে ২২ মে ৪ কোটি ৩১ লাখ ২০ টাকা পরিশোধ করেছেন বলে জানিয়েছে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মোঃ হাবিবুর রহমান। কিন্তু ২২ মে মঙ্গলবার শরীয়তপুর খাদ্য বিভাগ ঢাকা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে যে, ২০ মে ২০১৮ তারিখেই দুই হাজার টন চালের সমুদয় চাল বুঝে পাওয়া গেছে। কিন্তু গুদামে আমদানিকৃত চালের মজুদ অনুযায়ী ২৫ মে বিকেল ৪টা পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৬শ’ টন চাল গ্রহণ করা হয়েছে। অথচ ৬ দিন আগেই জেলা খাদ্য বিভাগ থেকে কেন্দ্রে তথ্য দেয়া হয়েছে পুরো ২ হাজার মেঃ টন চাল বুঝে পাওয়া গেছে। আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামে গিয়ে দেখা গেছে, চালের ব্যাগের গায়ে খাদ্য অধিদফতর ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সীলমোহর সংযুক্ত থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ চালের বস্তায় কোন সীলমোহর নেই। অতি পুরনো ৫০ কেজির পলি বস্তায় এসেছে শত শত টন চাল। চটের বস্তায় চাল সরবরাহের আদেশ না থাকলেও অন্তত দেড় শত টন চাল এসেছে চটের বস্তায় ভরে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খাদ্য গুদামের এক কর্মচারী জানিয়েছেন, গুদামে অন্তত সাড়ে ৩শ’ টন চাল রয়েছে পুরনো ও পোকায় ধরা। চটের বস্তায় আমদানিকৃত চাল থেকে পোকা বেরুচ্ছে। জানা গেছে, চালের মান যাচাই কমিটি নিয়মানুযায়ী যাচাই-বাছাই না করেই নি¤œমানের চাল গ্রহণ করেছেন। জানা গেছে, ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে শাহনেওয়াজ আলম দীনা আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-এলএসডি) হিসেবে যোগদান করেন। তিনি এখানে যোগদানের পর থেকেই খাদ্যগুদামে ব্যাপক অনিয়ম শুরু হয়ছে। বিভিন্ন সময়ে অনেক ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ওসিএলএলডি শাহনেওয়াজ আলম দীনা জেলা খাদ্য বিভাগের সুনাম ক্ষুণœ করছেন। সরকারী কর্মসূচীর খাদ্যশস্য ওজনে কম দেয়া, অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উন্নতমানের চাল গুদাম থেকে বাইরে বের করে দিয়ে গুদামে নি¤œমানের চাল-গম প্রবেশ করানোসহ নিয়ম বহির্ভূত নানা কাজে তিনি জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শরীয়তপুর বিসিক শিল্প নগরীর তালুকদার ফ্লাওয়ার মিলের জন্য বরাদ্দকৃত ৩০০ মেট্রিক টন গম সরবরাহ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি করেন খাদ্য কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ আলম দীনা। ৩০০ টন গমের মধ্যে তিনি তালুকদার ফ্লাওয়ার মিলকে ১৪ মেট্রিক টন গম ওজনে কম দেন। এ বিষয়ে মিলের পরিচালক আজিজুল হক মীর মালত শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আজিজুল হক বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সরকার ৩শ’ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ দিলে আমি জানুয়ারি মাসে সে গম খাদ্য গুদামে উত্তোলন করতে গেলে ওসিএলএসডি আমাকে মেয়াদ উত্তীর্ণ পচা, পোকায় খাওয়া গম সরবরাহ করে। আমি গম বুঝে নিতে গিয়ে দেখি আমাকে মোট ১৪ মেট্রিক টন গম কম দেয়া হয়েছে। যার মূল্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এ বিষয়ে আমি শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কাছে একটি আবেদন করলে তিনি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির তদন্তে আমার অভিযোগের বিষয়টি সঠিক প্রমাণিত হয়। কিন্তু কতিপয় রাজনৈতিক নেতার হস্তক্ষেপে ওসিএলএসডি এর বিরুদ্ধে কমিটি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আমাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১৪ টন গমের সমুদয় মূল্য ফেরত দিয়ে দেয়। জানা গেছে, ওসিএলএসডি শাহনেওয়াজ আলম দীনা মাদারীপুরের চরমুগুরিয়া খাদ্য গুদামের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতি করেন। স্থানীয় লোকজন তার বিরুদ্ধে খাদ্যমন্ত্রী, খাদ্য বিভাগের মহাপরিচালক, আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকে একটি মামলা হয়। এরপর ২০১৭ সনের এপ্রিল মাসে তাকে মাদারীপুর থেকে প্রত্যাহার করে শরীয়তপুরের আংগারিয়া খাদ্য গুদামে দায়িত্ব দেয়া হয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রশিদ অটোমেটিক রাইস মিলস্ লিমিটেড এর জেনারেল ম্যানেজার হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা ২০ মে’র আগেই চুক্তিকৃত সকল চাল বহনকারী ট্রাক সংশ্লিষ্ট গুদামগুলোতে পাঠিয়ে দিয়েছি। আঙ্গারিয়া খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ আলমের কাছে এসব অনিয়ম বিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মহাপরিচালকের কাছ থেকে নির্দেশনা আছে এ বিষয়ে ওপরের অনুমতি ছাড়া কোন তথ্য প্রদান করা যাবে না। শরীয়তপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক খোন্দকার নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি, আমি অসুস্থ মানুষ। এ বিষয়ে আমি কোন কিছু বলতে আগ্রহী নই।
×