ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নূর ইসলাম হাবিব

মধ্য আফ্রিকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিকূলতা ও শান্তিরক্ষা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৯ মে ২০১৮

মধ্য আফ্রিকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিকূলতা ও শান্তিরক্ষা

আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যস্থলে অবস্থিত রিপাবলিক অব মধ্য আফ্রিকা বিশ্বের একটি দরিদ্রতম দেশ। ৬ লাখ ২২ হাজার বর্গ কি.মি. আয়তন বিশিষ্ট এ দেশটি খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে খুবই সমৃদ্ধ। মধ্য আফ্রিকা ডায়মন্ড ও কাঠ রফতানি করে থাকে এবং ওদেশে ইউরেনিয়াম, স্বর্ণ ও তেলের খনি রয়েছে। মধ্য আফ্রিকার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো হচ্ছে চাদ, সুদান, সাউথ সুদান, ডিআর কঙ্গো, কঙ্গো এবং ক্যামেরুন। বাঙ্গুই দেশের বৃহৎ ও রাজধানী শহর। মধ্য আফ্রিকা ১৯৬০ সালের ১৩ আগস্ট ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এদেশের রাষ্ট্র ভাষা ফ্রেন্স এবং স্থানীয় ভাষা সাঙ্গো। এদেশের জনসংখ্যা ৪৬ লাখ যাদের মধ্যে ৮০ ভাগ খ্রীস্টান, ১৫ ভাগ মুসলিম এবং ৫ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। মধ্য আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন ক্যাথেরিন সাম্বা পাঞ্জা। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই মধ্য আফ্রিকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘর্ষ চলে আসছে। এদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য অনেক আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। ব্যাপক গণহত্যা ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থেকে জাতিসংঘ ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল মধ্য আফ্রিকায় শান্তিরক্ষী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬৬ সালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বোকাসা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। এরপর থেকেই দেশটিতে অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকে। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ সেলেকা বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা মাইকেল জোতদিয়া অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বোজেজকে অপসারণ করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। এরপর সেলেকা গ্রুপ ভেঙ্গে দেয়া হয়। কিন্তু সেলেকা গ্রুপের অনেকে অস্ত্রসমর্পণ না করে ধীরে ধীরে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে সেলেকা বাহিনীর সঙ্গে উপজাতীয় বিদ্রোহী গ্রুপ এন্টি-বালাকার সংঘর্ষ শুরু হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। তাদের সংঘর্ষ ব্যাপক গণহত্যার দিকে মোড় নেয়। সেলেকা ও এন্টি-বালাকা গ্রুপ সম্মিলিতভাবে গণহত্যা শুরু করে। এ অবস্থায় ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট জোতদিয়া ও প্রধানমন্ত্রী নিকোলাস তিয়েনগে ক্ষমতা ত্যাগ করে। এরপর আফ্রিকান ইউনিয়নের অনুরোধে বাঙ্গুই সিটি মেয়র ক্যাথেরিন সাম্বা পাঞ্জা প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। মধ্য আফ্রিকায় ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফওসটিন আরচাঞ্জ তুয়াদেরা। তিনি ভোট পান ৬৩%। পরাজিত হন আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী এনিসেট জর্জেস ডলোগুয়েলে। প্রেসিডেন্ট ক্যাথেরিন সাম্বা পাঞ্জা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। ২০১৭ সালের প্রথম দিকে রাজধানীর চারপাশের অবস্থার সামান্য উন্নতি হলেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগজনক। সেদেশে নতুন করে আরও ১ লাখেরও বেশি লোক সংঘর্ষের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মধ্য আফ্রিকায় প্রতিরক্ষা বাহিনী বলতে শুধু সেনাবাহিনী আছে। ওই দেশে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী নেই। সীমিত সংখ্যক জাতীয় পুলিশ ও জেন্ডারমেরী (কমিউনিটি পুলিশ) প্রধান প্রধান শহরে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে। জাতিসংঘ মধ্য আফ্রিকায় ১০ হাজার সামরিক বাহিনী ও ১৮০০ পুলিশ সদস্য মোতায়েন করেছে। সৈন্য প্রেরণকারী দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, সেনেগাল, মিসর, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, নাইজার, তাঞ্জানিয়া, ফ্রান্স, গ্যাবন, রুয়ান্ডা, ক্যামেরুন, কঙ্গো, ঘানা, মৌরিতানিয়া, চেক রিপাবলিক, বুরুন্ডি এবং মরক্কো। লে. জেনারেল বাবাকার গায়ে মালিতে শান্তিরক্ষা মিশনে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফোর্স কমান্ডার হিসেবে আছেন মেজর জেনারেল মার্টিন চোমু টুমেন্টা এবং ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার হিসাবে আছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মধ্য আফ্রিকায় প্রথম সৈন্য প্রেরণ করে। সেখানে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নের ৭৫০ জন, ব্যামেড ৬৯ জন এবং ব্যানসিগ-এর ৭০ জনসহ মোট ৯২৪ জন সেনা সদস্য। ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের তৎকালীন জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মোঃ সালাহ্ উদ্দিন মিয়াজীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি শুভেচ্ছা দল বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শনের জন্য ১৩ মে থেকে ১৫ মে (২০১৫) পর্যন্ত মধ্য আফ্রিকা ভ্রমণ করে। আমি ছিলাম এ দলের অন্যতম সদস্য। দলের অন্য সদস্যরা হলেনÑ লে. কর্নেল মোঃ জাকির হোসেন ভুঞা, লে. কর্নেল মোঃ মোতাহার হোসেন, লে. কর্নেল মোঃ জাহেদুর রহমান, মেজর মোহাম্মদ ফিরোজ আহমেদ, মেজর মুনতাসির রহমান চৌধুরী, যুগ্ম সচিব কাজী মাহবুব হাসান, যুগ্ম সচিব মোঃ সফিকুল আহম্মদ, জেসিজিডিএফ মোঃ খুরশীদ আলম পাটওয়ারী, রিপোর্টার আপেল মাহমুদ, ক্যামেরাম্যান মহিউদ্দিন শিবলী ও সার্জেন্ট মোঃ মনিরুল ইসলাম। মধ্য আফ্রিকায় জাতিসংঘ মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য বেসামরিক লোকদের জানমাল রক্ষা করা। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মধ্য আফ্রিকার অপারেশন্স এলাকাকে তিনটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে- সেক্টর ইস্ট, সেক্টর ওয়েস্ট এবং সেক্টর সেন্টার। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা সেক্টর ওয়েস্টে নিয়োজিত আছে। এ অঞ্চলটি খুবই গোলযোগপূর্ণ। সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী কর্তৃক প্রায়ই জনগণের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে থাকে। মেইন সাপ্লাই রুটে এন্টি-বালাকা গ্রুপ কর্তৃক পণ্যবাহী গাড়িবহরে হামলা ও লুটপাট, ডাকাতি, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, হত্যাকা-, চাঁদাবাজি ইত্যাদি ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। তাছাড়া, যাযাবর শ্রেণীর ফুলানী সম্প্রদায়ের ওপর দুষ্কৃতকারীদের হামলা ও তাদের গবাদি পশু লুটের ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটছে। মধ্য আফ্রিকায় ব্যানব্যাট স্বল্প সময়ে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। ব্যানব্যাটকে দায়িত্ব দেয়া হয় বাঙ্গুই থেকে ক্যামেরুন সীমান্ত পর্যন্ত ৬১০ কিমি দীর্ঘ প্রধান সরবরাহ লাইনের নিরাপত্তা বিধান করার। দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে এ সড়কটি ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সড়ক। দুষ্কৃতকারীরা প্রায়ই পণ্যবাহী যানবাহনে হামলা করত এবং মালামাল লুট করে নিয়ে যেত এবং জানমালের ক্ষতি সাধন করত। বোয়ার অঞ্চলের লোকোতি গ্রামে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিছুদিনের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্যানব্যাট এই সড়কে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। যানবাহন ও জনগণের জন্য এটি আবার পরিণত হয় নিরাপদ সড়কে। এভাবে ব্যানব্যাট স্থানীয় জনগণের হৃদয়-মন জয় করে এবং তাদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করে। মধ্য আফ্রিকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি হওয়ায় যাযাবর শ্রেণীর ফুলনী সম্প্রদায় প্রায়ই এন্টি-বালাকা গ্রুপের দুষ্কৃতকারীদের হামলার শিকার হতো। বিশেষ করে সেক্টর ওয়েস্টে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটত। যেহেতু বেসামরিক লোকদের জানমাল রক্ষা করা জাতিসংঘ মিশনের অন্যতম প্রধান ম্যানডেট সেহেতু দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে তাদের রক্ষা করা জাতিসংঘ বাহিনীর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। অপারেশন বেকো-২ এ ধরনের একটি অভিযান যার মধ্য দিয়ে ৮ মে ২০১৫ তারিখে লাম্বি গ্রাম থেকে এন্টি-বালাকা গ্রুপের হাত থেকে ৪৩ জন ফুলানী ও তাদের গবাদি পশু উদ্ধার করা হয়। তাদেরকে এন্টি-বালাকা গ্রুপ গবাদি পশু লুট করার উদ্দেশে জিম্মি করে রেখেছিল। এ অভিযানে পুরো দায়িত্ব ছিল ব্যানব্যাটের ওপর। অপারেশন কমান্ডার ছিলেন মেজর জসীম। মধ্য আফ্রিকায় ব্যানব্যাট সামরিক-বেসামরিক সহযোগিতামূলক অনেক কর্মকা- পরিচালনা করে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনী) বোয়ার অঞ্চলে এক স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম উ™ে¦াধন করেন। দিনব্যাপী এ কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে লেভেল-১ হাসপাতাল স্থানীয় জনগণকে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ দেয়। তৎকালীন কন্টিনজেন্ট কমান্ডার কর্নেল এবিএম শেফাউল কবির (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল) ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল বেসেমবেলেতে মেডিকেল ক্যামপেইন উদ্বোধন করেন। ঐদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত লেভেল- ১ হাসপাতাল স্থানীয় জনসাধারণকে বিনা মূল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা দেয়। ২০১৫ সালের ৬ মার্চ বোয়ার স্টেডিয়ামে স্থানীয় মহিলাদের জন্য এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শান্তিরক্ষা মিশনের হেড অব অফিস নানা মেমবেরে। মেজর তরিকুল ইসলাম ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বোয়ার-এর একটি স্কুলে ভাষা শিক্ষা কোর্স পরিচালনা করেন। এ কোর্সে ২৭ জন নারী ও পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ২০জন প্রশিক্ষণার্থী উত্তীর্ণ হয়ে সনদপত্র লাভ করেন। সেক্টর ওয়েস্টের সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এভারিস্তে মুরেঞ্জি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সনদপত্র বিতরণ করেন। লে. হোসেন রাফিউ আহমেদের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীর একটি দল তাদের বোয়ালী ক্যাম্পের কাছাকাছি এক গ্রাম থেকে একজন বেসামরিক মুসলিম ব্যক্তিকে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করে। এই ব্যক্তির নাম আব্দুলাই মামাদু। হতভাগ্য এ ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে এন্টি-বালাকা গ্রুপ আটক করে। তাকে রক্ষার জন্য এন্টি-বালাকা গ্রুপের একজন উপদেষ্টা তাকে তার বাড়িতে আশ্রয় দেয়। কিন্তু ২০০/২৫০ জনের উত্তেজিত উচ্ছৃঙ্খল জনতা বাড়িটিকে ঘেরাও করে মামাদুকে হত্যার জন্য। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী দল খবর পেয়ে স্থানীয় প্রশাসক সুপ্রিকেকে নিয়ে ঐ বাড়িতে উপস্থিত হয়। তারা উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় এবং উত্তেজনা প্রশমন করে। এভাবে তারা মামাদুকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে এবং মেডিকেল চেক-আপের জন্য বাঙ্গুই হাসপাতালে প্রেরণ করে। ১৩ মে আমরা সকালে মধ্য আফ্রিকার রাজধানী বাঙ্গুই পৌঁছাই। বিকালে আমরা যাই ফোর্সেস হেডকোয়ার্টারে যেখানে আমাদের দলনেতা মেজর জেনারেল মোঃ সালাহ্উদ্দিন মিয়াজী মধ্য আফ্রিকায় জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি লে. জেনারেল বাবাকার গায়ের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি বাংলাদেশী জেনারেলকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানান এবং বলেন, বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব পালনে খুবই আন্তরিক, সুশৃঙ্খল এবং পেশাদার। তাদের একটা বড় গুণ হলো তারা অতি সহজে সাধারণ লোকদের সঙ্গে মিশতে পারে এবং তাদেরকে অল্প সময়ের মধ্যে আপন করে নিতে পারে। এরপর তিনি দেখা করেন ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল মার্টিন চোমু টুমেন্টার সঙ্গে। এ সময় ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার মেজর জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। ১৪ মে আমরা বোয়ার সিটি সফর করি। এখানে ব্যানব্যাট মোতায়েন রয়েছে। বোয়ার তেমন কোন বড় শহর নয়। এখানে মাত্র ৪০ হাজার লোকের বসবাস। শহরটি খুবই অনুন্নত। বাড়িঘর মাটির তৈরি কুঁড়েঘর। রাস্তাঘাট বেশির ভাগ কাঁচা। বোয়ারে আমাদের ব্যানব্যাটের কর্মকা- সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়। এরপর আমরা অংশ নেই মধ্যাহ্ন ভোজে। মধ্যাহ্ন ভোজে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন জাতিসংঘ মিশনের হেড অব অফিস ইয়াসমিনী থিয়াম। আমরা বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করি। তিনি বলেন, বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম খুবই প্রশংসনীয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশীদের আতিথেয়তা ও বন্ধুসুলভ আচরণে আমি মুগ্ধ। ঐদিন বিকেলে আমরা বাঙ্গুই ফিরে আসি। বাঙ্গুইতে অবস্থিত ফোর্সেস হেডকোয়ার্টারে আমাদের দেখা হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার তানিয়া সওগাত ও লে. কমান্ডার মির্জা রোকাইযা নূর-এর সঙ্গে। লে. কমান্ডার তানিয়া এখানে নিয়োজিত আছেন স্টাফ অফিসার (ইনটেলিজেন্স) এবং লে. কমান্ডার রোকাইয়া নিয়োজিত আছেন স্টাফ অফিসার (পার্সোনেল) হিসেবে। লে. কমান্ডার তানিয়া মধ্য আফ্রিকায় জাতিসংঘ মিশনে যোগ দেন ২০১৪ সালের ৩১ অক্টোবর এবং এর পরে আসেন লে. কমান্ডার মির্জা রোকাইয়া। লে. কমান্ডার তানিয়া বলেন, আমি বহুজাতিক পরিবেশে কাজ করতে পেরে খুবই খুশি। আমার বস হচ্ছেন, মার্কিন সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল স্টিভ স্যালট। তিনি আমার কাজে অনেক সহযোগিতা করেন। আমি তার সহায়তা নিয়ে আমার কাজগুলো খুবই সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারি। লে. কমান্ডার রোকাইয়া বলেন, আমি বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী হিসেবে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করতে পেরে খুবই সম্মানিত বোধ করছি। তবে তার মনে একটা ব্যথাও আছে। কেননা, তিনি তার ছয় বছরের শিশু সন্তান নায়ীরা ইমতিহাল রহমানকে এক বছরের জন্য দেশে রেখে এসেছেন। আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদযাত্রা ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরান মিলিটারি অবজারভার গ্রুপে (টঘওওগঙএ) ১৫ জন অবজারভার প্রেরণের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবেই বিশ^ শান্তিরক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, শৃঙ্খলাবোধ ও পেশাদারিত্বের জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সৈন্য প্রেরণকারী দেশ। বর্তমানে বিশে^র বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষা মিশনে ৫ হাজার ৪৫১ জন সেনাসদস্য নিয়োজিত আছে (মে ২০১৮)। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১ লাখ ২৬ হাজার ৮৭৬ জন সদস্য সফলতার সাথে তাদের মিশন সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে সেনাবাহিনীর ৫৫ জন মহিলা শান্তিরক্ষীও মিশনে কাজ করছেন। বিশ^ শান্তিরক্ষায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ যাবত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১১৬ জন সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং আহত হয়েছেন ২০৭ জন ( মে ২০১৮ পর্যন্ত )। বিশ^ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ ত্যাগ দেশে বিদেশে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃতি পেয়েছে। লেখক : সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর
×