ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদের কেনাকাটা

ভারত-পাকিস্তানের নিম্ন মানের জর্জেট, নেট ক্যাটালগে সয়লাব

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২৯ মে ২০১৮

ভারত-পাকিস্তানের নিম্ন মানের জর্জেট, নেট ক্যাটালগে সয়লাব

রহিম শেখ ॥ মেট্রোরেলের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে বছর ধরেই। কিছু জায়গায় তপ্ত রোদেও পানি জমে আছে। তাই ঈদ কেনাকাটায় কাক্সিক্ষত ক্রেতা নেই মিরপুর বেনারসি পল্লীতে। তবে খুচরা ক্রেতা এবং পাইকারদের আনাগোনায় মুখরিত পল্লীর কিছু কিছু দোকান। দিন-রাত একটানা কাজ চলছে প্রতিটি দোকানের নিজস্ব কারখানায়। পাশাপাশি শো-রুমগুলোতে রয়েছে ক্রেতাদের কমবেশি ভিড়। ঈদ উপলক্ষে নানান রং এবং নক্সার শাড়ি ওঠানো হয়েছে প্রতিটি শোরুমে। তবে এখানকার ব্যবসায়ীরা জানালেন, ভারত ও পাকিস্তানের জর্জেট, নেট ও ক্যাটালগ শাড়িতে সয়লাব ঈদের বাজার। তুলনামূলক দামে সস্তা এবং নিম্নমানের এসব শাড়ির কাছে মার খাচ্ছে দেশী বেনারসি, কাতান আর জামদানি। মঙ্গলবার আগারগাঁও পার হয়ে মিরপুরের দিকে যেতেই পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। দীর্ঘ সময় ধরে কাজ চলছে মেট্রোরেলের। তাই মিরপুর সেকশন ১২ পর্যন্ত দেখা গেল এই কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির দৃশ্য। এদিন ভরদুপুরে তপ্ত রোদেও এই এলাকার বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি জমে থাকতে দেখা যায়। ফলে নিত্যদিনের ভোগান্তি মাথায় নিয়ে দিন পার করছেন মিরপুরবাসী। কিন্তু এই এলাকার ব্যবসায়ীরা নানা সমস্যা সত্ত্বেও এবার ভাল বেচাকেনার আশা করছেন। বিশেষ করে মিরপুর বেনারসি পল্লীর ব্যবসায়ীরা। মিরপুর ১১ নম্বরে অবস্থিত হানিফ সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ জনকণ্ঠকে বলেন, আগে যেমন দূরের ক্রেতারা এখানে ছুটে আসতেন। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় দূরের ক্রেতারা খুব একটা আসছেন না। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মেট্রোরেলের কাজ এমনকি বড় বড় রাস্তা দখল করে ফুটপাতের কারণে চেনা পথ এখন অনেকটাই অচেনা। ছোট-বড় অনেক গলি দখল হয়ে গেছে। যেন দেখার কেউ নেই। বেনারসি পল্লীতে ঢুকতেই বেনারসি কুঠিরের স্বত্বাধিকারী রেজওয়ানা বলেন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, মেট্রোরেলের কাজ ও বৃষ্টির কারণে দোকানে ক্রেতার সংখ্যা কিছুটা কম। প্রতিবছর এই সময়টাতে যেখানে কথা বলারই সময় পাই না। সাধারণত শবে বরাতের পর থেকে বিক্রি শুরু হয়ে চাঁদ রাত পর্যন্ত চলে। তিনি বলেন, বর্তমানে ক্রেতাদের চাহিদার সঙ্গে পণ্যের ডিজাইন ও কারুকার্যের অনেক পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া বেনারসি কুঠিরের কিছু নিজস্বতার জায়গা থেকে এটার ডিজাইন ও কারুকার্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য থেকে অনেক আলাদা। কারণ আমাদের এই ডিজাইনগুলো নিজস্ব তাতে নিজস্ব ফ্যাশন ডিজাইনার ও অনেক ক্ষেত্রে বিদেশী ডিজাইনার দিয়ে কারানো হয়। ফলে এটা অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। যদিও বর্তমানে অনেক বড় বড় শপিংমল ও কিছু নামকরা ব্র্যান্ড আমাদের প্রতিষ্ঠানের পণ্য নিয়ে বিক্রি করে থাকে। ব্যবসায়ীদের মতে, গত বছরের তুলনায় এ বছরও ভারতীয় শাড়ির কদর বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতারা দেশি বেনারসি শাড়ির জন্য মিরপুরের এ পল্লীতে এলেও হরেক রকমের ডিজাইন ও মনকাড়া রঙের কারণে শেষমেশ ভারতীয় শাড়িই কিনছেন। হানিফ সিল্কের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ হানিফ বলেন, মোটামুটি ভালই বিক্রি করছি আমরা। তবে অন্যান্য বছর এই সময়ে ক্রেতাদের ভিড়ে খাওয়ার সময় পেতাম না। আর এবার সে তুলনায় একটু কম। কারণ হিসেবে তিনি জানান, ভারতীয় কিছু মানহীন শাড়ি আমাদের বাজার নষ্ট করছে। ওই শাড়িতে লাভ বেশি, কিন্তু সুতা ভাল না। ফলে ক্রেতারা কম দামে পেলেও প্রত্যাশা অনুসারে ব্যবহার করতে পারছেন না। এ জন্য আস্থা নষ্ট হচ্ছে। অনেকে এখন ভারতমুখী হয়ে পড়ছেন। এটাও ক্রেতা হ্রাসের অন্যতম কারণ। ব্যবসায়ীরা জানালেন, এবার পিওর সিল্ক, জরজেট, বিয়ের কাতান, কাতান, বেনারসি সিল্ক, কাঞ্জিবরন, ক্যাটালগ, মেঘদূতসহ বিভিন্ন ধরনের শাড়ির জনপ্রিয়তা রয়েছে। এগুলোর দাম ১২ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এছাড়া বুটিক, স্টোন, জরির বাহারি কাজের দেশীয় বস্ত্রের বিপুল সরবরাহ রয়েছে এই পল্লীতে। ঈদ উপলক্ষে সব শ্রেণীর ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রতিটি কারখানাতে বিভিন্ন দামের ও মানের শাড়ি প্রস্তুত করা হয়। বিক্রেতারা জানান, ঈদে কাতান শাড়ির চাহিদা একটু বেশি থাকে। তাদের মতে, প্রায় শতাধিক’ ধরনের পণ্য আছে তাদের দোকানে। এগুলো সবই দেশি তাঁতের তৈরি। তবে ক্রেতাদের দেশীয় পণ্যে ও ইন্ডিয়ান পণ্যের পার্থক্য বুঝাতে কিছু ইন্ডিয়ান শাড়িও রাখা আছে দোকানে বলে জানান বেনারসি রূপসিঙ্গারের ম্যানেজার মোঃ সাব্বির আহমেদ। এ বছর দোকানে বিক্রি কিছুটা কম হলেও খুব শীঘ্রই বেচানেকা জমে উঠবে বলে তিনি জানান। এখানে কাতান, বেনারসি, জামদানি, কাড়িয়াল, খাড্ডি, কাটিয়াল, বেলগাও, ন্যানো কাতান, ফুলকলি, সামার, রিভারসিভার, ওতাদ জামদানি, ইটকাট, কানিআচল, দেবদারু, সামু সিল্কসহ একাধিক শাড়ি কালেকশন রয়েছে। এগুলোর নাম শুনলে ইন্ডিয়ান পণ্য মনে হলেও এগুলো আমাদের দেশেই নিজেস্ব তাঁতের তৈরি। শুধু কিছু নাম কপি করা হয়েছে। ভারতের কিছু কিছু পণ্যের নাম যেমন আমরা কপি করি একইভাবে তারাও আমাদের দেশীয় পণ্যের অনেক নাম কপি বা নকল করেন। তিনি আরও বলেন, ভারত যতই ভাল পণ্য তৈরি করুক না কেন, আমাদের দেশী ঢাকাই জামদানি তারা কোনদিনই ১০০% মানসম্পন্ন তৈরি করতে পারবে না। বেনারসি পল্লী ঘুরে দেখা যায়, এখানে তৈরি হয় প্রিন্স কাতান, রিমঝিম কাতান, টিস্যু কাতান, মিরপুরী গিনি গোল্ড কাতান, জর্জেট গিনি গোল্ড কাতান, ফুলকলি কাতান, দুলহান কাতান, মিরপুরী রেশমি কাতান, মিলেনিয়াম কাতান, বেনারসি কসমস, অরগন্ডি কাতান, ব্রকেট কাতান, রেশমি কাতান, কাঞ্চিকুনন, গাদোয়াল, চুনরি কাতানের মতো শাড়ি। বিগবাজারের স্বত্বাধিকারী জিয়াউল হক বলেন, দোকনের বেচানেকা মোটামুটি। এটা ২৫ রোজা পর্যন্ত চলবে। আমাদের দোকানে দেশীয় শাড়ি, টাঙ্গাইল, সুতি, মসলিন, সোনারগাঁওয়ের জামদানিসহ বিভিন্ন ধরনের শাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে গিফটের শাড়ি হিসেবে টাঙ্গাইল ও সুতি শাড়ি বেশি বিক্রি হচ্ছে। এগুলোর দাম সাধারণত ১৫শ’ থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা পর্যন্ত। গাজীপুর থেকে জামদানি ও সিল্কের শাড়ি কিনতে এসেছেন আমির হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর ঈদ বা অন্যান্য অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে পরিবারের সদস্যদের জন্য এখান থেকেই শাড়ি কিনে থাকি। অন্যান্য স্থানের চেয়ে এখানকার শাড়ির মানও যেমন ভাল, তেমনি দামও কিছুটা কম। একই কথা জানালেন আরেক ক্রেতা নাসিমা রহমান। তিনি বলেন, বড় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বেনারসি শাড়ি কিনতে এসেছি। প্রথম সন্তানের বিয়েতে একটা ভাল শাড়ি না হলে কি চলে। বলতে গেলে সারা বছরজুড়েই শাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন মিরপুর বেনারসি পল্লীর শাড়ির কারিগররা। ঈদ আসলে তাদের ব্যস্ততা যেন আরও বেড়ে যায়।
×