ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাজার কোটি টাকা দেনা নিয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী পেপার মিল

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২৮ মে ২০১৮

 হাজার কোটি টাকা দেনা নিয়ে বন্ধ  হয়ে যাচ্ছে কর্ণফুলী পেপার মিল

পান্থনিবাস বড়ুয়া, রাঙ্গুনিয়া ॥ বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) নিয়ন্ত্রণাধীন চন্দ্র্রঘোনায় অবস্থিত দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কাগজ কল কর্ণফুলী পেপার মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চরম অর্থসঙ্কটে মিলটি দুরবস্থার সম্মুখীন হয়। মিলটিকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষের হরেক পরিকল্পনার কোন প্রভাব পড়েনি। বাঁশ ও কাঠের ব্যবহারে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার পাল্প উৎপাদন কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় মিলের সংশ্লিষ্ট মেশিন ও যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মিলে মজুদ থাকা ৫০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বাঁশ, বাঁশের চিপস, তৈরি পাল্প নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নো লস নো প্রফিট অবস্থানে আনার কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ পরিকল্পনায়ও ব্যর্থতার আবাস। মিলের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারী ও সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাজার কোটি টাকার দেনার বোঝা মাথায় রেখে কর্ণফুলী পেপার মিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী নদীর তীরে ১৯৫৩ সালে স্থাপিত হয় এই মিল। স্বাধীনতাত্তোর সরকারীভাবে মিলের পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। চলতি দশকে মিলের উৎপাদন অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পায়। আর্থিক দৈন্যতায় চরম দূরাবস্থার শিকার হয়। অভিজ্ঞ মহলের মতে প্রাচীন এই মিলটির অনেক প্ল্যান্ট ইউনিট ও মেশিনারি ইক্যুইপমেন্টস ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা রাখে। তার উপরও কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনায় ওভারহলিং, যন্ত্রপাতি পুনঃস্থাপন ও সংস্কারসহ রক্ষাণাবেক্ষণের একাধিক কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটে এক পর্যায়ে মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মিলের উৎপাদন চালু করতে চাহিদার অর্থের অনুমোদনও পায়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে অবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি। লোকসান ঠেকিয়ে মিলকে একটি পর্যায়ে অবস্থান করানোর পরিকল্পনায় নো লস নো প্রফিট কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এতে ব্যাপকহারে লোকবল হ্রাস করা হয়। দৈনিক ৫০ টন কাগজ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে ছেড়া কাগজের মন্ডে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালানো হয়। কর্তৃপক্ষের এসব কোন পরিকল্পনাতেই সফলতা আসেনি। অনিয়ম দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা শিকারে চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হয় মিল। গত প্রায় ১ মাস ধরে মিলের উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। গ্যাস লাইনে বিষ্ফোরণে সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ায় মিল বন্ধ হয়ে যায়। সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে বিশালাকার কর্ণফুলী পেপার মিলে শিল্পের পরিবেশ নাই। নাই যান্ত্রিক কোলাহল। শ্রমিক কর্মচারীদের পদচারণা এবং কর্মচঞ্চলতা থমকে গেছে। মিলের বিভিন্ন বিভাগে ভুতুরে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শ্রমিকেরা নিয়মিত বেতন পায় না। অবসরে যাওয়া অনেক শ্রমিক কর্মচারীর প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং সার্ভিস গ্রাসুয়েটির কোটি কোটি টাকা পরিশোধ হয়নি। মিলের বাঁশ কেন্দ্র এবং কাপ্তাই চিপার হাউজে সংগৃহীত বহু বাঁশ কাঠ পঁচে যাচ্ছে। জেঠিতে মিলে গ্রহণের অপেক্ষমাণ লক্ষ লক্ষ বাঁশের চালি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্মরত শ্রমিকেরা জানায়, দীর্ঘদিন ধরে মিলে সবুজ কাঁচামালের স্বাভাবিক উৎপাদন প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে। তাই বাঁশের ব্যবহার হচ্ছে না। এদিকে বাঁশ কাঠ সংগ্রহ বন্ধ থাকায় সংশ্লিষ্ট মিলে সরবরাহে নিয়োজিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো চরম দুরবস্থায় সম্মুখীন হয়েছে। পাহাড়ে বাঁশ কাঠ আহরণে জীবিকার সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার দিনমজুর বেকার হয়ে পড়েছে। মিলের সবুজ কাঁচামাল সরবরাহকারী ঠিকাদার সমিতির সভাপতি বাবুল বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক জমির উদ্দিন জানান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শতকোটিরও বেশি টাকা পাওনা পরিশোধ না করে আটকে রাখা হয়েছে। তারা বলেন, দক্ষ ব্যবস্থাপনায় মিল ঘুড়ে দাঁড়াবার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাম্ভাব্য সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। শ্রমিক কর্মচারী প্রতিনিধি সিবিএ নেতৃবৃন্দ জানান, মিলের প্রায় সহস্র শ্রমিক কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। মিলের উন্নয়নের স্বার্থে এতদজনিত হয়রানি বঞ্চনা সহ্য করেছে শ্রমিকেরা। কিন্তু নির্বিঘœতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অসাধু কতৃপক্ষ মিল ধংসের পরিকল্পনাকেই সফল করতে চলেছে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলে বেসরকারী মিল ও আমদানিকৃত কাগজের একচ্ছত্র বাজার সৃষ্টিতে কর্ণফুলী পেপার মিল বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করছে। মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আব্দুল কাদের জানান, আর্থিক দুরাবস্থার কারণে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মিলের উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু করণে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার এবং বিসিআইসি প্রতিশ্রুত অর্থ পুরোপুরি ছাড় পাওয়া যায়নি। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে মিলের উৎপাদন বিভাগের জনৈক কর্মকর্তা বলেন, বাজারে বেসরকারী মিলের বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতে অসাধু কতৃপক্ষের যোগসাজসে কর্ণফুলী পেপার মিল বন্ধের ষড়যন্ত্র চলছে। সম্প্রতি গণ বদলিতে এই মিলের লোকবলও ব্যাপকহারে হ্রাস করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শাখা প্রশাখা এবং অসংখ্য ছড়া ঝিঁরির সংযুক্ত কর্ণফুলী নদী। প্রাকৃতিক এই মেল বন্ধন পার্বত্য চট্টগ্রামের পত্যন্ত এলাকার সঙ্গে নদী ও পাহাড় বনাঞ্চলের পরস্পর প্রাণের সম্পর্ক বিরাজমান। লুসাই পাহাড়ের পানি কর্ণফুলীর প্রবাহে প্রাণের স্পন্দন যোগায়। শাখা ও ছড়া ঝিঁরির মাঝে নদীর সে প্রবাহের বিস্তৃতি বন পাহাড়ের গোড়ায় নদীর শীতল জলের স্পর্শ বনাঞ্চলের বৃক্ষরাজি জীবন পায়। নদীতে প্রত্যন্ত পার্বত্য এলাকায় নৌ যোগাযোগের জন্য রয়েছে প্রাকৃতিকগত উপায় । চন্দ্রঘোনা হয়ে শর্পিল কর্ণফুলী নদী কয়েকটি উপজেলা শহর নগরের পাশ হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। বনাঞ্চলের বাঁশ ও কাঠের সবুজ কাঁচামাল এবং নৌপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগ সুবিধার উপর নির্ভর করে পার্বত্য অঞ্চলের প্রান্ত সীমানা চন্দ্রঘোনায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে স্থাপিত হয় ব্যাপক সম্ভাবনাময় কর্ণফুলী পেপার মিল। মিলে উৎপাদিত উন্নতমানের পাল্প তথা কাগজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। দেশের কাগজের চাহিদার সিংহভাগই এই মিলের উৎপাদন থেকে যোগান হয়ে আসছিল। অদক্ষতা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মিলটি ক্রমেই দুরাবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। অথচ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা এবং আন্তরিক হলেই মিল লাভবানের ব্যাপক সম্ভাবনা এখনও বিরাজমান। বেসরকারী মালিকানায় কর্ণফুলী পেপার মিল ব্যাপক উৎপাদন সাফল্যে প্রতিবছর প্রচুর মুনাফা অর্জনে সক্ষম হবে।
×