ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিস্তা নিয়ে অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছেন মমতা ব্যানার্জী

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৮ মে ২০১৮

  তিস্তা নিয়ে অনড় অবস্থান থেকে সরে এসেছেন মমতা ব্যানার্জী

উত্তম চক্রবর্তী ॥ প্রকাশ্য ঘোষণা না এলেও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তাসহ অমীমাংসিত ইস্যু সমাধানে বরফ গলতে শুরু করেছে। তিস্তা চুক্তি নিয়ে আগের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে কিছুটা হলেও নরম মনোভাব প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও ভারত সরকার আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে এও আশ্বাস দেয়া হয়েছে দ্রুতই খুলবে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তার জট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুদিনের ভারত সফরে একদিকে দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্বের সামনে ‘মডেল’ হিসেবে যেমন আবির্ভূত হয়েছে, অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুসহ এ দুদেশের মধ্যে এখনও যেসব সমস্যা আছে, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমেই তার সমাধানের পথও প্রশস্ত হয়েছে। দুদেশেরই জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশ দুটির প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইতিবাচক বৈঠক দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করবে বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক অভিজ্ঞ মহল। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে আশ্বাস দিয়েছেন, সরকার সে আশ্বাসের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এ সম্পর্ক দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে দুদেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের মধ্যে আলোচনায় প্রধান্য পায় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা তিস্তা ইস্যুটি। তবে এবারের প্রধানমন্ত্রীর সফরটি ছিল ভারতের রাজধানী দিল্লীমুখী নয়, পশ্চিমবঙ্গে। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতীতে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন এবং বর্ধমান জেলার আসানসোলে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে দেয়া ডি. লিট ডিগ্রী গ্রহণের জন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যান। বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিন্ন কণ্ঠে উঠে এসেছে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা বিদ্যমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানের মাধ্যমে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে একান্ত বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তি ও রোহিঙ্গা ইস্যুটিও স্থান পেয়েছে বলে দুদেশের কূটনৈতিক সূত্রই জানিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যে আগের অবস্থানে নেই সে কথা বেশ স্পষ্ট করেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা এবং উদ্বাস্তুদের মিয়ানমারে ফেরত প্রদানে ভারত সরকার বাংলাদেশের পাশেই থাকবে এমনটাও আশ্বাস মিলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে। বিশেষ করে শনিবার সন্ধ্যায় কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী একান্ত বৈঠকে তিস্তা ইস্যুতে আগের অনড় অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মুখে স্পষ্ট করে কিছু না বললেও বৈঠকের পর মমতা ব্যানার্জী সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সেক্ষেত্রে তিস্তা নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি হলে তিনি তা নিয়ে বিরোধিতা নাও করতে পারেন। যদিও বৈঠকের পর মমতা ব্যানার্জী সাংবাদিকদের বলেন, দুই বাংলার নানা ইস্যুতে সফল ও ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না এ প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, দুই বাংলার উন্নয়ন ঘিরে সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। আর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কোন রাজনৈতিক সীমানা আছে বলে আমার জানা নেই। তাই আজ দুদেশের সম্পর্ক উন্নতি করা নিয়ে আমাদের বিস্তারিত কথা হয়েছে। দুদেশের সব বিষয়ে নিয়ে আমরা সব সময় তো কথা বলি। সম্পর্ক ভাল হোক, এ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এদিনও আমাদের অনেক আলোচনা হয়েছে। তাই আলোচনা সবকিছু পজিটিভ এটাই বলতে চাই। এর বাইরে কিছু বলতে চাই না। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে আছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। দুদেশের শীর্ষ পর্যায়ে মতৈক্য থাকলেও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া চুক্তিটি সই করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে দ্রুতই তিস্তার জট খুলবে। চুক্তির পর তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাবে বাংলাদেশ। ভারত সরকারের এমন আশ্বাসের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ একান্ত বৈঠকের পর মমতা ব্যানার্জী তার আগের অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরে এসে নমনীয় অবস্থান প্রকাশ করেছেন বলেও কূটনৈতিক মহল থেকে আভাস পাওয়া গেছে। ভারতের কূটনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের মতে, দুদেশেরই জাতীয় নির্বাচন সন্নিকটে। ভারতের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খুব একটা ভাল নয় পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জীর। রাজনৈতিক কারণেই বিজেপি সরকারের কোন অনুরোধ সহজেই মমতা ব্যানার্জী যে মেনে নেবেন না, এটিও সবার জানা। তাঁদের মতে, কংগ্রেসের পর বিজেপি সরকারও বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও শক্ত বাঁধনে বাঁধতে তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তির পক্ষে জোরালো অবস্থান নিলেও শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, লাভ-লোকসানের অঙ্ক আর আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সহসাই যে তিস্তা সমস্যা আলোর মুখ দেখবে না এটিও জানা সবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও এ সমস্যার কথা ভারত সরকারের তরফ থেকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর প্রায় ৪০ মিনিটব্যাপী একান্ত বৈঠকে তিস্তা ইস্যুতে জমে থাকা কঠিন বরফ কিছুটা হলেও গলতে শুরু করবে বলেই তাদের ধারণা। এবারের সফরে আলোচনায় তিস্তাসহ কোন ইস্যুই নির্ধারিত না থাকলেও দ্বিপক্ষীয় এবং প্রকাশ্য আলোচনাপর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যই তিস্তা-রোহিঙ্গা ইস্যুটি বেশ স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছেন ভারত সরকারের কাছে। শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দুদেশের (বাংলাদেশ ও ভারত) মধ্যে বহু সমস্যার সমাধান হয়েছে। কিছু সমস্যা এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে, তবে আমি সেসব বিষয় তুলে এই সুন্দর অনুষ্ঠানকে ম্লান করতে চাই না। তিস্তা শব্দটি উচ্চারণ না করেও এভাবেই তিস্তা পানিবণ্টন ইস্যুটি তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বেশ স্পষ্ট করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তুলে ধরে এ ব্যাপারে ভারতকে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রিত। শুধু মানবিক দিকে বিবেচনা করে সাময়িকভাবে এত বিপুলসংখ্যক মিয়ানমার নাগরিককে আশ্রয় দিতে হয়েছে। আমরা দ্রুততার সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চাই। মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে হবে। আমাদের দুই দেশকে অবশ্যই মিয়ানমারকে তাদের ফিরিয়ে নিতে বলতে হবে। দুদেশের কূটনীতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রকাশ্য বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছু না বললেও দিপক্ষীয় একান্ত বৈঠকে এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা জানিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনের সময়ও দিপক্ষীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত যে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে, রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য ভারত সরকার আরও বৃদ্ধি করবে একথাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এ ইস্যুতে ভারত যে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে তার জোরালো প্রমাণ মেলে ওই সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে গৃহীত যৌথ ঘোষণায় ভারতও সমর্থন দেয়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় অত্যন্ত দৃঢ় ও শক্ত অবস্থানে তা খোদ দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথায় উঠে আসে। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, পরস্পরের বিকাশে সহযোগিতা করছে তা অন্যদের জন্যও একটি শিক্ষা, একটা উদাহরণ। প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যে আপনাদের মতো ভারতীয় জনগণও সমানভাবে খুশি। তাই শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছেন, তা অর্জনে ভারতের ‘পূর্ণ সমর্থন’ থাকবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন মোদি। জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়ে বিশ্বের কাছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ‘মডেল’ হিসেবে আবির্ভূত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, প্রতিবেশী এ দুদেশের মধ্যে এখনও যেসব সমস্যা আছে, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের মাধ্যমেই তার সমাধান হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ভারত সফরকালে ভারতের ভূখন্ড অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবন নির্মাণ, আসানসোলের কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডি-লিট ডিগ্রী প্রদান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলেই আশা করছেন দুদেশের অভিজ্ঞ মহল।
×