মোরসালিন মিজান ॥ বাংলাদেশটা, বলা চলে, ফুটবলের ছিল। এই খেলা নিয়ে কত উত্তেজনা। উন্মাদনা। সারা দেশের প্রতি প্রান্তে ছিল ফুটবল। এমনকি খেলার মাঠের লড়াই ছড়িয়ে পড়ত গ্রামগঞ্জে। শহরে ছিল একইরকম ঢেউ। খেলা দেখার জন্য টিকেট নিয়ে কাড়াকাড়ি ছিল। অথচ হায়, আজ কী হয়ে গেল! ফুটবলের সেই জৌলুস আর নেই। কিন্তু খেলাটি নিয়ে বাঙালীর যে আবেগ, সে তো মিথ্যা নয়। বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮ ভেতরের প্রেমটুকুকে নতুন করে জাগিয়ে দিয়েছে। ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ সামনে রেখে শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের নিজের দল নেই। তবে যথারীতি আছে আর্জেন্টিনা/ব্রাজিল। এ দুই দলের ভক্তরা এরই মাঝে উৎসবের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। অন্যান্য দেশের সমর্থকও আছে কিছু। তারাও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরই মাঝে উড়তে শুরু করেছে প্রিয় দলের পতাকা। চলছে দলের প্রতি ভালবাসা প্রকাশের বিচিত্র প্রতিযোগিতা। প্রায় সব আড্ডায় এখন আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চলন্ত বাস, চায়ের দোকান সর্বত্র গরমাগরম অবস্থা। কার দল কেন শ্রেষ্ঠ সে তর্ক একবার শুরু হলে আর থামতে চাইছে না। এভাবে শুরুর আগেই শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপ ফুটবল।
আর কিছুদিন পর আগামী ১৪ জুন থেকে রাশিয়ায় শুরু হচ্ছে দ্য গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ। চতুর্বার্ষিক আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা। এবার বসছে ২১তম আসর। মাসব্যাপী আয়োজনের ফাইনাল আগামী ১৫ জুুলাই। বরাবরের মতো ৩২ দেশ অংশ নিচ্ছে বিশ্বকাপে। মাত্র ৩২ দেশ খেললেও, সারাবিশ্ব মহারণে যোগ দেবে। যে যার পছন্দের দলের পক্ষে প্রচার চালাবে। উৎসবে মাতবে।
তবে নরম পলিমাটির বাংলাদেশে মানুষের মনও নরম। বিশেষ আবেগী। ফলে এখানে আগেভাগেই ছড়াতে শুরু করেছে উত্তেজনা। প্রথমেই আসে পতাকার কথা। এখন বিভিন্ন বাসা বাড়ির ছাদে উড়তে দেখা যাচ্ছে প্রিয় দলের পতাকা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সমর্থক আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের। আর্জেন্টিনা দলের জ্যার্সি থেকে সাদা ও আকাশী রং নিয়ে মজার সব কা- করছেন সমর্থকরা। আর ব্রাজিল সমর্থকরা সব কাজে ব্যবহার করছেন সবুজ ও হলুদ রং। ইংল্যান্ড ফ্রান্স স্পেন জার্মানি পর্তুগালসহ আর কিছু দেশের অস্তিত্বও চোখে পড়ছে। সবই যে যার পছন্দ মতো পতাকা ওড়াচ্ছেন। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সমর্থক আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের। আর্জেন্টিনা দলের জার্সি থেকে সাদা ও আকাশী রং নিয়ে মজার সব কা- করছেন সমর্থকরা। আর ব্রাজিল সমর্থকরা সব কাজে ব্যবহার করছেন হলুদ রং। ইংল্যান্ড ফ্রান্স স্পেন জার্মানি পর্তুগালসহ আর কিছু দেশের অস্তিত্বও চোখে পড়ছে। বর্তমানে সারাদেশ থেকেই আসছে বিশালাকার পতাকা বানানো, ওড়ানো ও র্যালি বের করার খবর।
জানা যায়, বাগেরহাটে ৮শ’ ফুট লম্বা পতাকা তৈরি করেছে ‘বাদোখালী আর্জেন্টিনা সমর্থক গোষ্ঠী।’ পতাকা নিয়ে গত ২৫ মে সকালে বাদোখালী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ থেকে র্যালি বের করা হয়। মুন্সীগঞ্জের সরকারী হরগঙ্গা কলেজের শিক্ষার্থী সজীব হোসেন ও স্থানীয় অটোরিক্সা চালক আলামিন হোসেন ৫৪০ ফুট দীর্ঘ আর্জেন্টিনার পতাকা বানিয়েছেন। পতাকাটি বানাতে তাদের খরচ পড়েছে ৮ হাজার টাকা। আর্জেন্টিনার সমর্থকরা ২৪ মে মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে অবস্থান করে এই পতাকাটি প্রদর্শন করেন। কুষ্টিয়ার মিরপুরে আর্জেন্টিনার সমর্থকরা তৈরি করেছেন ২৭০ ফুট লম্বা পতাকা। ২৭ মে সকালে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের আমলা উত্তরপাড়া যুবসংঘের সদস্যরা এ পতাকা প্রদর্শন করেন। ব্রাজিলের সমর্থকরা আরও বড় আকারের পতাকা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন, অনুমান করা যায়।
ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত রাজধানী ঢাকাও। বিভিন্ন বাড়ির ছাদে প্রিয় দলের পতাকা উড়তে শুরু করেছে। গত কয়েকদিন মিরপুর আগারগাঁ শান্তিনগর শনির আখড়া শেওড়াপাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কোন বাসার ছাদে ব্রাজিলের পতাকা। কোনটিতে আর্জেন্টিনার। একই ভবনে একাধিক পরিবার বাস করে। তাই ছাদে বিভিন্ন রঙের পতাকাও উড়ছে।
রবিবার ফার্মগেট এলাকা দিয়ে হেঁটে আসার সময় ওপরের দিকে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া। সেজান পয়েন্টের ছাদে ব্রাজিল আর্জেন্টিনার অগণিত পতাকা। সামান্য বাতাসেই দারুণ উড়ছে। পতাকার সুনির্দিষ্ট মাপ অনুসরণ করা হয়নি। বিভিন্ন মাপের পতাকা তৈরি করে একটির ওপর অন্যটি বেঁধে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি উড়ছে চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের পতাকা। একটি দোকানের ম্যানেজার আলী বললেন, কাস্টমার না থাকলে বিশ্বকাপ নিয়েই আলোচনা হয় বেশি। আমাদের মার্কেটে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সাপোর্টার প্রায় সমান সমান। সমর্থকদের উদ্যোগেই ছাদে পতাকা ওড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
আগের দিন শনিবার সন্ধ্যায় বিশাল পতাকা নিয়ে র্যালি করেছেন পুরান ঢাকার তরুণেরা। আর্জেন্টিনার পতাকা নিয়ে শাহবাগ হাইকোর্ট হয়ে বঙ্গবাজারের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায় তাদের। উদ্যোক্তাদের একজন আরিফ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, জন্মের পর থেকে আমি আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। বন্ধুরাও আর্জেন্টিনার সাপোর্ট করে। আমরা সবাই মিলে টাকা দিয়ে পতাকা তৈরি করেছি। সমমনাদের জাগাতেই পতাকা র্যালি বলে জানান তিনি।
এদিকে, কার পতাকা কত বড়- পরিমাপ করা হচ্ছে। যার পতাকা বড়, তার দল আপাতত এগিয়ে। কোন কোন পতাকা আবার লম্বায় বাড়ির সমান! ছাদ থেকে ছেড়ে দেয়া পতাকা নিচতলা পর্যন্ত নেমে এসেছে।
পতাকার চাহিদা বেশি হওয়ায় বেড়ে গেছে বিক্রেতার সংখ্যা। এখন গোটা শহরে ফেরি করে পতাকা বিক্রি হচ্ছে। নিজের দেশের প্রতি সম্মান জানাতে সবার ওপরে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশের পতাকা। নিচে থাকছে ব্রাজিল আর্জেন্টিনাসহ অন্য দেশের পতাকা। যার যেটি পছন্দ সেটি হাত বাড়িয়ে কিনে নিচ্ছেন। আমিনুল নামের এক বিক্রেতা জানান, ব্রাজিল আর্জেন্টিনার পতাকাই বেশি বিক্রি হচ্ছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ পতাকা নিয়ে বের হন সবই বিক্রি হয়ে যায়। আর কয়েকদিন পর বিক্রি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
প্রিয় দলের জ্যার্সি গায়ে বাসা থেকে বের হওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। জ্যার্সির পাশাপাশি অনেকেই আবার হাতে নিজ দলের পতাকা সংবলিত ঘড়ি ব্যবহার করছেন।
আলাদা করে বলতে হয় ফেসবুক ব্যবহারকারীদের কথা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। অপেক্ষাকৃত তরুণরা ইতোমধ্যে ফেসবুকের কাভার ছবিতে প্রিয় দলকে স্থান দিয়েছেন। কেউ প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবি দিয়েছেন নিজের প্রোফাইলে। নিউজ ফিডে ঘুরে ফিরেই আসছে ফুটবল। বাহাস চলছে। একদলের সমর্থকরা অন্য দলকে নিয়ে মজা করছেন। ফান পোস্ট দিচ্ছেন। কোন কোন সময় বাড়াবাড়িও হয়ে যাচ্ছে। এই বাড়াবাড়িটুকু বাদ দেয়া গেলে আরও উপভোগ্য হবে বিশ্বকাপ। এ ব্যাপারে একটু সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সচেতন ফুটবলপ্রেমীরা।