ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. এম এ কাসেম

প্রসঙ্গ ড্রেজিং ॥ শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়ন

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২৮ মে ২০১৮

প্রসঙ্গ ড্রেজিং ॥ শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়ন

বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন ব্যাখ্যা করে বিগত ২৩ এপ্রিল ২০১৮ দৈনিক জনকণ্ঠে ‘বাংলাদেশের নদী পুনরুজ্জীবনে ড্রেজিং- শেখ হাসিনার ভিশন’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। ওই নিবন্ধের অনুবৃত্তিতে আমার বর্তমান নিবন্ধ। সম্মানিত পাঠকবর্গের সুবিধার জন্য বিগত নিবন্ধের দুটি বিষয় উল্লেখ করে এই নিবন্ধ শুরু করছি। প্রথমত. প্রধানমন্ত্রীর ভিশনের মূল কথা- বন্যা এবং নদী ভাঙ্গন থেকে বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষকে রক্ষা, কৃষি কাজে সুব্যবস্থা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং নদীর স্বাস্থ্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জালের মতো বিস্তৃত বাংলাদেশের নদ-নদী-খাল-বিল (রিভার সিস্টেম) পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। এ জন্য তিনি ড্রেজিংয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। দ্বিতীয়ত. নদী-জাল (রিভার সিস্টেম)কে পুনরুজ্জীবিত করতে ও চালু রাখতে হলে এবং বিলীন হওয়া এবং অস্তিত্ব সঙ্কটে নিমজ্জিত বড়-মাঝারি-ছোট শত শত নদ-নদীসহ অভ্যন্তরীণ খাল-বিল খনন করতে হবে। মৃতপ্রায় এবং হারিয়ে যাওয়া এসব নদীকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং চালু রাখার মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা ব্যাপক ড্রেজিং ছাড়া সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর ভিশনের আরেকটি দিক- নদী ভাঙ্গন রোধ এবং নদীর তীর ও গর্ভ থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার করা। এক্ষেত্রেও ডেজিং ছাড়া চলবে না। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন তাঁর ভিশনকে পুরোপুরিভাবে আত্মস্থ করা। আমি ভিশন আত্মস্থ করার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করছি; কারণ ভিশন (বাংলাদেশের নদী-জাল পুনরুজ্জীবিত করা এবং এ জন্যই ড্রেজিং) অনুধাবন করা না গেলে ড্রেজিংয়ের পরিকল্পনাই হবে, কিন্তু ভিশন রূপায়িত হবে না। যেমনটা হয়েছে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্ল্যান প্রণয়নের ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থানের জন্য ২০১৬ সালে ২৪টি বড়-মাঝারি নদ-নদী ড্রেজিং করার জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ৯ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় সংবলিত একটি ড্রেজিং প্রকল্প (ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প) প্রস্তুত করা হয়েছে- হয়ত অনুমোদিতও হবে। ড্রেজিং প্রকল্প হয়েছে বটে! কিন্তু প্রশ্ন হলো- লাখ লাখ-কোটি টাকা ব্যয় করে ২৪টি বড়-মাঝারি নদ-নদী ড্রেজিং করলেই শত শত মৃতপ্রায় এবং হারিয়ে যাওয়া এসব নদী পুনরুজ্জীবিত হবে কি? না, হবে না। তাই সর্ব প্রথম প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর ভিশন যথার্থভাবে অনুধাবন করে বাংলাদেশের নদী-জাল পুনরুজ্জীবনের জন্য (Revival of river network) এমন একটি মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা- যার লক্ষ্য হবে- অসংখ্য বড়-মাঝারি-ছোট নদ-নদী এবং ছোট-বড় অভ্যন্তরীণ খাল-বিল দ্বারা বিন্যস্ত বাংলাদেশের নদী-জাল (River network)কে পুনরুজ্জীবিত করা এবং চালু রাখা । অনুরূপভাবে, ভিশন নিয়ে বিভ্রান্তি প্রাথমিক পর্যায়ে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ প্রণয়নের ক্ষেত্রেও ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্ল্যান (জিরো ড্রাফট) পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়েছিল- মতামতও দিয়েছিল। আশা করি, চূড়ান্ত প্ল্যানে প্রধানমন্ত্রীর ভিশন প্রতিফলিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের (ডেল্টা অঞ্চল) উন্নয়ন এবং ভূমি পুনরুদ্ধারের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তারই অনুবৃত্তিতে পরবর্তীতে অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের একটি ডাচ কারিগরি বিশেষজ্ঞ মিশন বাংলাদেশে আসে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ‘ডেল্টা উন্নয়ন প্রকল্প’ (১৯৭৭) ও ‘ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ (১৯৭৭) শুরু হয়। দুঃখের বিষয়, বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পরে ইতিহাসের চাকা উল্টোপথে চলতে থাকে। তঁাঁর মৃতুর পরে ওই উদ্যোগ পূর্ণাঙ্গতা লাভ করতে পারেনি। এই দুই প্রকল্পের সঙ্গে গোড়া থেকেই দীর্ঘ ১৫ বছর আমি জড়িত ছিলাম। প্রায় ৪০ বছর পর বঙ্গবন্ধুু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব-দ্বীপ এলাকার বিশেষ বৈশিষ্ট্যক (ব-দ্বীপ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, রিভার সিস্টেম, জীবন ও জীবিকা, কৃষি ব্যবস্থা, অর্থনীতি, সংস্কৃৃতি) প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি প্ল্যান (ডেল্টা প্ল্যান) প্রণয়ন করার জন্য। প্রধানমন্ত্রীর ভিশন বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে দুটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত. একটি সামগ্রিক ও সমন্বিত পরিকল্পনা; দ্বিতীয়ত. পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ বাস্তবায়ন কাঠামো ও দক্ষ নেতৃত্ব। এই দুইয়ের বিকল্প নেই। প্রথমে সামগ্রিক এবং সমন্বিত পরিকল্পনার বিষয়টি। বাংলাদেশের নদী-জাল পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা কেবল গতানুগতিক ও কেতাবী ফরম্যাট অনুযায়ী শহরে বসে স্যাটেলাইট ম্যাপ দেখে আর নিয়ম রক্ষার ফিল্ড ভিজিট করে হবে না। স্থানীয় অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তব অবস্থা (নদীর অতীত, বর্তমান এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যত) বিবেচনা করে এবং অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে পরিকল্পনা করতে হবে। স্থানীয় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার ব্যবহার ছাড়া এই জাতীয় প্ল্যানের ফলপ্রসূতা বিষয়ে নিশ্চিতভাবেই অনিশ্চয়তা থেকে যাবে। এলাকার নদী-বিল-খালের ইতিহাস এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের জ্ঞান অতি মূল্যবান। সেই জ্ঞানকে আমরা উপেক্ষা করে মাঠ পর্যায়ের প্ল্যান করি বলেই দেখা যায় : স্লুইস আছে-পানি নাই, কালভার্ট/ব্রিজ আছে- নদী-খাল বা সংযোগ রাস্তা নেই। নেদারল্যান্ডসে আমার শিক্ষক প্রফেসর বি. ভেরউভেন (বিশ্বের একজন প্রখ্যাত কৃষি বিশেষজ্ঞ) বলতেন, ‘যে কোন জটিল সমস্যা-যাদের সমস্যা, তাদেরই জিজ্ঞাসা করবে সমাধান কিভাবে হতে পারে, তারাই তোমাকে ক্লু দেবে। সেটাতে তোমার অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান ব্যবহার কর। সর্বদা স্মরণ রাখবে যে, স্থানীয় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই।’ এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, স্থানীয় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আহরণেরও একটা মূল্য আছে। আমরা উপদেষ্টাদের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করি। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয়-প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়নে স্থানীয় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আহরণ, কিংবা জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ রাখা হয় না। তাদের সামান্য সম্মানী দিতে আমাদের প্রচ- অনীহা; না দেয়ার পক্ষে নানা ধরনের অজুহাত বের করতে অসুবিধা হয় না। এবার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ বাস্তবায়ন-কাঠামো ও দক্ষ নেতৃত্বের বিষয়টি। ড্রেজিং প্রকল্পের মতো একটি মেগা-প্রকল্পের বাস্তবায়নে অনেক সমস্যা এবং জটিলতার মধ্য দিয়ে এগোতে হবে; পথটি মোটেও মসৃণ হবে না। যেমন একটি অমসৃণ পথ পাড়ি দিতে হলে ভাল গাড়ি প্রয়োজন তেমনি একজন দক্ষ গাড়ি চালকও অপরিহার্য; অন্যথায় মঞ্জিলে পৌঁছা যাবে না; অর্থাৎ নদী-জাল পুনরুজ্জীবন হবে না। তাই ভিশন (পরিকল্পনা) বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ অনুকূল বাস্তবায়ন কাঠামো এবং সঠিক ও দক্ষ নেতৃত্ব চাই; নচেৎ, পরিকল্পনা ভাল হলেও বাস্তবায়ন হবে না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বর্তমান কাঠামোকে অন্যান্য নিয়মিত কর্মকান্ডের সঙ্গে এত বিশাল কর্মকান্ড যুক্ত হলে পাউবোকে দিয়ে এ কাজ efficient এবং effectively হবে কিনা? এ বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেতৃত্ব এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নেতৃবৃন্দকে আত্মবিশ্লেষণ করে- সংগঠনের বিস্তৃতি ও প্রমোশনের সম্ভাবনা-বিষয়ের উর্ধে উঠে ভাবতে হবে। মন্ত্রণালয়ে এবং পাউবোর নেতৃত্বের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন বলেই তাঁর দফতরের মহাপরিচালক (প্রশাসন)কে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ প্রদান করেন এবং গভীর আশাবাদ নিয়ে বর্তমান ডিজিকে চাকরির মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। পরিশেষে, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং পরিচালনা পরিষদসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের টপ ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে দুুুই-একটা মন্তব্য উল্লেখ করে বর্তমান নিবন্ধ শেষ করব। প্রথমত. পাউবো গঠন করা হয় ১৯৫৯ সালে, আজ ২০১৮ সাল। বাংলাদেশের ‘পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষিত’ ল্ডুগ মিশন রিপোর্ট প্রণয়ন (১৯৫৭) এবং আইকো মাস্টার প্লান প্রণয়ন (১৯৬২-৬৪)-এর সময় থেকে বর্তমান সময়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সমগ্র বিশ্বে পানি সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা পদ্ধতি, ডিজাইন ভাবনা এবং নির্মাণ কৌশল দীর্ঘ ৬০ পর্বের অবস্থায় দাঁড়িয়ে নেই- বিপুল পরিবর্তন হয়েছে। এই সুদীর্ঘ ৬০ বছর পাউবোর নিজস্ব মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি, চাল-চলনের ধরন, পরিচালনা পদ্ধতি- এক কথায় নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। পরিচালনা পরিষদসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সব পর্যায়ে উল্লিখিত সব ক্ষেত্রেই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে- আধুনিকায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত. বিশেষ গুরুত্বারোপ করতে হবে টপ ম্যানেজমেন্টের জন্য ম্যানেজমেন্ট knowledge, ম্যানেজমেন্ট ঃ technique, ম্যানেজমেন্ট skill (communication skill তো বটেই), অর্জনের জন্য স্বল্প মেয়াদী Tailor-made প্রশিক্ষণের ওপর। টপ ম্যানেজমেন্ট সদস্যদের ম্যানেজমেন্ট skill অর্জনের জন্য স্বল্প মেয়াদী Tailor-made প্রশিক্ষণ একান্তভাবে অপরিহার্য। লেখক : সদস্য, জাতীয় পানি সম্পদ কাউন্সিল, সাবেক মহাপরিচালক, ওয়ারপো
×