ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতি সমিতির সোয়া ১২ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ২৭ মে ২০১৮

অর্থনীতি সমিতির সোয়া ১২ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রায় সোয়া ১২ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। যা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে প্রায় আড়াইগুণ বেশি। প্রস্তাবিত এই বাজেটের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘আমাদের প্রস্তাবিত বাজেট যুক্তিসঙ্গত এবং তা দেশের অন্তর্নিহিত শক্তির বিচারে যৌক্তিক।’ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৮-১৯’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। লিখিত আকারে এ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। সংবাদ সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ এফসিএ। ঢাকার পাশাপাশি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি কর্তৃক প্রস্তাবিত এই বিকল্প ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট একযোগে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রেসক্লাবের সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বারকাত। কোন ধরনের বৈদেশিক ঋণ ছাড়াই এ বাজেট বাস্তবায়নের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি জানান, আমাদের প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে বৈদেশিক ঋণের কোন ভূমিকা থাকবে না। অধ্যাপক বারকাত বলেন, আমাদের বিকল্প বাজেটের ৮১ শতাংশ বা ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮২০ কোটি টাকার জোগান দেয়া হবে রাজস্ব আয় থেকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা, যা আদায় করাও চ্যালেঞ্জ মনে করছিলেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। অর্থনীতি সমিতি প্রস্তাবিত বাজেটের ১৯ শতাংশ বা ২ লাখ ২৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার ঘাটতির ১ লাখ কোটি টাকা বা ৪৪ শতাংশ অর্থ সরকারী-বেসরকারী যৌথ অংশীদারিত্ব থেকে আনার পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। তারা বলছেন, বন্ড বাজার থেকে আসবে ঘাটতি বাজেটের ২১ শতাংশ বা ৪৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া হবে ৬০ হাজার কোটি টাকা বা ২৭ শতাংশ এবং দেশীয় ব্যাংক ঋণ থেকে নেয়া হবে ৯ শতাংশ বা ২০ হাজার কোটি টাকা। লিখিত বক্তব্যে আবুল বারকাত বলেন, প্রস্তাবিত ১২ লাখ ১৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বিকল্প বাজেটের অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন খাতে যাবে ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব আয় থেকে আসবে ৯ লাখ ৯০ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বারকাত বলেন, দেশে ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বড় দুর্ভাবনার বিষয়। দরিদ্র মানুষের ৮২ শতাংশ গ্রামে বাস করে। গ্রামে ৬০ শতাংশ ভূমিহীন, ৪০ ভাগ খানায় বিদ্যুত সংযোগ নেই, ৬০ ভাগ মানুষ সরকারী স্বাস্থ্য সেবা থেকে কার্যত বঞ্চিত। ১০ শতাংশ ধনী মোট সম্পদের প্রায় ৯০ শতাংশ নিয়ন্ত্রক। এত বড় বাজেটের অর্থের উৎস হিসাবে অর্থ পাচার ও কালো টাকা থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রস্তাব করেন। আবুল বারকাত বলেন, দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে এখন ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। বাজেটে এ সমস্যা সমাধানে পদ্ধতিগত নির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা অর্থ পাচার রোধ থেকে আগামী অর্থবছরে ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায়ের প্রস্তাব করছি। একই সঙ্গে তিনি বলেন, দেশে পুঞ্জীভূত কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ হবে ৫ থেকে ৭ লাখ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, কালো টাকা দেশের মোট জিডিপির ৪২-৮০ শতাংশ। বিষয়টি বাস্তব সত্য। এটাকে কমানোর জন্য সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে পারে। অন্যদিকে একটি কার্যকর কমিশনও গঠন করতে পারে। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে ২৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা উদ্ধারের প্রস্তাব করছি। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে মোট ২২টি নতুন উৎস নির্দেশ করা হয়েছে। খাতগুলো হবে আয় ও মুনাফার ওপর কর, মূল্য সংযোজন কর, লভ্যাংশ ও মুনাফা, জরিমানা দ-, বাজেয়াফতকরণ, সম্পূরক কর, লভ্যাংশ ও মুনাফা, অর্থ পাচার রোধ থেকে প্রাপ্তি, কর ব্যতীত অন্যান্য রাজস্ব ও প্রাপ্তি ও কালো টাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি, সম্পদ কর, যানবাহন কর, মাদক শুল্ক, ভূমি রাজস্ব প্রভৃতি। এছাড়া বিদেশী নাগরিকের ওপর কর, বন্ড মার্কেট, সরকারী-বেসরকারী যৌথ অংশীদারিত্ব, সেবা প্রাপ্তির কর, সম্পদ কর, বিমান ভ্রমণ কর, তার ও টেলিফোন বোর্ড, টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন, সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, ইন্সুরেন্স রেগুলেটরি কমিশন, বিআইডব্লিউটিএ, বেসরকারী হাসপাতাল নবায়ন ফি, সরকারী স্টেশনারি বিক্রয়, পৌর হোল্ডিং কর ইত্যাদি বাজেটে রাজস্ব আয় বাড়াতে পারে। এ সব খাত থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় হতে পারে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক বারকাত আরও বলেন, এটা উচ্চাকাক্সক্ষার বাজেট প্রস্তাব কেউ কেউ তা বলতে পারে। যারা গত অর্থবছরের বাজেটকেও উচ্চাকাক্সক্ষার বাজেট বলেছে। আমাদের দেশে বিরোধী দলের কাজই হলো বাজেটের প্রস্তাবনার পর এটাকে উচ্চাকাক্সক্ষার বাজেট ও গরিব মারার বাজেট বলে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের এখান থেকে কেউ যদি অর্থমন্ত্রী হউন, তাহলে এ বাজেট পাস করা হতো। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি হতে হবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণের, দ্রুত বৈষম্য হ্রাসকরণের, মানবসম্পদ দ্রুত বিকশিতকরণ, শিল্পায়ন ত্বরান্বয়ে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগসহ (এসএমই) আত্মকর্মসংস্থান বিকশিতকরণের এবং সর্বোপরি সমগ্র প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। এছাড়া রাজস্ব আয় বাড়াতে রাজস্ব কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন ড. আবুল বারকাত। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের বাজেট তৈরি করা হয় সব মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে এবং অর্থ বিভাগ তা চূড়ান্ত করে। এ ব্যবস্থায় সৃজশীল চিন্তার সুযোগ কম এ ক্ষেত্রে শুধু মেকানিক্যাল অর্থাৎ শতকরা হার বৃদ্ধি অথবা ব্যবহার করা হয়। এতে সমস্যার দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় না এবং বাজেট বাস্তবসম্মত হয় না। এ অবস্থা নিরসনে আমরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাজস্ব কমিশন গঠনের প্রস্তাব করছি। যারা বাজেট কীভাবে যুগোপোযোগী করা যায় এ নিয়ে কাজ করবেন।
×