ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন

বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি ॥ উত্তরণের উপায়

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৭ মে ২০১৮

বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি ॥ উত্তরণের উপায়

সন্ত্রাসবাদ একটি সামাজিক ইস্যু কিন্তু বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ বিষয়টি একটি বৈশ্বিক প্রপঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক রাজনীতি এবং গ্লোবালাইজেশনের যুগে বাংলাদেশও উগ্রবাদী সন্ত্রাসবাদের শিকার। এ ছাড়া বাংলাদেশ গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এবং গোল্ডেন ক্রিসেন্টের সীমারেখায় অবস্থান করায় সন্ত্রাসবাদ, মানব/মাদক/অস্ত্র পাচার ও অন্যান্য সহিংস অপরাধের ঝুঁকির মধ্যে অবস্থান করেছে। তাই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি ও হুমকি থেকে উত্তরণের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। সমাজবিজ্ঞানী ডুর্খেইমের মতানুযায়ী সন্ত্রাসবাদ একটি সামাজিক ফ্যাক্ট এবং এটি সমাজের প্রচলিত ভাবমূর্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। অপরাধবিজ্ঞানী বেকারের মতে, অপরাধ হিসেবে সন্ত্রাসবাদ ইতোমধ্যে ‘লেভেলিং’ হয়ে গিয়েছে। সাধারণ যে কোন অপরাধের চেয়ে সন্ত্রাসবাদ মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ অপরাধটি সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে ঘটে থাকে। সন্ত্রাসবাদের কারণে যে মানুষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা কোনভাবেই এ অপরাধ সংঘটনের টার্গেট হিসেবে থাকে না, মূল টার্গেট থাকে ভিন্ন। ধরা যাক, আদালত প্রাঙ্গণে বোমা হামলা করার ফলে সাধারণ মানুষ হতাহতের শিকার হয়, কিন্তু জঙ্গীদের মূল টার্গেট হলো সরকারকে তাদের নিজস্ব শক্তি সম্বন্ধে জানান দেয়া এবং যে কোন মূল্যে তারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায় এ রকম একটি বার্তা প্রদান করা, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষমতার বাইরে থাকা নিরীহ মানুষগুলো। শুধু বাংলাদেশে নয়, বহির্বিশ্বে সংঘটিত সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মূল্যায়ন করলে এমন চিত্রই ফুটে উঠে। সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গীবাদ প্রত্যয়টি খুবই পরিপূরক হলেও জঙ্গীবাদের তেমন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন নেই। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কারণে যে কোন ব্যক্তি, গ্রুপ বা দল কর্তৃক সংঘটিত সহিংস কার্যাদিকে জঙ্গীবাদ বলে। পঞ্চদশ দশকের শুরুতে জঙ্গীবাদ প্রত্যয়টি আলোচনায় আসে এবং এর অর্থ হিসেবে প্রতিপাদ্য হয় সৈন্যের মতো দায়িত্ব পালন করা। স্বাভাবিকভাবে প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মতাদর্শের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম অথবা দেশবিরোধী কাজে অংশগ্রহণ করার নামই জঙ্গীবাদ। তাত্ত্বিক ফ্রেলিক এবং অন্যদের মতে, জঙ্গীবাদী আন্দোলনের পাঁচটি কৌশল রয়েছে যার উপর ভিত্তি করে ধ্বংসাত্মক কাজগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। সেগুলো হলোÑ মতাদর্শ, অনুপ্রেরণা, তত্ত্বাবধান, সংস্থা এবং যৌক্তিকতা। এখানে যৌক্তিকতা বলতে ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করে অস্থিমজ্জায় বেপরোয়া চিন্তাকে প্রস্ফুটিত করাকে বোঝানো হয়েছে। এসব বিষয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমেই জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটে থাকে বিশ্বব্যাপী। একজন জঙ্গী সবসময়েই উগ্রবাদী চিন্তাকে লালন করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার এলাকাগুলোতে দেখা যায়, কতিপয় ইসলামিক রাজনৈতিক সংস্থা বা দলগুলো উগ্রবাদী মানসিকতা ধারণ করে, তারা প্রচলিত রাজনীতির বিরুদ্ধাচরণ করে ধর্মের দোহাই দিয়ে চলমান রাজনীতির গতিধারাকে নিজেদের উদ্ভূত পদ্ধতি প্রয়োগ করে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে চায় নিমিষেই। যখন নিজেদের চাহিদামতো কিংবা রাজনৈতিক মুনাফা আনতে ব্যর্থ হয় তখনি তারা ধ্বংসাতœক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। সন্ত্রাসবাদ সহিংস অপরাধের অন্যতম একটি ধরন, যেদিন থেকে জনসাধারণের বিরুদ্ধে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে তখন থেকেই অপরাধটির ভয়াবহতা মানুষকে ভীত করে তুলছে প্রতিনিয়ত। ধর্মীয় জঙ্গীদের দ্বারা সন্ত্রাসী আক্রমণ বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং এর ভয়াবহতা এবং ক্ষতিগ্রস্ততা বহির্বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ বিষয়টি নতুন নয়। সন্ত্রাসবাদের শুরু বিশেষ করে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে, সন্ত্রাসবাদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবিষয়ক ইস্যুতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে থাকে অপরাধের ক্ষতিগ্রস্ততা নির্ণয় পরিমাপক গভীরতায়। বর্তমান সময়ে জঙ্গী এবং সন্ত্রাসবাদ একই অর্থে অনেক সময় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কারণ, সাধারণভাবে জঙ্গীরাই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মদদদাতা এবং সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করে থাকে। জঙ্গী এবং সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটি বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ান রাষ্ট্র বিশেষ করে পাকিস্তান, ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার এবং শ্রীলঙ্কাতে নতুন নয়। বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয়, বর্ণ, গোত্র, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক বিদ্রোহী গ্রুপ, জঙ্গী গ্রুপ, কমিউনিস্ট গ্রুপ, বিদ্রোহী গ্রুপ এ দেশগুলোতে তাদের কর্মকা- নিজেদের মতো করে চালিয়েছে এবং গ্রুপের সঙ্গে গ্রুপের সমন্বয়ের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে এবং এখনও যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, জঙ্গী অধ্যুষিত বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের সব জায়গায় ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে সন্ত্রাসীরা এবং ধ্বংসের লীলাখেলা শুরু করে। ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের বিশেষ করে জঙ্গীবাদের ব্যাপৃতি ঘটে থাকে বিশেষ করে দেশীয় পরিম-লে এবং আন্তর্জাতিকভাবে আল-কায়েদার সহযোগিতায় বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের জঙ্গীরা তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। পরিসংখ্যানিক চিত্র সাক্ষ্য দেয় ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০০৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী এবং জঙ্গী কার্যক্রমের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ইসলামী মৌলবাদ, চরমপন্থী মনোভাব, রাজনৈতিক প্ররোচনা এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের প্রভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতা রাজনীতির গতিপথকে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। রাজনীতিতে সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশ, অপরাজনীতিকরণ, গণতন্ত্রের চিরাচরিত নিয়মের ব্যত্যয় ইত্যাদি উপকরণগুলো বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদের বিচরণের মুখ্য প্রভাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সন্ত্রাসবাদ এবং মৌলবাদের বিস্তৃতির কারণে দিন দিন রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছে দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা। বর্তমানে অনেক প্রথিতযশা রাজনীতিবিদের আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়; অপরাজনীতির প্রকটতা জাজ্বল্যমান হওয়ায় ব্যবসায়ী এবং কালো টাকার মালিকদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ ঘটছে যা ভবিষ্যত প্রজন্মের তথা রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশের জন্য মারাত্মক হুমকি। ২০০০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠীর পদচারণা শুরু হয় বাংলাদেশে। জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ এবং জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ ২০০৫ সালে জঘন্য কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে দেশব্যাপী একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি। মূলত এ হামলার মধ্য দিয়েই জেএমবি তাদের শক্তির জানান দিতে সমর্থ হয়। হামলার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে জানা যায়, বহুমুখী কারণ যেমন অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো এহেন জঙ্গীবাদের বিস্তার এবং প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো জঙ্গীবাদকে প্রলুব্ধ করে থাকে ক্ষেত্রবিশেষে। ১৯৯৯ সালের শুরু থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত ইসলামের নামে বাংলাদেশ সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সংক্রমিত হয়েছে দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক চক্রের সমন্বয়ে। ২০০৯ সালে দেশ পরিচালনার এসে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছে বর্তমান সরকার এবং এর ফলে সহিংস অপরাধের সংখ্যাও কমে এসেছে। বর্তমান সরকার জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিশেষ করে সুসজ্জিত সিটিটিসি (পুলিশের বিশেষ ইউনিট) গঠন করে জনমনে স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। জঙ্গীবাদের বিস্তার রোধে বর্তমান সরকারের গ্রহণীয় পদক্ষেপ ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গত ২০ মে সিরাজগঞ্জে বিশেষ আদালত জেএমবির জঙ্গী আতাউল্লাহ ইলিয়াসকে চার বছরের সশ্রম কারাদ- দিয়েছে। গত ১৮ মে ময়মনসিংহের কাচিঝুঁলি থেকে ফিরোজা রহমান নামে একজন জেএমবি সদস্যকে জিহাদী বই পুস্তক ও লিফলেটসহ গ্রেফতার করা হয়। গত ১৬ মে রাজধানীর আরামবাগ থেকে জেএমবির মহিলা শাখার দুইজন সদস্য লাবিবা এবং কণাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গত ৮ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রেজাউল করিমকে হত্যা মামলায় জেএমবির দুই সদস্যকে মৃত্যুদ- এবং তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে আদালত। এছাড়া এ বছরের ৫ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আব্দুল কদ্দুস নিহত হয় এবং র‌্যাবের দুইজন সদস্য আহত হয়। র‌্যাব ঘটনাস্থল থেকে ৩টি আধুনিক অস্ত্র, ১৩টি বুলেট ও ধারালো অন্ত্র উদ্ধার করে। সুতরাং বলা যায়, সরকার সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে পরিত্রাণের জন্য তৎপর হয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং আন্তরিকতায় কোনরূপ ঘাটতি নেই। চারদলীয় ঐক্যজোট সরকারের সময়ে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জঙ্গীবাদের ভয়াবহতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। বাংলা ভাই, আবদুর রহমানসহ অন্য শীর্ষ জঙ্গী নেতারা তাদের প্রশিক্ষিত সদস্যদের দ্বারা জেলায় জেলায় ঘোষণা দিয়ে বোমা হামলা করেছিল এবং ফলে হতাহত হয়েছিল সাধারণ জনগণ, আতঙ্কে ছিল সর্বস্তরের লোকজন। আদালত প্রাঙ্গণে, লোকালয়ে এবং সিনেমা হলে বোমা চালিয়ে সমগ্র দেশে অরাজকতার রাজনীতির গোড়াপত্তন করেছিল জঙ্গীরা। যে কোন মূল্যে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন চরমপন্থী এবং অন্ধকারে থাকা রাজনৈতিক উগ্রপন্থী দলগুলো। সে সময়কার কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জঙ্গীবাদের মদদ দিয়েছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিরা তাঁদের মাঠের শক্তি হিসেবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছিল। মূলত অপরাজনীতি, বিরাজনীতিকরণ, রাজনৈতিক অপরাধ বৃদ্ধি, বিনা কারণে সাধারণ জনগণের উপর মামলা হামলা, পুলিশের দুর্নীতি, রাজনীতিবিদদের কালো টাকার মালিক বনে যাওয়া, রাজনৈতিকভাবে দেওলিয়াপানা ইত্যাদি ইস্যুগুলো সামনের কাতারে চলে এসেছিল। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, সরকার এবং প্রশাসন জঙ্গীবাদী কার্যক্রমকে মদদ দিয়ে এহেন গর্হিত কাজের উৎসাহ দিয়েছিল এবং তরুণ প্রজন্মকে ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ন্যক্কারজনক কর্মকা- করাত। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের অস্থিমজ্জায় ধর্মের বিকৃতি ব্যাখা প্রদানের মাধ্যমে এবং আর্থিক প্ররোচনাসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধার যোগসূত্রের প্রয়াসে মানবতাবিরোধী সহিংস কর্মকা-ে জড়াতে সক্ষম হয়েছিল কুচক্রী মহল তথা জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী। ধর্মীয় জঙ্গীবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের মারাত্মক পরিণতি সাধারণ মানুষকে খুব বেশি হতাহত করে থাকে। ১৯৯৯ সালের বছরের শুরুতেই অসাম্প্রদায়িক কবি, তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবি শামসুর রাহমান নিজ বাড়িতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দ্বারা গুরুতর আহত হন। উদীচী আয়োজিত নববর্ষের অনুষ্ঠানে উগ্রবাদীদের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত এবং ১০৬ জন আহত হয়। ওই ঘটনার পর থেকেই বাংলাদেশে উগ্র জঙ্গীবাদীদের আক্রমণ এবং প্রভাব ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। খুলনায় আহমাদিয়াদের মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত এবং ৪০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এ ঘটনাগুলো সবকটাই ধর্মীয় উগ্রবাদীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল অর্থাৎ ধর্মীয় জঙ্গীবাদে আদিষ্ট ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবথেকে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসমাবেশে আহূত গ্রেনেড হামলাটি। এ ঘটনাটি বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু তৎকালীন সরকার বিষয়টিকে মামুলি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। ওই গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন মানুষ মারা যান এবং আহত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ প্রায় ৫০০, যাঁরা আজও সেই আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন। সেই সময়ের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা দলটি জজ মিয়া নাটকের মাধ্যমে ঘটনাটি দামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের রাজনীতি কায়েম করে চিরকালীন ক্ষমতায় থাকায় পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল দেশবিরোধী চক্রের। কিন্তু সত্য কখনও চাপা থাকে না, এখন বিষয়টি খুবই স্পষ্ট, কাদের ইশারা-ইঙ্গিতে হামলা ঘটিয়েছিল উগ্রবাদীরা, তা আজ জাতির কাছে খুবই পরিষ্কার। আর কেনই বা সে হামলাটি করানো হয়েছিল সেটি অনুধাবনের জন্য তত বেশি জ্ঞানতাপস না হলেও চলবে। কারণ, বাংলাদেশে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে লালন ও মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির বলবৎকরণ ও বাস্তবায়নকল্পের সারথি হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিকল্প দ্বিতীয় আর কেউ নেই। কাজেই পরাজিত শক্তি চেয়েছিল শেখ হাসিনাকে যে কোন মূল্যে পৃথিবী থেকে বিদায় করতে। তাই তারা সুকৌশলে সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম করার জন্য পূর্বঘোষিত জনসভায় পরিকল্পিতভাবে ইতিহাসের অন্যতম ন্যাক্কারজনক হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে একটি প্রবাদ রয়েছে ‘রাখে আল্লাহ মারে কে।’ প্রায় ১৯টি পরিকল্পিত হামলা থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করেছেন বাংলার মানুষের সেবা করার জন্য। সন্ত্রাসবাদের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের স্বার্থে দেশবিরোধী চক্র সদাসর্বদা নানামুখী চক্রান্তে তটস্থ থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে গুলশানের হলি আর্টিজান হোটেল ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহের মাঠে জঙ্গীদের অতর্কিত হামলা উগ্রবাদীদের উপস্থিতিকে জানান দেয়। কিন্তু সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট ভূমিকার কারণে হুমকি প্রায় নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, নতুন প্রজন্মের মেধাবী ছেলেমেয়েদেরকে বিপথগামীরা বিপথের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েরে ছেলেরা জঙ্গীবাদী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে, পাশাপাশি নারীরা জঙ্গীদের সঙ্গে নিজেদের একীভূত করছেন সাম্প্রতিক সময়ে। যে বিষয়গুলো সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অনুশাসনে ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। কাজেই, বীজে ফল আসার পূর্বেই অঙ্কুরেই তা বিনষ্ট করতে হবে নচেৎ এসব গর্হিত কাজের জন্য দেশ ও জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। সন্ত্রাসবাদের রাজনৈতিক চক্রান্তকে ধূলিসাৎ করার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবে উদ্যোগ গ্রহণের প্রাথমিক শর্ত হতে হবে, জনগণকে যে কোন মূল্যে উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। জঙ্গীবাদের অর্থায়ন বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগকে স্বউদ্যোগী হয়ে মানিলন্ডারিং, কালো টাকা ও পাচার বন্ধে আধুনিক ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। জঙ্গীবাদের অর্থায়নে দেশীয় যে সব প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সহায়তা করে থাকে তাদের তালিকা সবিস্তারে জনসম্মুখে প্রকাশ করা। যাতে করে সচেতন নাগরিকরা এসব ঘৃণিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনভাবেই সংযোগ না রাখে। পাশাপাশি জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকদের কঠোর বিচারের সম্মুখীন করে উদাহরণ সৃষ্টি করা যাতে পরবর্তীতে কোন দল বা গ্রুপ কিংবা ব্যক্তি পরোক্ষভাবে হলেও জঙ্গীবাদের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না হয়। তাছাড়া জঙ্গীদের অস্ত্রের যোগানদাতা বা অস্ত্রের উৎসমুখ বন্ধ করে অস্ত্র উদ্ধারে র‌্যাব-পুলিশ সমন্বয়ে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় লেভেল পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমে জঙ্গীবাদে উদ্ধুদ্ধকারী পাঠ্যক্রমের বিষয়ে ব্যাপক নজরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ, যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে জঙ্গীসহায়ক বই পুস্তক পাওয়া যায় সেদেশে স্কুল, কলেজের লাইব্রেরিতে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে নিয়মিতভাবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার জাতি গঠনের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিকাশের লক্ষ্যে স্কুলভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কারণ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রচার ও প্রসারের এবং অনুশীলনের মাধ্যমে সামাজিক অনাচার, বিশৃঙ্খলা ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সহজেই একীভূত করা যাবে। কাজেই, সরকারসহ জনগণকে একই কাতারে এসে জঙ্গীবাদ নির্মূলের জন্য আধুনিক এবং কৌশলী ব্যবস্থা নিতে হবে এবং ছেলেমেয়েদের স্কুলিং ও শিক্ষা পদ্ধতি সম্বন্ধে অভিভাবকদের নিয়মিত খোঁজখবর নিতে হবে। ছেলেমেয়েদের পিয়ার গ্রুপ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়েও অভিভাবকদের সম্পৃক্তায়ন জরুরী হয়ে পড়েছে। শেষত : কাঁটা দিয়ে কাঁটা উপড়ে ফেলার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। যে সব জঙ্গীরা কারাগারে রয়েছে তাদের দিয়ে অন্য জঙ্গী গ্রেফতার করা, তাদের সার্বিক কার্যক্রম সম্বন্ধে অবগত হওয়া, জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা, অস্ত্রের যোগানদাতা সম্বন্ধে জানা, প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত তথ্য উদ্ধার করে সেসবের মূলোৎপাটন করা যেতে পারে নিমিষেই। জঙ্গীদের আন্তর্জাতিক যোগসূত্র সম্বন্ধেও বিশেষ করে প্রশিক্ষণ, তথ্য সরবরাহ ও আর্থিক যোগানদাতা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জঙ্গীবাদের রদকরণ সম্ভব হবে বলে মনে করি। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীন দেশ কখনই জঙ্গীবাদের আদর্শে পরিচালিত হতে পারে না। তাই; দলমত নির্বিশেষে সকলকে সন্ত্রাসবাদের রাজনৈতিকায়নের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত থাকার পাশাপাশি অন্যদেরও সুরক্ষা রাখার চেষ্টা ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×