ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

প্রাক-বাজেট ভাবনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৭ মে ২০১৮

প্রাক-বাজেট ভাবনায় রোহিঙ্গা সঙ্কট

আগামী অর্থবছরের বাজেট ৭ জুন ২০১৮, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী কর্তৃক উপস্থাপনের কথা রয়েছে যেখানে বাজেটের আকার ধরা হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৬৮ হাজার ২০০ কোটি টাকার যা মোট জিডিপি এর ১৮.৫ শতাংশের বেশি। এরি মধ্যে দেশের প্রথম শ্রেণীর দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রাক-বাজেট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খবর পরিবেশন করছে এবং দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বরেন্দ্র অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতৃত্ব, সমাজ বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে নিয়মিত টকশো আয়োজন করে চলছে। এই বছরের শেষে কিংবা আগামী বছরের প্রথমে সংসদ নির্বাচনের কথা রয়েছে বিধায় নির্বাচনের বছর হিসেবে চলমান সরকারের শেষ বাজেট কিংবা আগামী সরকারের প্রথম বাজেট হওয়ায় সার্বিক কর্মকা-টি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। কারণ, গত এপ্রিলে মাসে জাতিসংঘের একটি ঘোষণায় বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের উপনীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করছে যার চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটবে ২০২৪ সালে সনদপ্রাপ্তির মাধ্যমে যার জন্য দেশটি অর্থনৈতিক সক্ষমতার এক অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। তবে বর্তমানে দেশের আর্থসামাজিক সূচকগুলো যে গতিতে এগুচ্ছে তা এটা বললে ভুল হবে না যেÑ যদি কোন অঘোষিত দুর্যোগ না আসে তবে দেশ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে। এরি মধ্যে মাথা পিছু আয় ১৭৫২ ডলারে উন্নীত হয়েছে, জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭.২৮ শতাংশে পৌঁছেছে, শিক্ষার হার ৭২ শতাংশে পৌঁছেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, মূল¯ফীতি ৬ শতাংশের নিচে, মৎস্য ও সবজি উৎপাদনে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ এবং খাদ্য উদ্ধৃত্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত তারপরও দেশটিকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে। কারণ, সমস্যাও অনেক রয়েছে যেমন জলবায়ুজনিত কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জীবন জীবিকায় প্রভাব, সুশাসন তথা স্বায়ত্তশাসনের ঘাটতি, সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক অবক্ষয় এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জাতিগত নিধনের স্বীকার হয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় গ্রহণ যাদের সংখ্যা পুরনো নতুন মিলে এগারো লাখের বেশি। এই সকল রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়ে বাংলদেশ সরকার এক মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে যা সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এই মানবিকতার মূল্য কত। বিশেষত: বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্প আয়ের দেশে যার জন্য আগামী বাজেটে এই খাতে ব্যয় মেটাতে বরাদ্দ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু অনেক গবেষণা সংস্থা বলছে রোহিঙ্গার জন্য আগামী ২০১৮-১৯ সালের অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ দেয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, বাজেট বরাদ্দের কারণে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত যাওয়ার বিষয়টি যেন চাপা না পড়ে যায়। কারণ গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ৮ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গার মানবিক আশ্রয় দিতে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে অথবা স্থানীয়ভাবে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তার মধ্যে রয়েছে পাহাড় কেটে বনাঞ্চল উজাড়, কৃষি জমি দখল, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার পরিবেশ একেবারেই নষ্ট, স্থানীয় নিরাপত্তা তথা আঞ্চলিক দুর্ভোগ ইত্যাদি অন্যতম। যতই দিন যাচ্ছে ততই উপলব্ধি বাড়ছে যে রোহিঙ্গাদের অবস্থান আরও দীর্ঘমেয়াদী হবে। তাই যদি হয় তবে রোহিঙ্গা সঙ্কটের অর্থনৈতিক ভাব এই বিষয়টি এখন সেমিনারের আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এব গবেষকবৃন্দ এই বিষয়টির একটি বিশ্লেষণে বলেছেন রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হওয়ার পর বিগত নয় মাসে বিশ্বের বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা ও দেশ থেকে বাংলাদেশ ৩২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মানবিক সাহায্য পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ সংস্থার উদ্যোগে গঠিত জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের হিসেবে দেখা যায় বিগত মার্চ ২০১৭ থেকে আগামী ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত আরও ৯৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মানবিক সাহায্য প্রয়োজন হবে যার ২৫ শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছে আশ্রয়দাতা এলাকার জন্য। মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যদি প্রতিদিন গড়ে ৩০০ জনকে ফেরত নেয়া হয় তা হলে সব রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়ে সময় লাঘবে প্রায় ৮ বছর যার বিপরীতে খরচের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৯০ কোটি ডলার যা টাকার অঙ্কে ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই হিসেবে প্রতি বছর খরচ দাঁড়াবে ৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকা যা আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের বাজেটের প্রায় ৩ গুণের সমান। এই খরচ মেটানের জন্য যদি বৈদেশিক সাহ্যয্য না আসে তবে রাজস্ব বাজেটের ওপর বিশাল চাপ থাকবে। আবার রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়েছে অনেক আগেই তার সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রশাসন। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘ স্থায়ী হতে পারে এবং দুদেশের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্ব গঠিত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ এ বিষয়ে কাজ করছে। এই গ্রুপের প্রথম বৈঠক হয়েছে গত বছর জানুয়ারিতে মিয়ানমারের নেপিডোতে আর দ্বিতীয় বৈঠকটি হয়েছে ১৭ মে তারিখে ঢাকাতে। এই দুটি সভার ফলাফল গতানুগতিক বিধায় দৃশ্যত: তেমন কোন অগ্রগতি দেখা যায় না কেবল মিয়ানমারের উদাসিনতার কারণে বিধায় প্রত্যাবাসনের বিষয়টি মূলত অস্পষ্ট রয়েই গেল কারণ গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে ৮ হাজার ৩২ জনের একটি তালিকা হস্তান্তর করে যা এখন পর্যন্ত মিয়ানমার ৮৭৮ জনের যাচাই-বাছাই শেষ করছে কিন্তু কবে প্রত্যাবাসন শুরু হবে তার কোন তারিখ নির্ধারণ হয়নি। দেশটি রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে তেমন কোন পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি বিধায় তার এ অবস্থান যেতে আগ্রহী হবে বলে মনে হয় না। আর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বেচ্ছায় না গেলে কোন বল প্রয়োগ করা যাবে না। রোহিঙ্গাদের ভাষ্য মতে তারা পূর্বের বসতিতে ফিরে যেতে চায় অথচ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বাড়িঘড় বুলড্রোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে তাদের স্থাপনা তৈরি করছে। কাজেই মিয়ানমারের মনোভাব দেখে মনে হয় তারা রোহিঙ্গাদেরকে তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে ফিরিয়ে নিতে চায় না। তাহলে বাংলাদেশের সামনে কূটনৈতিক কৌশন ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই যা অনেকটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আরও দুশ্চিন্তার কারণ যে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা স্থিতিশীল থাকছে না এবং জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে দৈনিক গড়ে ৬০ শিশু জম্ম নিচ্ছে এবং গত নয় মাসে জম্ম নিয়েছে ১৬ হাজার শিশু। বর্তমানে ১৫ হাজার নারী অন্তঃসত্ত্বা রয়েছে। বিবিসি বলছে চলতি বছরে বাংলাদেশে ৪৮ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জম্ম নিবে। পৃথিবীতে দু-একটি দেশ ছাড়া প্রায় সকল দেশ সংবেধনশীল। জাতিসংঘ কফি আনান কমিশনের মাধ্যমে সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই সমস্যা সমাধানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব রেখেছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য চলতি বছরে বিশ্বের কাছে ৯৫ কোটি ১০ লাখ ডলার সাহয্যে আবেদন জানিয়েছে কিন্তু সাড়া মেলছে ২০ শতাংশের কম। এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে রোহিঙ্গা শরণার্থী তারপর নতুন করে এই সকল নবজাতক অতিথি বাড়তি বোঝা হিসেবে আবির্ভূত হলেও বাংলাদেশ নৈতিকভাবে দায়িত্ব এড়াতে পারে না মানবতাবাদী দেশ হিসেবে। তাই আমরা আশা করছি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে পালিয়ে আশা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার। লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি ও জ্যাস্ট সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি, ঢাকা
×