ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অসিত কুমার মুকুটমণি

মহাকাশে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২৭ মে ২০১৮

মহাকাশে বাংলাদেশ

নতুন ইতিহাসের নব অধ্যায়ের নতুন দিগন্তে মহাকাশের বলয়ে, উন্নততম প্রযুক্তির দরবারে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। গর্বিত জাতি ও গর্বিত দেশ হিসেবে গর্ববোধ হচ্ছে। ভালো লাগছে। ৭৪টি উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ যখন ৩৪ নম্বরে, ১৯৭৪-৭৫ এর অনুন্নত দেশ থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত, তখনই গত দশ বছর ধরে সরকারের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট মর্যাদার অধিকারী হলো বাংলাদেশ। অগ্রযাত্রার মাইলফলক ও যুগান্তকারী এ পদক্ষেপ, গৌরবের। বাংলার ৩৩ কোটি চোখের আকুতিকে রাঙিয়ে দিল ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ লিখা জি-৪ স্টেশনারী কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার স্পেশ সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে ১১ মে ২০১৮ অর্থাৎ শুক্রবার দিবাগত মধ্যরাত পেরিয়ে ২.১৪ মিনিটে (১২ মে ২০১৮) বেসরকারী মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’ (ইপিআই) এর স্পেশ এক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটটির মাধ্যমে দেশের প্রথম যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ এর সফল উৎক্ষেপণ হলো আর ৩৩ মিনিটের মধ্যেই তা পৌঁছে গেছে ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার উচ্চতায়। কক্ষপথ পর্যন্ত বাকি পথ পার হচ্ছে অতি ধীরে। সময়ে সময়ে জানিয়ে দিচ্ছে তার অবস্থান যার নিয়ন্ত্রণ এখন স্পেস এক্সের যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ার ৩টি গ্রাউন্ড স্টেশনের। অন্য রকম এক আবেগ ও উচ্ছ্বাসের ঢেউ ছড়িয়ে প্রযুক্তির অভিজাত ক্লাবে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এরপর ২০০৯ সালে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবস্থার নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’ কে নিয়োগ দেয়া হয়। স্যাটেলাইট সিস্টেম কিনতে ফ্রান্সের কোম্পানি থ্যালাস অ্যালেনিয়া স্পেসের সঙ্গে এক হাজার ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকার চুক্তি করে বিটিআরসি। ২০১৪-১৫ সালের অনুমোদিত প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ২৯৬৭.৯৫ কোটি টাকার (সরকারী-১৩১৫.৫১ ও বিদেশী অর্থায়ন ১৬৫২.৪৪ কোটি) এর মধ্যে ২৭৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে হংক সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (এইচএসবিসি) সঙ্গে ১২ বছরে ২০ কিস্তিতে পরিশোধিত হবে মর্মে বিদেশী অর্থায়নে এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়। ২০১৭ সালে পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রাথমিক মূলধনসহ কৃত্রিম উপগ্রহের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানী লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থাও গঠন করা হয়েছে। ৩.৭ টন ওজনের বঙ্গবন্ধু-১ উপগ্রহটি ১৫ বছরের জন্য প্রায় ৩৭৮৬ হাজার কিলোমিটার উপরে মহাকাশে স্থাপিত হয়েছে। স্যাটেলাইটের বাইরের অংশে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার রঙের নকশার ওপর ইংরেজীতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু-১। বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও সেখানে রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এয়ার ট্রাফিকের কারণে নির্দিষ্ট কক্ষপথে গিয়ে স্যাটেলাইটটি (স্পেসবাস ৪০০০) সেট হতে সময় নেবে প্রায় ৮-১২ দিন এবং গ্রাউন্ড স্টেশন জয়দেবপুর ও বুতবুনিয়ার (রাঙামাটি) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে বাণিজ্যিকসহ সার্বিক কার্যক্রম শুরু করতে সময় নেবে প্রায় ৩ মাস। উৎক্ষেপণ করার পর বাংলাদেশের গ্রাউন্ড স্টেশন ১২ মে ২০১৮ তারিখ থেকে উপগ্রহটি হতে পরীক্ষামূলক সংকেত পেতে শুরু করেছে। এটি এখনও লঞ্চ এ্যান্ড ইয়ারলি অরবিট ফেজে (এলইওপি) রয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, সব প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রয়েছে। ৩ বছর পর্যন্ত নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও মহাকাশ বিষয়ক প্রকৌশলীগণ এটা পরিচালনা করবেন। তারপর বাংলাদেশের সবিজ্ঞানীরাই এটা পরিচালনা করবেন। এখন অন্তর্বর্তী ৩ মাস সময়ের মধ্যে উপগ্রহটি ভালভাবে কাজ শুরু করবে এটাই আমাদের প্রতীক্ষা ও প্রার্থনা। মোটাদাগে এ উপগ্রহের কর্ম উদ্দেশ্যগুলো হবে যোগাযোগ ও সম্প্রচারভিত্তিক ব্রডকাস্টিং, টেলিকমিউনিকেশন এবং ডাটা কমিউনিকেশন। এছাড়াও এ উপগ্রহÑ ক্স ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে সম্প্রচারভিত্তিক সহজে সেবা প্রদান; ক্স টেলিভিশন সম্প্রচারে আত্মনির্ভর ও সাশ্রয়ী ক্ষেত্র সৃষ্টি; ক্স জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান ও ক্স দুর্যোগের তথ্য সংগ্রহ, মোকাবেলা ও ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও কার্যকরীকরণের ক্ষেত্রে আমরা আরও এগিয়ে গেলাম। জন ও রাষ্ট্রকল্যাণে এটি এক বিশাল ভূমিকা রাখবে, সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যাবে আগামীতে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও কার্যকরীকরণের ক্ষেত্রে আমরা আরও এগিয়ে গেলাম। জন ও রাষ্ট্রকল্যাণে এটি এক বিশাল ভূমিকা রাখবে, সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যাবে আগামীতে। ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতাসম্পন্ন উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ এ ৪০টি ট্রান্সপন্ডার আছে, যার মধ্যে ১৪টি ‘প’ এবং ২৬টি ‘ব্র্যান্ডের। এর মধ্যে ২০টি ট্রান্সপন্ডার বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য আর ২০টি ভাড়া দেয়ার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এতে করে বিদেশ নির্ভরতা কমে বছরে প্রায় ১১২ কোটি টাকা ব্যয় সাশ্রয় হবে। দেশের ৩০টি স্যাটেলাইটভিত্তিক টিভি চ্যানেল বিদেশ নির্ভরতা এড়িয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা পাবে। বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি ১১৯.১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমার ভূ-স্থির সøটে ৪৭ ডিগ্রী এঙ্গেলে স্থাপিত হচ্ছে। এটিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা অর্থমূল্যে রাশিয়ার উপগ্রহ বিষয়ক সংস্থা ‘ইন্টারস্পুটনিক’-এর কাছ থেকে অরবিটাল সøটটি ১৫ বছরের জন্য কেনা হয়েছে। ২০১৫ সালে বিটিআরসি এর সঙ্গে কোম্পানিটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পাদন করে। ইন্দোনেশিয়া থেকে তাজিকিস্তান পর্যস্ত বিস্তৃত এলাকা নিয়ে কর্মের সক্ষমতা থাকবে এ উপগ্রহের। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল (এসপিআই) এর আরদ্ধ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য বাজার পর্যবেক্ষণ, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা রূপরেখা সৃজন, আইটিইউ-এর সঙ্গে তরঙ্গ সমন্বয় করা, স্যাটেলাইট সার্ভিস ডিজাইন করা, স্যাটেলাইটের আর্কিটেকচারাল ডিজাইন, সিস্টেম ডিজাইন, দরপত্র প্রস্তুত, ম্যানু-ফ্যাকচারানিং ও সুষ্ঠুভাবে উৎক্ষেপণ, জনবল তৈরিতে প্রশিক্ষণ প্রদান প্রভৃতি কাজ করা। প্রতিষ্ঠানের হিসাব মতে বাংলাদেশ এ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করবে। আইটিইউ হতে নিজস্ব অরবিটাল লোকেশান ও প্রয়োজনীয় ফিকোয়েন্সি নিশ্চিত করার সমস্যা সমাধান করে উপগ্রহটি উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা, উঞঐ, ঠরফবড় ঃৎধহংসরংংরড়হ, ঠ-ংধঃ, চৎরাধঃব ঘবঃড়িৎশ, চড়রহঃ ঃড় চড়রহঃ ঈড়হহবপঃরড়হ-সহ টেলিমেডিসিন, ই-রিচার্স, ই-লানিং, ভিডিও কনফারেন্স, আকাশ সংস্কৃতি, যোগাযোগ প্রভৃতি কাজগুলো সহজ করে দেবে। প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নতুন গতি এনে রাজস্ব আয় বাড়বে, প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও গতিশীলতা সৃষ্টি করবে। ছয় বছরের মধ্যে ব্যয় উঠে আসার সুফল পাবার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের স্বপ্ন সহায়ক হবে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন আজ স্বার্থকতার মুখ দেখছে তাঁর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগ এবং সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ এর রূপায়ণী কার্যকরী ভূমিকায়। বাংলাদেশের স্বার্থক রূপায়ণ ও অগ্রযাত্রার চিন্তায় বঙ্গবন্ধু সে সময়েও কত অগ্রসর চিন্তা করতেন এবং দূরদর্শী ছিলেন তার উদাহরণ বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন। এ উপগ্রহ প্রেরণের কর্মতৎপরতায় জাতি আরও অনুপ্রাণিত, সংগঠিত, সংহত এবং আত্মবিশ্বাসী হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বলেছিলেন যে বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি হচ্ছে অথচ সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আজ বাংলাদেশের অর্থায়নে যুক্তরাষ্ট্র (ইউএসএ) থেকেই উৎক্ষেপিত হলো আমাদের গর্ব ‘বঙ্গবন্ধু-১’ উপগ্রহটি। বাংলাদেশে যুদ্ধ জাহাজ ও মালবাহী জাহাজ তৈরি হচ্ছে। সাহসী পদক্ষেপে তৈরি হচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু, মেট্টোরেল, পায়রা সমুদ্র বন্দর, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রভৃতি। এছাড়া এ সরকারের দূরদর্শী কর্মোদ্যোগে অর্জিত হয়েছে সমুদ্র জয়, দীর্ঘ দিনের সীটমহল সমস্যার সমাধান। এভারেস্ট জয় করেছে বাংলার দামাল ছেলে মেয়েরা। আমাদের ক্রিকেট আজ উন্নীত বিশ্বমানে। তরুণদের আরও অনুপ্রাণিত করার জন্য এ কর্যক্রমের ক্রমোন্নতি অব্যাহত থাকুক, আমাদের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতা আরও বিস্তৃত হোক। উপগ্রহের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত আমাদের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীগণ গভীরভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে এর পূর্ণজ্ঞান আয়ত্ত করতে সক্ষম হবেন সেটাই কাম্য। মেধা, জ্ঞান, প্রশিক্ষণ, অর্থ, ইচ্ছা ও চেষ্টার সমন্বয়ে আগামীতে আমাদের বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশ থেকে আরও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করবে বলে আশাবাদী। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, কনসালট্যান্ট লানিং এন্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ
×