ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

জি-৮ ও জি-৭, জেনোয়া থেকে কুইবেক ডিজিটাল বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২৭ মে ২০১৮

জি-৮ ও জি-৭, জেনোয়া থেকে কুইবেক ডিজিটাল বাংলাদেশের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

তথ্যপ্রযুক্তির সম্ভাবনা শক্তি অনুধাবন করে বাংলাদেশ বিশ্ব সমাজের আন্দোলনে প্রবেশ করে ১৯৯৮ সালে আইটিইউ’র মেনিয়াপোলিস ঘোষণাপত্রে অনুস্বাক্ষরের মাধ্যমে। এর আগেই ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমোদন দিয়ে কম্পিউটার থেকে শুল্ক প্রত্যাহার করে তার মূল্য সহনীয় রাখতে সে সময়ের সরকার তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়ন ও বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে। অনেকেই হয়তো জানেন, কম্পিউটার শিল্প তখন সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভর ছিল বিধায় এর দাম ছিল আকাশচুম্বী ও সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে ডায়ালআপ পদ্ধতি ছিল প্রধান ভরসা। ব্রডব্যান্ড বলে কিছু ছিল না বললেই চলে। যা ছিল ভি-স্যাট নির্ভর তা কেবল আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠান ও দেশের নাম করা কর্পোরেট/বহুজাতিক সংস্থার ব্যবহারের মধ্যে সীমিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন অনুধাবন করেন তথ্যপ্রযুক্তির সকল ব্যবহার নিশ্চিত করতে ‘ই-রেডিনেস’ বা সকল পর্যায়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। ২০০১ সালের শুরুতে তিনি নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে একটি কারিগরি অনুদান সহযোগিতার সমঝোতা করেন। সে সমঝোতা অনুযায়ী নেদারল্যান্ডস সরকার বাংলাদেশের ৭৭০০ শিক্ষককে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিতে প্রতিশ্রুতি দেয় ও সে দেশের একটি কম্পিউটার ব্র্যান্ড ‘টিউলিপ’-এর ১১ হাজার কম্পিউটার, প্রশিক্ষণ সহায়িকা ও অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ দিতে সম্মত হয়। নেদারল্যান্ডস সরকার এ প্রকল্পে ১০ মিলিয়ন ইউরো অনুদান দেয়। প্রধানমন্ত্রীর ছোটবেলাকার আজিমপুর স্কুলে কম্পিউটার বিতরণের মাধ্যমে এ কর্মসূচীর সূচনা নির্ধারণের পরেও এক শ্রেণীর কর্মকর্তাদের বাধার কারণে প্রকল্পটি শুরুতেই হোঁচট খায় (অবসরের পর সে কর্মকর্তারা অবশ্য এখন নানা টক শো-তে নানা রকম উপদেশ দেন)। সীমিত আকারে সে কর্মসূচী শুরু“হলেও ২০০১ সালের মধ্যভাগে সরকার পরিবর্তনের পরে নতুন সরকার নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে এই চুক্তি স্থগিত করে। শেখ হাসিনার ভগিনী-কন্যা টিউলিপের সঙ্গে নামের মিল থাকায় এই কম্পিউটার চুক্তি পারিবারিক ব্যবসার উদ্দেশে করা হয়েছে বলে দেশে একটি ধুয়া তোলা হয়। বিএনপি সরকারের আমলে এই জাতীয় কাজের ফলে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। নেদারল্যান্ডস সরকার বাংলাদেশের জন্যে সকল অনুদান বন্ধ ঘোষণা করে দেয়, এমনকি বাংলাদেশের কোন জাহাজ তার দেশের বন্দর সীমানায় আটকে দেবার ঘোষণাও দেয়। চুক্তিভঙ্গের কারণে টিউলিপ কোম্পানির মামলায় শেষপর্যন্ত বিএনপি সরকার হেরে যায় ও ডাচ্ কোর্টের নির্দেশে ২০০৪ সালে ৪.২ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা দিতে বাধ্য হয়। তথ্য-প্রযুক্তি জগতে বাংলাদেশের সক্রিয় অবস্থান তৈরিতে ১৯৯৭-৯৮ সালে তখনকার কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের বেশ জোরাল ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির নেতৃবৃন্দ সরকারের সঙ্গে নানা বিষয়ে দেন-দরবার করে এর গুরুত্ব তুলে ধরতে সমর্থ হয়। বিশেষ করে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের ফলে ও তাঁর নিজের আগ্রহের কারণে এই কাজ যথেষ্ট সহজ হয়। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়াও সরকারের মন্ত্রী পরিষদে আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ লোকবল ও কিছু উচ্চ-শিক্ষিত পদস্ত কর্মকর্তার ইতিবাচক সহযোগিতার কারণে শেখ হাসিনার সরকার বিশ্ব দরবারের নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে সমর্থ হয়। এসবের ফলশ্রুতিতে ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেনিয়াপোলিসে যখন আইটিইউ (ইন্টার ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) তথ্য সমাজ গঠনে তৎপরতা শুরু করে বাংলাদেশ এতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। তখনকার অর্থমন্ত্রী এএসএম কিবরিয়া আইটিইউ-র মহাসচিব ফিনল্যান্ডের অধিবাসী পেক্কা টারজানীর মাধ্যমে বাংলাদেশের টেলিকমিউনিকেশনের উন্নয়নে নতুন প্রকল্প গ্রহণে আইটিইউ-র সম্মিলিত সহযোগিতা চেয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। আইটিইউ তথ্য সমাজ গঠনে জাতিসংঘের শীর্ষ সম্মেলনের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ তাতেও জোরাল সমর্থন দেয়। ২০০০ সালের জুলাই মাসে জাপানের ওকিনাওয়া পৃথিবীর প্রথম সারির ৮টি ধনী দেশের সংগঠন জি-৮ সম্মেলনে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও দারিদ্র্র্য বিমোচনে এর ব্যবহার নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমঝোতার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয় যা তথ্যপ্রযুক্তি জগতে ‘ওকিনাওয়া চার্টার’ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। জাপান এই বিষয়ে সর্বোত নেতৃত্ব দেয়। ইতোমধ্যে আইটিইউ-র মহাসচিব হিসেবে যোগ দেন জাপানের টেলিকমিউনিকেশন প্রযুক্তির প্রাক্তন উপমন্ত্রী ইউশিহো উৎসুমি যিনি বাংলাদেশের টেলিকমিউনিকেশন উন্নয়নে ৯৭-৯৮ সালে যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন ও সহযোগিতা দিয়েছিলেন। জাপান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে স্বাধীনতার শুরু থেকেই প্রযুক্তিখাতে বাংলাদেশকে প্রচুর সহযোগিতা করেছে। দীর্ঘদিন পরে ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬-২০০১ সালের সরকার আমলে আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক পরিসরে নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তার ভাবমূর্তি যথেষ্ট উজ্জ্বল করতে সমর্থ হয়। ২০০০ সালের পরে প্রযুক্তি খাতে বিশ্বব্যাপী নতুন চিন্তা শুরু হয় ও দেশে দেশে সমধর্মী উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমঝোতার প্রয়োজন হয়ে পরে। বিশেষত প্রযুক্তি যন্ত্রাংশের উচ্চমূল্য ও এর বিপণন ও বহুবিধ ব্যবহারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ‘ওকিনাওয়া চার্টার’ বাস্তবায়নে তাই জি-৮ দেশগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব উন্নয়নশীল বা দারিদ্র্য সঙ্কুল দেশগুলোর মতামত নিতে বা তাদের কথা শুনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশে তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে একটি যুগান্তকারী ঘটনা যে পরের বছর ২০০১ সালের জুলাই মাসে জি-৮ সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান ইতালীর জেনোয়া শহরে অনুষ্ঠিতব্য শীর্ষ সম্মেলনে অতিথি হিসেবে যোগ দিতে। তাঁরা শুনতে চেয়েছিলেন দারিদ্র্য মোচনে শেখ হাসিনার ভাবনা কী? সে আলোকে ‘ডিজিটাল অপরচুনিটি টাস্ক ফোর্স’ বা জি-৮ প্রবর্তিত ‘ডট ফোর্সে’র সুপারিশ বিন্যস্ত হয়েছিল যা ‘জেনোয়া প্যান অব এ্যাকশন’ নামে সুপরিচিত। তখন বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে গেলে কিছুটা বিপত্তি তৈরি করা হয় শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ নিয়ে, কিন্তু জি-৮ সম্মেলনের হোস্ট ইতালী সরকার ও তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জিয়াউদ্দিন আহমদের সাহসী ভূমিকায় শেখ হাসিনা সসম্মানে জি-৮ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের গোড়াপত্তন বা বীজ রোপণ হয়েছিল সে সময়ে যখন শেখ হাসিনা স্বয়ং উদ্যোগী ছিলেন কেমন করে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নতিকে বিশ্ব মডেলে রূপান্তর করা যায়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এই সময় নিয়মিত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা ও তাঁর ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেকে উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তির একজন সামান্য কর্মী হিসেবে ভূমিকা রাখা। তাঁর স্নেহধন্যে এই শক্তি রূপান্তরের প্রতিলিপি অনুধাবন করেছি তাঁর চিন্তা ও মননে, সে হলো প্রযুক্তি সহায়ক একটি আধুনিক স্মার্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা। ক্ষমতার বাইরে থেকেও ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি তথ্যপ্রযুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে ভেবেছেন ও সেই অনুযায়ী উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূমিকা রেখেছেন। মেনিয়াপোলিসের ঘোষণা অনুযায়ী ও ২০০০ সালের ‘ওকিনাওয়া চার্টার’ সামনে রেখে দুনিয়াজুড়ে যখন জাতিসংঘের তথ্য সমাজ শীর্ষ সম্মেলন হয়, তাতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। ইতিহাসে বিরল, জাতিসংঘের কোন শীর্ষ সম্মেলনে বিরোধী দলের নেতাকে ২০০৫ সালের তিউনিস সম্মেলনের সিটিজেন সামিটে প্রধান অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করা। আমি তখন জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনের দক্ষিণ এশিয়ার সিভিল সোসাইটির সমন্বয়কারী। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান ও সুইস সরকারের প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণপত্র নিজ হাতে শেখ হাসিনার হাতে পৌঁছে দেবার। যদিও ঝালকাঠির দুই বিচারক হত্যার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি যেতে পারেননি কিন্তু তাঁর পক্ষে তাঁর বিশেষ সহকারী ড. হাসান মাহমুদ সে সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন। ওকিনাওয়া, জেনোয়া হয়ে জেনেভা-তিউনিস শেষে সারা দুনিয়ায় যখন সর্বসম্মত ঘোষণাপত্র আলোড়ন তুলেছে তখন ২০০৮ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনা তাঁর অভিজ্ঞতা, অনুধাবন, দূরদর্শী চিন্তার দর্শনে গ্রহণ করেছেন প্রযুক্তির সম্ভাবনাকে যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। সকলেই জানেন জি-৮ থেকে রাশিয়া বাদ পড়ে এখন জি-৭ হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ শুনতে জি-৭ এখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি। ২০১৬ সালে জাপানের সম্মেলনে জি-৭ তাঁকে বিশেষ সম্মানে সেখানে আমন্ত্রণ করেছে তাঁর অভিজ্ঞতা শুনতে। সামনের জুনে জি-৮ সম্মেলন হবে কানাডার কুইবেকে, সেখানেও বিশ্ব নেতারা শুনতে চান তাঁর পরামর্শ। বর্তমান বিশ্বে এ রকম দায়িত্ব পালনের সম্মান পেয়েছেন খুব কম দেশের নেতৃবৃন্দ। আমরা শুধু দেখতে চাই স্বপ্নগুলো সফল হোক, দুনিয়ার মানুষ শিখুক বাংলাদেশ থেকে আর এই চেষ্টাগুলো অব্যাহত থাকুক। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×