ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুরলোকে এনামুল কবির

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ২৬ মে ২০১৮

সুরলোকে এনামুল কবির

গৌতম পান্ডে ॥ সঙ্গীত গুরুমূখী বিদ্যা প্রচলিত। অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও চর্চায় প্রতিভাও হার মানে এটাও প্রমাণিত। তার ওউজ্জ্বল্য প্রমান জীবন্ত কিংবদন্তি গিটার শিল্পী এনামুল কবির। সহজাত প্রবৃত্তি থেকে সুরকে ভালবেসেছেন শিশুকাল থেকে। আবাল্য খেলার সাথী এই সুর পরিণত বয়সে তাকে করে তুলেছে শিল্পী গড়ার কারিগর। সুরাবহে নিজেকে শিক্ত করার পাশাপাশি, সঙ্গীতলব্ধ জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কালজয়ী অনেক গানকে স্বরলিপিবদ্ধ করেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। সঙ্গীতের শাস্ত্রীয় রূপকে স্বশিক্ষায় আত্মস্থ করেছেন। গুরুর সান্নিধ্য বিনা শ্রবণ ও ইচ্ছাশক্তিবলে সঙ্গীত জগতে হয়ে উঠেছেন মহারাজ। মাতা-পিতা, স্ত্রী, সন্তান বিয়োগের শোক যন্ত্রনাকে প্রশমিত করে সুর স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। শতবাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে ছেয়াত্তর বছর বয়সেও নিজের গতিকে রেখেছেন বহমান। পৌঢ়ত্ব তার মনোবলকে হার মানাতে পারেনি। গান লিখছেন, সুর করছেন, নতুন প্রজন্মকে গীটার শেখাচ্ছেন। সংসদ টেলিভিশন খুললে এখনও অবিরত শোনা যায় তার বাজানো গীটারের সুর। একাধারে বেজে চলেছে মুক্তিযুদ্ধসহ দেশাত্ববোধক গানের রেকর্ড। দেশের শীর্ষস্থানীয় গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েছেন। অনেক প্রশংখ্য ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। দেশের রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হতে পারেন নি, এ নিয়ে তার কোন ক্ষোভ নেই। এ বিষয়ে কখনও কোন অভিযোগই তিনি করেন নি। মধুমতি নদী ঘেরা কালিয়া উপজেলার নড়াগাতি থানার ডমুরিয়া গ্রামে ১৯৪২ সালের ৫ জুলাই প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন এনামুল কবির। এক সম্ভ্রান্ত শেখ বংশে জন্ম তার, ডাক নাম মানিক। বাবা শেখ মোহাম্মদ সারোয়ার আর মা ফাতেমা বেগম। ছয় বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ। নীরবে- নিভৃতে একান্তই আপন গতিতে বেড়ে উঠা এই মানিকই আজ দেশের গর্ব, অমূল্য এক সম্পদ। তবে তাঁর এ সুর বাঁধনের শুরুটা খুব একটা সরল রেখায় আঁকা ছিল না। বয়স যখন সবে এগারো-বারো, হাতে তুলে নেন বাঁশের বাঁশি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, সকালে স্কুলে যেতাম, বিকালে মাঠে গরু-ছাগল চরাতাম। আমার এক চাচা মাঝে-মধ্যে বাঁশি বাজাতেন। তার কাছথেকে সা-রে-গা-মা শিখে নিলাম। ধীরে ধীরে লাইলি মজনু যাত্রাপালা ও গুনাই বিবির গানের সুর বাঁশিতে তুলে ফেললাম। বিকালে গরু চরানোর সময় বাজাতাম। বাবার দেয়া কলের গান বাজিয়ে গান শুনতাম। এটি চুরি হয়ে গেলে বাবা একটি রেডিও কিনে দিয়েছিলেন। এতে করে সুযোগ পেলে গান শোনা হতো। স্কুল ছুটির পর বন্ধুদের নিয়ে বাঁশি বাজানোর আসর বসাতাম। সাথে সাথে দুলাভাইয়ের দেয়া মাউথ অর্গানও রপ্ত করে ফেললাম। স্কুলে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক উৎসবে আব্বাস উদ্দিনের গাওয়া ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ গানটি বাঁশিতে বাজিয়ে মাত করে ফেললাম। এই আমার প্রথম মঞ্চে ওঠা। তাঁকে বাতজ্বরে আক্রমন করায়, ডাক্তারের পরামর্শে বাঁশি ছড়তে হলো। তিনি বলেন, বাতজ্বরের কারণে খেলা বন্ধ, বাঁশি বাজানো বন্ধ কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মনে মনে চিন্তা করলাম গিটার বাজানো শিখব। আমার বড় বোনের দুই ছেলের গৃহ শিক্ষককে দেখেছি হাওয়াইয়ান গিটার বাজাতে। তার কাছথেকে ৭০ টাকায় গিটার কিনে, তারই কাছে কি করে বাজাতে হয় এটা জেনে নিলাম। প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় রেডিওর গান শুনতাম আর সেসব গান গিটারে তোলার চেষ্টা করতাম। পরে ঢাকায় এসে বড় দুলাভাই ও বোন আলমাস বেগমের প্রেরণায় গিটারের চর্চা চলতে থাকে। বুলবুল একাডমিতে ভর্তি হয়ে গিটার শেখা শুরু করলাম। ছয় মাসের মত শেখানে শিখলাম। অনিবার্য কারণে বাফা ছাড়তে হলো। এরপর নিজের সংগ্রাম। এরইমধ্যে কচিকাঁচার মেলারও সদস্য হলাম। ১৯৬৫ সালের ১৮ মে এনামুল হক যুগলবন্দি হন মমতাজ জাহান ডলির সঙ্গে। অন্তহীন ভালবাসায় স্ত্রী-ই ছিলেন তার সুর স্পন্দন। বিয়ের এক বছর পর ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাদের ঘর আলো করে জন্ম দিল প্রথম সন্তান। নাম রাখা হয় এনায়েত কবির চঞ্চল। তাদের দ্বিতীয় সন্তান রিয়ার জন্ম হয় ১৯৬৮ সালে। মাত্র ৭ মাসের মাথায় শোকে ভাসিয়ে চির বিদায় নেয় রিয়া। ১৯৭০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাদের আর একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখেন নাহিদ কবির কাকলী। স্ত্রী প্রসঙ্গে এনামুল কবির বলেন, শান্ত মানুষের দুষ্টমি কত সরব, তা তাকে না দেখলে বোঝা যাবে না। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার ব্যক্তিজীবন, সংসারজীবন, সঙ্গীতজীবন সার্থক হয়েছে তার একচ্ছত্র পরিচর্যায়। আর্থিক স্বচ্ছলতা থেকে শুরু করে দুটি সন্তানকে সার্থকভাবে মানুষ করা তারই কৃতিত্ব। তারুণ্য পেরিয়ে পৌঢ়ত্ব নেমে এসেছে এনামুল কবিরের জীবনে। সংসার জীবনের সূচনা থেকে সময়গুলো কিভাবে চলে গেল বুঝতেই পারেন নি তিনি। ছেলে এনায়েত কবির চঞ্চল ব্যবসায় মনোনিবেশ করে হয়েছিল প্রতিষ্ঠিত আর মেয়ে কাকলি খ্যাতি অর্জন করে সঙ্গীতে। প্রতিটি মুহুর্ত তাদের কেটেছে সুখ-দু:খ, ভালবাসা আর আনন্দের মধ্যে। কিন্তু হঠাৎই তার ছন্দপতন। ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চির বিদায় নিলেন এনামুল কবিরের প্রেয়সী প্রিয় সহধর্মিনী মমতাজ জাহান ডলি। স্ত্রী বিয়োগের মাত্র দুমাস পর তার একমাত্র পুত্র আদরের ধন এনায়েত কবির চঞ্চল আত্মহননের পথ বেছে নেয়। পুত্রের অকাল মুত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন তিনি। এনামুল কবির বলেন, নিয়তি সবচেয়ে ভারী বস্তু আমার কাঁধে তুলে দিলো। আমাকে সেই ভারও বহন করতে হলো। আমি কবি নই, বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আমার বসবাস। সুরের সঙ্গে আমার যত খেলা। তাই আমার জীবন বৃত্তান্ত্রের এই যন্ত্রনাময় অধ্যায়টি শব্দের গাঁথুনিতে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। দেশাত্মবোধক, পল্লী ও আধুণিক মিলে মোট ১০টি গানের স্বরলিপি নিয়ে ১৯৭৫ সালে ‘স্বরলিপি সমাবেশ’ নামে তার প্রথম বই প্রকাশ হয়। বিভিন্ন সময়ে হরানো দিনের গান, স্বাধীনবাংলা বেতারের গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, হাছন, লালন, পল্লী, আধুনিক, বঙ্গবন্ধু উপর রচিত গান মিলে তার এ পর্যন্ত ২২টি স্বরলিপির বই প্রকাশ হয়েছে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর পিপলস ভয়েসের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শেকড় সন্ধানের আয়োজনে জাতীয় প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সিডির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বিচারপতি হাবিবুর রহমান সিডির উদ্বোধন ঘোষণা করেন। সুইচ টেপার সাথে সাথে বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হলো ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। একই সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে উঠল আমার বাজানো গিটারের সুরে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি’। একটা অদ্ভুত ভাললাগায় আমার হৃদয় মন তৃপ্ত হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল গিটার শিল্পী হিসেবে আজ আমি স্বার্থক। কিন্তু সব ভাললাগা এক মুহুর্তে ম্লান হয়ে গেল। দেখলাম, এই সিডি প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত সবার নাম আছে সিডির কভারে, কিন্তু আমার নামটি কোথাও নেই। পরে এই ভেবে শান্তনা পাই, বঙ্গবন্ধুকে আর বাজিয়ে শোনাতে পারব না। কিন্তু তার ভাষণের সাথে আমার বাজানো গিটারেরর সুরে মুক্তিযুদ্ধের গান সংযোজিত হয়েছে। এর চেয়ে ভাল লাগার, গর্বের অনুভূতি আর কি হতে পারে। শিল্পী এনমুল কবিরের এ পর্যন্ত গিটার এবং গানের ভিসিডি ও অডিও মিলে ৫৪ টি ক্যাসেট বাজারে এসেছে। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ৬টি গান নিয়ে ‘শাশ্বত বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের ৬টি গানই শিল্পী নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছেন সেলুলয়েডের ফিতায়। পরিকল্পনা শিল্পীর নিজের। শিল্পী এনামুল কবির জানান, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গানকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্টাফ নোটেশনসহ ‘সুরে গানে চিরন্তন বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের স্বরলিপি গ্রন্থের কাজ শেষের পথে। সাধনার বদৌলতে কাঙ্খিত লক্ষে উপনিত শিল্পী এনামুল কবির। জীবনের ষাটটি বছর অতিক্রম করেছেন সঙ্গীত সাধনায়। এ দেশের সঙ্গীত ভূবন তার স্পর্শে হয়েছে সমৃদ্ধ। ছেয়াত্তর বছর বয়সেও থেমে নেই শিল্পীর পথচলা। গিটার বাদন, স্বরলিপি তৈরি, নতুন গানে সুর প্রদান চলছে বিরামহীন, ক্লান্তিহীন।
×