ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লালপুরে ৬শ আম বাগান মালিক সর্বশান্ত

প্রকাশিত: ০০:৫০, ২৫ মে ২০১৮

লালপুরে ৬শ আম বাগান মালিক সর্বশান্ত

সংবাদদাতা, লালপুর ॥ নাটোরের লালপুরে অবৈধ ইটভাটার গ্যাসে সর্বশান্ত হয়েছে ৯টি গ্রামের অন্তত ৬'শ আম বাগান মালিকরা। বিষাক্ত ইটভাটার গ্যাসের কারণে গাছেই আমের নিচের অংশে পচন ধরে ঝরে যাচ্ছে হাজার হাজার টন আম। প্রাথমিক ভাবে স্থানীয় কৃষি বিভাগ ২কোটি টাকার ক্ষতির পরিমান নির্ধারণ করেছে। তবে অবৈধ ইটভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছেন উপজেলা প্রশাসন। আর কৃষি জমি থেকে অবৈধ ইটভাটা সরিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপুরন দেওয়ার দাবী জানিয়েছেন বাগান মালিকরা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাগানগুলোতে আমের নিচের অংশে কালো পচন ধরে বাগানেই নস্ট হচ্ছে। পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছ থেকে ঝরে পড়ছে অপরিপক্ক আমগুলো। বাগানের আমগুলো ঝড়ে পড়ার পাশাপাশি আমের আকার দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন নাটোরের লালপুর উপজেলার লালপুর ইউনিয়নের বিশম্ভপুর, মমিনপুর বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের মহরকোয়া, রহিমপুর, প্রধানপাড়া, আড়বাব ইউনিয়নের অমৃতপাড়া, ঘোষপাড়া, আকবরপুর এবং কৃষ্ণরামপুর সহ মোট ৯টি গ্রামের আম বাগান মালিক ও চাষীরা। চাষীদের অভিযোগ, আধা কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি অবৈধ ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসের কারনে এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন তারা। মৌসুমের মাঝ সময়ে আমের এমন পরিস্থিতির কারনে দিশেহারা এলাকার বাগান মালিকরা। বাগান মালিকরা জানান, প্রথমে আমের নিচের অংশের দিকে কালো হয়ে ঝড়ে পড়তে থাকে। কোন কীটনাশক প্রয়োগ করেও ফল পাওয়া যাচ্ছিলনা। পরে উপজেলা কৃষি বিভাগকে জানানো পর আমের নমুনা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক আম গবেষনা ইন্সটিটিউটে পাঠানো হয়। পরে গবেষনা শেষে উপজেলা কৃষি বিভাগকে আম গবেষনা ইন্সটিটিউট লিখিত জানায়, ইটভাটার ধোয়া এবং গ্যাসের কারণে ‘ব্লাক টিপ’ নামের একটি রোগ নির্নয় করা হয়েছে। সেই সাথে দুই কিলোমিটারের মধ্যে থেকে ভাটা স্থানান্তর সহ বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়। মহরকোয়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ বাগান মালিক ওবায়দুর রহমান বলেন, বাগান মালিকদের যে পরিমান ক্ষতি হয়েছে, তা কোন ভাবেই পুরন করার নয়। আমি ১লাখ ৮০হাজার টাকায় একটি বাগান কিনেছি। কিন্তু ভাটার গ্যাসের কারণে বাগানের সকল আম পচে ঝরে পড়ছে। একই গ্রামের সোলায়মান আলী বলেন, ইটভাটায় এলাকার পরিবেশ দুষণ করার কারনে আমরা এলাকাবাসীরা প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন করেছি কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, ইউএনও বরাবার অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইটভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ার কারনে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ঘোষপাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ বাগান মালিক এনামুল হক বলেন, গতবছরও একই ধরনের ক্ষতিমুখে পড়ি আমরা। সে বছর বুঝতে পারিনি ইটভাটার গ্যাসের কারনে এই সমস্যা। এবার যখন আমরা বুঝতে পারলাম, তখন আমাদের সকল কিছু শেষ হয়ে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে আমাদের এখন দুর্বিষহ জীবন-যাপন করতে হবে। মৌসুমি ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলেন, আম বাগান লিজ নিয়ে পথে বসেছে আমরা। ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসের কারনে একেক জনের ৫থেকে ৭লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে। সকল পুঁজি বিনিযোগ করে সব হারিয়ে দিশেহারা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তবে ইটভাটার কোন মালিকই এবিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি। বরং উল্টো ক্ষতিগ্রস্থ বাগান মালিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে ভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নঈম উদ্দিন সেন্টু। লালপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হাবিবুল ইসলাম খান বলেন, লালপুর উপজেলায় অন্তত ২৬টি ইটভাটা থাকলেও যার একটিরও নেই অনুমোদন। কৃষি জমি থেকে দুই কিলোমিটার দুরে ইটভাটা স্থাপন এবং চিমনি ৩৮মিটার হওয়ার কথা থাকলেও সে নিয়মও মানের প্রভাবশালী ভাটা মালিকরা। আগামী দিনে কৃষিতে আরো বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছে। তিনি আরো বলেন, লালপুর উপজেলায় ১’শ ৭৮০হেক্টর জমিতে আম বাগান গড়ে উঠেছে। এই বছর ১৭হাজার ৮০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কিন্তু ইটভাটার গ্যাসের কারণে ৮৭হেক্টর জমির আম বাগান ক্ষতি হয়েছে। যা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার ৮৭০মেট্রিক টন আম উৎপাদন কম হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় কৃষি অফিসাররা সরেজমিনে ঘুরে প্রাথমিক ভাবে ৬’শ ক্ষতিগ্রস্থ কৃষককে সনাক্ত করেছে। যার ক্ষতির পরিমান অন্তত দুই কোটি টাকা। লালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নজরুল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় পরিদর্শন করেছি। ইটভাটার বিষাক্ত গ্যাসের কারনে ব্যাপক পরিমানের আম চাষীদর ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকা তৈরী করতে কৃষি বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইউএনও আরো বলেন, উপজেলায় ২৬টি ইটভাটা মধ্যে কোনটিইর বৈধতা নেই। ভাটা মালিকদের সাথে কথা বলে যেটা, জানতে পেরেছি পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন না পাওয়ার কারনে ভাটা মালিকরা লাইসেন্স করতে পারছে। তবে অবৈধ ইটভাটার মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, অবৈধ ভাবে কোন ইটভাটা চলতে পারেনা। ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিবো।
×