ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নজয়ী এক মায়ের কথা

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২৫ মে ২০১৮

স্বপ্নজয়ী এক মায়ের কথা

ব্যক্তি, সমাজ বা জাতীর বিকাশ ও গঠনে মায়ের ভূমিকা অপরিসিম। মা একটি অক্ষরের এই শব্দের মহাত্ত্ব ও ব্যাপকতা এতটাই যে তা কোন কিছু দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। মায়ের অবদানকে কোন কিছুর বিনিময়ে কিনেও নেয়া সম্ভব নয়। আধুনিক সমাজ ও পরিবার গঠনে শুধু নয় অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে মায়েদের সম্পৃক্ততা জতীয় জীবনে ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। সন্তানরা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নানা আঙ্গিকে বৈচিত্র্যের আলোয়। সন্তানদের ¯েœহ দিয়ে তাদের ধাপে ধাপে বড় করে তোলার পেছনে মায়েদের ভূমিকাকে জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য করে তোলা হচ্ছে মায়েদের সম্মাননা দিয়ে। বিষয়টি আনন্দের ও তাৎপর্যপূর্ণ। গত ১৩ মে বিশ^ মা দিবসে বাংলাদেশ সরকারের মহিলাবিষয়ক অধিদফতর বিশ^ মা দিবসে জাতীয়ভাবে দেশের ৫ জন গুণী নারীকে ‘স্বপ্নজয়ী মা’ হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেছেন। ২০১৮ সালে যে গুণী পাঁচজন নারীকে সম্মানিত করেছেন তারা হলেনÑ মোছাঃ নাজমা রহিম (দিনাজপুর সদর), মোছাঃ ফিরোজা বেগম (নবীনগর, বি.বাড়িয়ার), মোছাঃ মনিজান (সাটুরিয়া, মানিকগঞ্জ), আরতী রানী বানিক (দাসড়া, মানিকগঞ্জ) ও নীরা দে (বড়লেখা, মৌলভীবাজার)। এই পাঁচ গুণী নারীকে ‘স্বপ্নজয়ী মা’ হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বেগম মেহের আফরোজ, এমপি। এই ‘স্বপ্নজয়ী মা’ সন্তানাদের আলোকিত করেছেন। যাদের সন্তানরা শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দেশের কর্মকৌশন ও সেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে সন্তানরা মানুষের মতো মানুষ হয়ে দেশকে উত্তরণের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই সন্তানদের পাঁচ মায়ের একজন হচ্ছেন দিনাজপুরের নাজমা রহিম। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে কথা হয়ে এই নারীর সঙ্গে। জানা যায় এই মহীয়সী নারীর আলোকিত হয়ে ওঠার গল্প। মোছাঃ নাজমা রহিমের জন্ম ১৯৪৭ সালে দিনাজপুর শহরে। পড়ালেখা শুরু করেছিলেন টাঙ্গাইলের ভারতেশ^রী হোমসে। দশম শ্রেণীর ছাত্রী থাকা অবস্থায় মরণত্তোর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাবেক এমপি এ্যাডভোকেট এম আবদুর রহিমের সঙ্গে বিয়ে হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার ফলে তার নিজের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি এক নতুন অনাকিল স্বপ্ন ধারণ করেন। দৃঢ়চেতা ও মমতাময়ী এই নারী প্রতিজ্ঞা করেন যে, নিজে না পারলেও সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। কিন্তু তার এই প্রতিজ্ঞা পূরণের যাত্রা ছিল অত্যন্ত সংগ্রামময়। স্বামী এম আব্দুর রহিম বঙ্গবন্ধু সাথে রাজনীতিতে সর্বদা সক্রিয় থাকা, মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ, একাধিকবার কারাবরণ ইত্যাদি কারণে মহীয়সী মা নাজমা রহিমকে সংসার ও সন্তানদের মানুষ করার সমস্ত ভার একাই বহন করতে হয়। নারী হয়ে কৃষিনির্ভর সাংসারিক কাজ-কর্ম পরিচালনা ও সন্তান-সন্তুতি মানুষ করা ছিল অত্যন্ত কষ্টের। কিন্তু তিনি নানা সামাজিক চাপ, সমস্যা ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে ছয়জন সন্তানকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। আর এভাবেই তিন হয়ে উঠেন একজন স্বপ্নজয়ী মা হিসেবে। তার বড় ছেলে এম ইনায়েতুর রহিম বর্তমানে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কনিষ্ঠ পুত্র ইকবালুর রহিম দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ; কন্যা ডাঃ নাদিরা সুলতানা জাতিসংঘের স্বাস্থ্য বিভাগের কনসালটেন্ট; কন্যা প্রফেসর ডাঃ নাসিমা সুলতানা বর্তমানে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক; নাফিসা সুলতানা রংপুর যুব সমাজ উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যান ও সমাজকর্মী এবং নাজিলা সুলতানা একজন সমাজকর্মী। এভাবেই হাজারো সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে অত্যন্ত কষ্ট, শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন। এ ছাড়াও মমতাময়ী মা নাজমা রহিম সকল মায়ের সন্তানদের আদর্শবান, শিক্ষিত ও শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্থাপন করেন নাজমা রহিম ফাউন্ডেশন। এই ফাউন্ডেশন থেকে প্রতিবছর মেধাবী গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের দেয়া হচ্ছে নিজ অর্থে উপবৃত্তি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী এম আবদুর রহিম ও সন্তানসহ দেশছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন এই নারী। সেই সঙ্কটময় সময়ে বাঙালী জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে, স্বাধীনতা অর্জনে রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন স্বামীকে। স্বাধীন দেশে ফিরে স্বামীকে সহযোগিতার পাশাপাশি সন্তানদের মাতৃ¯েœহে লালন পালন করেছেন। নাজমা রহিম গর্ববোধ করেন কেননা তার আদর্শবান সন্তানদের প্রতিটি পেশায় রয়েছে সমাজসেবার দৃষ্টান্ত। আজীবন যে সন্তানদের নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন তারাই আব দেশ সেবায় নিবেদিত। একজন স্বাপ্নজয়ী মায়ের এটাই সব থেকে বড় অর্জন। এখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি। তিনি স্থাপন করেছেন নাজমা রহিম ফাউন্ডেশন। এই ফাইন্ডেশনের ছায়ায় জন্ম নেয় নাজমা রহিম প্রাইমারি স্কুল (যা বর্তমানে সরকারী প্রাথামিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত)। ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে প্রতিবছর মেধাবী গরিব ছাত্র ছাত্রিদের দেয়া হচ্ছে নিজ অর্থে উপবৃত্তি। হুইপ ইকবালুর রহিম নিজের তহবিল থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ালেখার খরচ বহন করছেন। এছাড়া অসহায় পিতা মাতাদের সুখ ও শান্তিকে নিশ্চত করতে গড়ে তুলেছেন শান্তি নিবাস (বৃদ্ধা শ্রম)। তার পাশেই রয়েছে এতিম শিশুদের জন্য একটি বসবাস স্থল। ’৭১ বছর বয়স্ক মমতাময়ী মা নাজমা রহিম বলেন, সন্তানদের আদর্শবান শুদ্ধ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম সে স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। সন্তানরা আমার ও আমার স্বামীর নির্দেশ মোতাবেক অসহায় পিতা মাতার দেখভালসহ সমাজসেবার নিজেদেও উৎস্বর্গিত করেছে। এখানেই আমার সুখ ও শান্তি। তিনি আরও বলেন আমি আজ ‘স্বপ্নজয়ী’ মা যে সম্মাননা পেয়েছি তা দেশের সকল মায়ের জন্য উৎসর্গ করছি। মায়ের ¯েœহে সন্তানরা আদর্শ মানুষ হবে। সমাজ ও দেশকে ভালবাসবে। এই আমার কামনা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিনাজপুরের মতো শহরে থেকে নানা প্রতিকূলতাকে মোবাবেলা করে নাজমা রহিম আজ পেরয়ছেন স্বপ্নজয়ী মালে সম্মাননা। এই মায়ের প্রতি আমাদের শুভেচ্ছা। স্বপ্নজয়ী পাঁচ মায়ের জন্য আমরা গর্ব অনুভব করি। বাংলাদেশ সরকারের মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা এমন স্বপ্নজয়ী মায়েদের সম্মানিত করার জন্য। ভবিষ্যতে এই কর্মকা-ের প্রসার লাভ করবে এই প্রত্যাশা দেশের সবার।
×