ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুল মননে নারী

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ২৫ মে ২০১৮

নজরুল মননে নারী

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভারতীয় উপমহাদেশের যে উত্তাল সময়ের সূচনাপর্ব নজরুল জন্মও সেই অগ্নিঝরা দিনের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে। যার রেশ চলতে থাকে নজরুলের শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করার এক প্রয়োজনীয় অধ্যায়ে। ফলে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর বলয়ে ভাঙ্গাগড়ার যুগান্তকারী প্রভাব জনজীবনে যে অশান্ত ঢেউয়ের তা-ব তোলে বিদ্রোহী কবি সেই সর্বগ্রাসী দুঃসময়ের বলিষ্ঠ কর্ণধার সব ধরনের অসাম্য-বৈষম্যের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলেন নারী-পুরুষের ফারাক পুরো সমাজ জীবনের এক দুঃসহ অভিশাপ। সমাজের অর্ধাংশ এই নারী জাতি যদি সামগ্রিক অধিকার চেতনা থেকে দূরে সরে থাকে তাহলে পুরো প্রেক্ষাপটই অসম ধারায় পৌঁছতে থাকবে সামনে এগুনোর বদলে। সেই বোধে নারী-পুরুষের পর্বতপ্রমাণ বিভেদকে তার সৃজন এবং মননচেতনায় নিমগ্ন করে সমতাভিক্তিক স্বাধিকার আদায়ে শক্ত কঠিন লেখনীতে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুললেন। কাব্য লক্ষ্মীর আরাধনায় ছান্দিক ঝঙ্কারে নারীকে সহযোগী পুরুষের সমপর্যায়ে অভিষিক্ত করলেন। শুভ আর মঙ্গলের বার্তাবহ হিসেবে নারীর প্রতি সমস্ত দায়বদ্ধতা নিবেদন করে তাদের জগত সংসারের অন্যতম নির্ণায়ক হিসেবে বিবেচনায় এনে পাশে দাঁড়ালেন। সুষমালক্ষ্মী বঙ্গললনার চিরায়ত রূপকে তাঁর সৃজন বোধের অনুষঙ্গ করলেন শুধু তাই নয় নারীকে তার ন্যায্য জায়গায় আসীন করতে কবির মননশক্তিকেও সম্পূর্ণরূপে উজাড় করে দিলেন। নারীদের পশ্চাদগামিতার বিভিন্ন সূচক উল্লেখ করে অবরোধ প্রথা, বাল্য বিবাহ থেকে শুরু করে শিক্ষার মতো প্রয়োজনীয় পর্বগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করলেন। সমাজ বাস্তবতার কঠিন বলয় অবলোকন করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন নারীদের সামনে চলার বাধা শুধু সমাজ কিংবা পুরুষ নয় তারা নিজেরা ও নিজেদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। কারণ নারীরা নিজেরা সচেতন না হলে এই কঠিন, অলঙ্ঘনীয় পথ কোন ভাবেই উত্তরণ করা অসম্ভব। ধর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রমাণ করলেন সমাজ-সভ্যতার সবচেয়ে বড় শক্তি নারীরাই। তাদের খাটো কিংবা অপসৃত করে আলোকিত পথ কখনও নির্ণীত হবে না তাই সমস্ত শুভ আর মঙ্গল কর্মযজ্ঞ নারীরাই যুগে যুগে সম্পাদন করে সভ্যতার ভিত্তি শক্ত করেছে। সুষমালক্ষ্মী কল্যাণী নারীকে তার যথার্থ ও সমান আসন ছেড়ে দিতে হবে বৃহত্তর সমাজের প্রত্যাশা এবং আকাক্সক্ষা পূরণের লক্ষ্য নিয়ে। নারীর সামনে থেকে সমস্ত অসম্মান, কুসংস্কার এবং অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে দিতে হবে যাতে তারা নিজেদের কর্ম, শক্তি, জ্ঞান আর দক্ষতা যথার্থভাবে প্রয়োগ করে সমাজের যোগ্য আর অধিকার সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এ জন্য সবার আগে দরকার অবরোধ প্রথাকে ভেদ করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে নিজেদের সমস্ত অন্ধকারকে পেছনে ফেলে দীপ্ত মনোবলে শুধুই সামনের দিকে তাকানো নজরুল নারী সমাজকে আলোর পথ দেখাতে শুধু সৃজন আর মনন বোধকেই জাগ্রত করেননি বাস্তব কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেই ধারাকে অবারিত করার তাগিদও অনুভব করেছেন। তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ‘সন্ধ্যাপ্রদীপ’ নামে নারীদের লেখার জন্য একটি বিভাগও উন্মুক্ত করলেন। এখানে নারীরা তাদের শিক্ষা, অধিকার সচেতনতা, পুরনো সংস্কারকে বর্জন করে আধুনিক সময়ের পথচলায় নিজেদের জোরালো অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারত। নারীরা লিখতেন তাদের মনের কথা, সামনে চলার পথনির্দেশনা, শৃঙ্খল ভেঙ্গে বের হওয়ার উৎসাহÑউদ্দীপনার হরেক রকম অনুভূতি, এসব লেখার প্রতিবাদ আসতেও দেরি হতো না। পুরুষরা তো করতই অবাক বিস্ময়ে কবি লক্ষ্য করতেন অনেক কঙ্গললনারাও তাদের নতুন জগতে পা রাখার বিপক্ষে মতামত দিতেন। শুধু তাই নয় সময়ের প্রতিনিধিদের তীক্ষè কটাক্ষ করতেও ছাড়তেন না, তাই নজরুল মনে করতেন অবরোধ প্রথা শুধু মোল্লা-পুরহিত কিংবা ধর্মীয় বিধান, সমাজ বিধি নয় এই বাধা প্রতিটি মেয়ের ভেতরের বোধেই সুদৃঢ়ভাবে গ্রথিত। সেটাকে উপড়ে ফেলতে না পারলে নারীদের চলার পথ কখনও অবাধ এবং অবারিত হবে না। নজরুলের বাণীই এক্ষেত্রে উল্লেখ্য- ‘কন্যাকে পুত্রের মতোই শিক্ষা দেওয়া যে, আমাদের ধর্মে আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা, জায়া, জননীদেরও শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই না, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চিরবন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহ-মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই সর্বপ্রথম বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কি দুঃখ সিকের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে।’ নারী শিক্ষা তথা প্রগতির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যে তুমুল আন্দোলনে বঙ্গললনাদের বাহিরে আসার প্রেরণা যোগান বিদ্রোহী কবি তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। বিংশ শতাব্দীর আলোকিত জগতে পা রাখা এই কিংবদন্তি মহীয়সী নারী সব ধরনের অবরুদ্ধতার বিরুদ্ধে যে লড়াইয়ে নেমে ছিলেন তাকে সমর্থন করে তিনি রোকেয়াকে নারী জাতির অভিভাবকের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেন। শুধু তাই নয় এই ধরনের নেতৃস্থানীয় নারীদের এই মুহূর্তে শৃঙ্খল ভাঙ্গার কাতারেও শামিল করার তাগিদ অনুভব করেন। আর সেই কারণে বেগম ফজিলাতুন্নেসা, বেগম সুফিয়া কামাল এবং মিসেস এম রহমানদের মতো প্রগতিশীল আধুনিক নারীদের সর্বক্ষণ অনুপ্রাণিত করেছেন, তাদের সাহচর্যে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছে, এমনকি তারা যে অন্য পিছিয়ে পড়ার মেয়েদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করতে পারে বলে তার দৃঢ় মতও তুলে ধরেছেন। সমাজ-সভ্যতার অগ্রগামিতায় নারী পুরুষের সমান অংশীদারিত্ব নজরুলকে সব সময় তাড়িত করত। তিনি মনে করতেন নারী পুরুষের দ্বৈত সত্তাই সমাজ-সংস্কারের নিয়ামক এবং চালিকাশক্তি। এই বিষয়ে মতভেদ থাকার কোন সুযোগ নেই, নারীকে যথাযথ মর্যাদা আর সম্মান দিতে তাঁর কবিতায় ঝঙ্কৃৃত হয়েছে সমতা আর মানবতার জয়ধ্বনি। অন্তঃপুরবাসিনী, গৃহবন্দী মেয়েরা যেভাবে সমাজ সভ্যতায় তাদের বিস্ময়কর অবদান রেখে যাচ্ছে সেখানে তারা শুধু গৃহ প্রতিমার আদলে সুষমা লক্ষ্মীর ভূমিকায়ই নামেনি সংগ্রামী অভিযাত্রায় ও লড়াকু কাতারেও নিজেদের উৎসর্গ করেছে। পিতা, স্বামী এবং পুত্রের পাশে সহাবস্থানে সমস্ত বিপদ, সঙ্কট এবং প্রতিকূল সময়ের মোকাবেলায় তাদের সমর্থন করেছে। সুতরাং নারীদের যুগান্তকারী অবদান যেমন যুগের, কালের একই ভাবে পুরুষ জাতিকে প্রেরণা আর সংহত করার কঠিন ব্রতেও তাই তো দীপ্ত কণ্ঠে কবির উচ্চারণ- কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি কত বোন দিল সেবা, বীরের স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়ে রেখেছে কেবা।
×