ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মীম মিজান

আপন আলোয় ভাস্বর যিনি

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ২৫ মে ২০১৮

আপন আলোয় ভাস্বর যিনি

আমাদের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনসহ জাতীয় বিষয়াদীতে যে মহাজনেরা তাঁদের স্বীয় কীর্তির জন্য প্রাতিস্বিকতায় ভাস্বর হয়ে আছেন তন্মধ্যে সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক নূরউল ইসলাম অন্যতম। তিনি একাধারে একজন গবেষক, শিক্ষক, অনুবাদক, কলামিস্ট, সমাজকর্মী, সম্পাদক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী। আমরা তাঁর সমসাময়িককালে অনেক লেখক, গবেষক, সম্পাদক ও কলামিস্টকে দেখি। কিন্তু মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যে রকম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর তেমনটি অন্যদের দৃষ্টিগোচর হয় না। হাতে কলম নিয়ে জাতির কর্তব্য নির্ধারণে যিনি নিরলস পরিশ্রম করে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ রচনা করে গেছেন। জাতির শেকড়কে সন্ধান করে তার ওপর ভিত্তি গড়তে বলিষ্ট ভূমিকা রাখছেন। প্রবন্ধের মাধ্যমে স্বৈরাচারীদের ভীতে কম্পন জাগিয়েছিলেন তিনিই আমাদের অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। জাতির সুবর্ণ আগামী রচনায় এই মানবহিতৈষী মহৎ করেছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। তাই তো তিনি তাঁর সকল কাজে, চিন্তনে নিজেকে দিয়েছিলেন এক স্বতন্ত্র্যতা বা প্রাতিস্বিকতা। তাঁর প্রাতিস্বিকতা তাঁকে দিয়েছে সমাজের বিবেকবান সুহৃদগণের মনাকাশে সম্মানের তোরণ। নূরউল ইসলামের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ মে, বগুড়ার ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় সংলগ্ন চিঙ্গাশপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সা’দত আলি আখন্দ, তিনি স্বনামখ্যাত লেখক ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম রাবেয়া খাতুন। সাত ভাই ও সাত বোনের সংসারে বড় সন্তান মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। পাঁচ বছর বয়সে ১৯৩২-৩৩ সালে কলকাতায় কবি কাজী নজরুল ইসলামের হাতে তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার কর্মস্থল পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন স্কুল বদলাতে হয় তাঁর। শৈশব থেকেই সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। তিনি যে আজকের জ্ঞানের মহীরুহ হয়ে উঠবেন তার চিহ্ন পাওয়া গেছিল সেই দূরন্ত শৈশবে। বইপড়ার প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আগ্রহ। প্রাপ্ত বয়সেও তিনি ছিলেন বইয়ের পোকা। বই তো জ্ঞানের ভাণ্ডার। আর সেই ভাণ্ডারের একজন কনজুমার বা নিবিড় প্রেমিক ছিলেন তিনি। বই পড়ার নেশা নিয়ে তিনি একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘মনে পড়ছে কোনো একসময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখাটির নাম ‘নেশা’। মানুষকে যে কত রকমের নেশায় পেয়ে বসে, লেখক তার একটি খতিয়ান দিয়েছিলেন। আজ নিজের বেলায় সেই নেশার কথা স্মরণ করছি। শৈশবে খেলাধুলার নেশা, ছাত্রজীবনে রাজনীতি ও পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা; তারও পরে শিক্ষকতার নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। প্রায় ৫০ বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় নিয়োজিত থেকেছি। আর মেতে থেকেছি বই পড়ার নেশায়। কোন বইটা যে প্রথম পড়েছিলাম, কাল ব্যবধানে আজ আর সেটি বলতে পারব না। তবে এইটুকু মনে আছে, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রের ঠাকুরমার ঝুলি ও ঠাকুরদার ঝুলি ভীষণভাবে মাতিয়ে রাখত আমাকে। ছাত্রজীবনে বেশি টানত দুঃসাহসিক অভিযানের বই। পাঠ্যবইয়ের ফাঁকে ফাঁকে দেশী-বিদেশী অভিযানের গল্প নেশাগ্রস্ত করে রাখত মাতালের মতো। অভিযান বলতে হিমালয়ের অভিযান, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার, ক্যাপ্টেন কুকের অস্ট্রেলিয়ার মুখে সাত সমুদ্র পাড়ি দেওয়া ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যের প্রতি টান শুরু হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বই পড়ে। প্রথম পড়ি শ্রীকান্ত। বইটি পাঠ্যবইয়ের পড়ার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তাম কিন্তু আব্বার কাছে ধরাও পড়ে যেতাম। তারপর আচ্ছামতো মার!’ কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে গ্র্যাজুয়েশনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। পরে লন্ডন ইউনিভার্সিটির প্রাচ্যভাষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র ‘সোয়াস’ থেকে পিএইচডি ডিগ্রী নেন তিনি। সিরাজগঞ্জের মোশারফ হোসেনের মেয়ে ইরার সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫৭ সালের ১১ এপ্রিল। তাঁর শ্বশুর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর তিন সন্তান ইমন, রুমনী ও রাজন। সমগ্র জীবন যাঁর কাটলো দেশ, জাতি, সমাজ, মানুষ, মানবতা নিয়ে ভাবতে। সেই মানবহিতৈষী মানসকে সমাজের শিল্পানুরাগী প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষরস্বরূপ জাতীয় একুশের পদক (১৯৮১); বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২); ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার (১৯৭৯); বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৩) ইত্যাদি পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। ঐতিহাসিক আবহে যাঁর জন্ম; বিদ্যোৎসাহী পরিবারে যাঁর বেড়ে ওঠা; কাজী নজরুলের মতো বিশ্ব বরেণ্য মানবের হাতে যাঁর প্রথম পাঠ; বাবা ছিলেন যাঁর যশস্বী লেখক ও উদারমনা; যাঁর বিদ্যাপিঠ গ্রাম্য স্কুল থেকে লন্ডন ইউনিভার্সিটি তিনি কতটা যশস্বী! কতটা প্রাজ্ঞ! কতটা খ্যাত! হ্যাঁ! তিনি তাঁর কর্মে, সৃজনে, মননে, সম্পাদনায়, অংশগ্রহণে, অবদানে অনন্য। তাঁর প্রাতিস্বিকতা শুধু তাঁর সঙ্গেই তুলনীয়। আসুন জেনে নেই অল্প-বিস্তরে তাঁর স্বতন্ত্র্যতা তথা প্রাতিস্বিকতা! গবেষণা ও গ্রন্থ সৃজনে প্রাতিস্বিকতা মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আমাদের কাছে সম্যকভাবে যে পরিচয়টির জন্য সমাদৃত তা হচ্ছে তাঁর গবেষণা। তিনি একজন প্রাজ্ঞ গবেষক। তাঁর গবেষণার বিষয়গুলো হচ্ছে ভাষাগত, প্রাচীন ঐতিহ্য, শেকড় সন্ধান, আগামী দিনের কর্মধারা ইত্যাদি। এই চৌম্বক বিষয়গুলোর গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ সমগ্র গ্রন্থাকারে পাঠকদের উপস্থাপন করতেন তিনি। এই গবেষণা ও গ্রন্থসৃজন তাঁকে করেছে জনপ্রিয়। গবেষণাচারিত্রের মানসগণ তাঁকে বরণ করেছেন শিক্ষক হিসেবে। বৃত হয়ে তিনি আত্মসুখে কালযাপন করেননি। বরং লিখার হাতকে আমৃত্যু রেখেছিলেন প্রাণবন্ত। তিনি ‘বেঙ্গলি মুসলিম পাবলিক ওপিনিয়ন এ্যাজ রিফ্লেক্টেড ইন বেঙ্গলি প্রেস’ বিষয়ের ওপর ১৯৭১ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। এই গবেষণা অভিসন্দর্ভ তাঁকে উচ্চমানের গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। মুসলিম সমাজচেতনার স্বরূপ অনুধাবনে এখন এই বই পালন করছে আকর গ্রন্থর ভূমিকা। তাঁর অন্যতম প্রবন্ধের সমাহার ‘সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ১৮৩১ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম ব্যক্তিবর্গ সম্পাদিত মোট একচল্লিশটি সাময়িকপত্র থেকে জীবন ও জনমত-বিষয়ক রচনা সংকলিত হয়েছে। রচনাগুলোকে শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম, আত্মচেতনাবোধ ও আত্মজাগরণ, মুসলিম বিশ্ব, রাজনীতি, হিন্দু-মুসলমান, অর্থনীতি, ভাষা ও সাহিত্য এবং বিবিধÑএই দশটি শাখায় বিন্যাস করে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘সাময়িকপত্রে জীবন ও জনমত’ -এর দ্বিতীয় খণ্ডে ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম ব্যক্তিবর্গ সম্পাদিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে নির্বাচিত অভিমত সংকলিত হয়েছে। তিনি প্রকৃতই একজন শেকড় সন্ধানী মানস ছিলেন। উপর্যুক্ত রচনাবলী পাঠে আমরা তাঁর শেকড়ের সন্ধানকে সম্যকভাবে জ্ঞাত হই। এ ছাড়াও তাঁর কতিপয় শেকড় সন্ধানী প্রবন্ধ-নিবন্ধ হচ্ছে : ১. নববর্ষ উদযাপনের বানডাকা আয়োজন; ২. নজরুল আপনকালে, নজরুল কালান্তরে; ৩. শাশ্বত তিনি, অমর তিনি (বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে); ৪. বাংলাদেশ, বাঙালী-আত্মপরিচিতির উৎস সন্ধান। ‘সেরা সুন্দরম্’ নামের প্রবন্ধ সংকলনটিও তাঁর শেকড় সন্ধানী মননের পরিচয়কে স্ফটিক জলের মতই তুলে ধরে। অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘সুন্দরম্’ প্রায় দেড় দশক ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটি ছিল প্রবন্ধ-আলোচনা নির্ভর। দেড় দশকে প্রায় হাজারখানেকের কাছাকাছি লেখা ঐ পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহে দেশকালের প্রেক্ষিতে বিচিত্র ও তাবৎ অনুসন্ধিৎসার ওপর আলোকপাতের প্রয়াস দেখা গেছে। ফলে সমকালের মানসভুবন এই পত্রিকায় চমৎকারভাবে বিধৃত। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রভূত সংখ্যক লেখা থেকে প্রাসঙ্গিক বিষয়ভিত্তিক বাছাই করে নেয়া ষোলটি নিবন্ধের সংকলন গ্রন্থ ‘সেরা সুন্দরম্’। এই সংকলনের বলয়-আধারে রয়েছে ভূখণ্ড বাংলাদেশ; জন-জাতি বাঙালী থেকে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ; এবং রয়েছে নানা শাখায় শিল্পিত সৃজনের স্বর্ণফসল-পরিচিতি। প্রখ্যাত গবেষক ও অনুবাদক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের বইয়ের মধ্যে ‘আত্মজীবনী : নিবেদন ইতি’র কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা এখানে তিনি তাঁর ব্যক্তিজীবনের কথা, তাঁর হয়ে ওঠার কাহিনী চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস আর সংস্কৃতির সঠিক পরিচয় পেতে বইটি পাঠককে সাহায্য করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। নূরউল ইসলামের ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’ একটি অনন্য গবেষণাগ্রন্থ। ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’ নজরুল-গবেষণায় এক বিখ্যাত ও সমাদৃত বই। এর পরিকল্পনায় ছিল একটি মহান উদ্দেশ্য। সে উদ্দেশ্য হচ্ছে সমকালীন প্রেক্ষাপটে নজরুল ইসলামকে আবিষ্কার। সন্দেহ নেই, এটি একটি ডকুমেন্টেশন। বাঙালী মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয়ের এক বিরাট অধ্যায় রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ কথা আজ বাঙালী জাতির এক সাধারণ স্বীকৃত তথ্য। একদিন এই সংবাদ ছিল অজানা-অস্বীকৃত। বলা চলে, সেই অজানা নজরুল ইসলামের কর্মজীবনের প্রামাণ্যচিত্র এটি। সমকালের দৃষ্টিতে তাঁর বিচিত্র কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন, বাঙালী মুসলিম সমাজে তাঁর গৃহীত-অগৃহীত হবার খতিয়ান, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে তাঁর স্বীকৃতি-অস্বীকৃতির দ্বন্দ্ব, প্রগতি-অপ্রগতিশীল সমাজের দোলাচল-এমন বহুতর বিষয়ের বিপুল সমাবেশে সজ্জিত সমকালে নজরুল ইসলাম। নজরুল-চর্চায়, তাই আজো, এটি একটি অমলিন ভাষ্যের দলিল। নজরুল-জীবনকে বুঝতে আরও দীর্ঘকাল আমাদের পথ দেখাবে এ শেকড়ের খোঁজ গ্রন্থ। তাঁর শেকড় সন্ধানের আরো একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ‘অমর একুশে প্রবন্ধ’ সংকলনটি। ‘মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, নূরুল ইসলাম ও মোবারক হোসেনের সম্পাদনায় ২০০০ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত অমর একুশে প্রবন্ধ গ্রন্থটিও স্মরণীয়। এটি একুশের প্রবন্ধের একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংকলন। এতে পাঁচ দশকের প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলির মধ্যে রয়েছে : মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, কাজী মোতাহার হোসেনের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কয়েকটি বিক্ষিপ্ত চিন্তা’, জীবনানন্দ দাশের ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’, মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদার ‘ওদের স্মরণে’, আবুল ফজলের ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, আবুল হাশিমের ‘ভাষা-আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলি’, মুহম্মদ এনামুল হকের ‘পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’, সত্যেন সেনের ‘ধন্য একুশে ফেব্রুয়ারি’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি : পুনর্মূল্যায়ন’, অজিত কুমার গুহের ‘ভাষা-আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, আবদুল হকের ‘ভাষা-আন্দোলনের পটভূমি,’ মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ‘আমাদের ভাষা ও সাহিত্য’, আহমদ শরীফের ‘ভাষা প্রসঙ্গে বিতর্কের অন্তরালে’, মুনীর চৌধুরীর ‘মাতৃভাষা’, শহীদুল্লা কায়সারের ‘একুশের পর’, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ‘ভাষা ও সংস্কৃতি’, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর ‘ভাষা প্রসঙ্গে ভিন্ন ভাবনা’, আহমদ রফিকের ‘স্মৃতি একুশ : বর্তমানের আলোয়’, বদরুদ্দীন উমরের ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারি’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘ভাষা আন্দোলন অর্ধশতাব্দী পরেও’, রফিকুল ইসলামের ‘শহীদ মিনারের ইতিহাস’, আনিসুজ্জামানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনা’, হাসান আজিজুল হকের ‘একুশের আন্দোলন’, আবুল কাসেম ফজলুল হকের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মর্মকথা’, সেলিনা হোসেনের ‘সংস্কৃতি ও অমর একুশে’ ইত্যাদি।’ (একুশের সাহিত্য, মাহবুবুল হক, কালি ও কলম।) ‘আবহমান বাংলা’ গ্রন্থটি অধ্যাপকের একটি গুরুত্বপূর্ণ শেকড়ের গ্রন্থ। প্রাচীনকালের নানা অনুষঙ্গ এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। বক্ষ্যমান গ্রন্থের ভূমিকায় জাতীয় অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘প্রকৃতি বৈরী হয়েছে, পশ্চিম থেকে পুব থেকে দূর দেশ থেকে বহিরাগত দস্যুশক্তি লুণ্ঠন করেছে সমগ্র দেশ। কখনো মাৎস্যন্যায়ে ছেয়ে গেছে জনপদের পর জনপদ। শতাব্দীব্যাপী দুঃশাসন দাস করে রেখেছে জনপদবাসী মানুষদের। তবু পূর্বপুরুষ আমাদের পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহ শেষ অবধি হার মানেননি। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মুখেও আপন স্বকীয়তা, আপন সংস্কৃতির প্রাণশক্তি জিইয়ে রেখেছেন। আমাদের একালের ইতিহাসেরও লেখন তাই। কেননা চিরঞ্জীব ঐ মহান সত্যÑ জীবন বহমান; মানুষের মৃত্যু নেই।’ এ ধরনের বিশ্বাস তাঁর মধ্যে নিয়ত বহমান ছিল। মনীষা জাতীয় অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখখোগ্য: শিশু-কিশোর সাহিত্য: ভীষণ প্রতিশোধ (১৯৫৫), জাপানি ভূত (১৯৫৫) ইত্যাদি। গবেষণা/প্রবন্ধ : মুসলিম বাংলা সাহিত্য (১৯৬৮), মুনশী মোহাম্মদ মেহেরুল্লা (১৯৭০), সময়ের মুখ, তাঁহাদের কথা (১৯৯৭), আপন ভুবন (২০০১) নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০০৪) ইত্যাদি। সম্পাদনা : নজরুল ইসলাম (১৯৬৯), উচ্চ শিক্ষায় এবং ব্যবহারিক জীবনে বাংলা ভাষার প্রয়োগ (১৯৭৬), আমাদের মাতৃভাষা চেতনা ও ভাষা আন্দোলন (১৯৮৪), বাংলাদেশ: বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সন্ধানে (১৯৯০), নজরুল ইসলাম : নানা প্রসঙ্গ (১৯৯১), আবহমান বাংলা (১৯৯৩), আমাদের বাঙালিত্বের চেতনার উদ্বোধন ও বিকাশ (১৯৯৪), পূর্বমেঘ : নির্বাচিত প্রবন্ধ (যৌথ, ২০০২), শিখা সমগ্র (২০০৩), সেরা সুন্দরম (২০০৭); আত্মজীবনী: নিবেদন ইতি (পূর্বখণ্ড ২০০৫, উত্তরখণ্ড ২০০৬) ইত্যাদি। অনুবাদ : কাউন্ট অব মন্টোক্রিস্টো (১৯৫৫), বাংলাদেশে মুসলিম শিক্ষার ইতিহাস এবং সমস্যা (১৯৬৯) ইত্যাদি। সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিন সম্পাদক হিসেবে প্রাতিস্বিকতা আমরা যেমনটা জেনেছি যে মেধাবী গবেষক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম তরুণ বয়সে কর্মজীবনে পদার্পণ করেছিলেন দৈনিক সংবাদের সহসম্পাদক হিসেবে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের জীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ভুবন। তিনি সংবাদ পত্রিকার সহসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মিল্লাত-এর, যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সম্পাদিত বেগম পত্রিকার সঙ্গে। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম দৈনিক ইত্তেহাদ, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাব এডিটর হিসেবে চাকরি করেন। ফজলে লোহানী সম্পাদিত বিখ্যাত অগত্যা (১৯৪৯)-এর সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথাও সুবিদিত। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত পূর্বমেঘ (১৯৬০) সাময়িকপত্রের কথা এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ষাটের দশকে পূর্ববাংলায় উন্নত সাহিত্যরুচি বিকাশে পূর্বমেঘ পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৬০ থেকে ১৯৭১Ñএকটানা এগারো বছর এ পত্রিকাটি প্রকাশ করেছেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। সুন্দরম (১৯৮৬) সম্পাদনা তাঁর সাহিত্য সাধনার এক অনন্য কীর্তি। সুন্দরম-এর প্রতিটি পৃষ্ঠায় ছড়িয়ে থাকত তাঁর মেধা মনন রুচি আর প্রযতেœর স্বাক্ষর। প্রায় একাই তিনি পত্রিকার গোটা কাজ করতেন। নিপুণ হাতে সম্পাদনা করতেন। প্রবীণ-নবীন-উভয় ধরনের লেখকের রচনা ছাপা হতো সুন্দরম-এ। এ পত্রিকায় লেখা মুদ্রিত হওয়া একসময় তরুণ লেখকদের কাছে ছিল আনন্দ আর আবেগের উৎস। এমন ঝকঝকে রুচিশীল পত্রিকা দুই বাংলায় ছিল একেবারে হাতে গোনা। কম-বেশি যাই হোক না কেন, সুন্দরম-এ প্রকাশিত প্রতিটি রচনার জন্য তিনি সম্মানী দিতেন। এটাও তাঁর কাছ থেকে একটা শিক্ষণীয় বিষয়। মাতৃভাষা ও দেশ মাতৃকার প্রেমের প্রাতিস্বিকতা ৪৮ এর বিক্ষুব্ধ মার্চ মাস। সবার দাবি একটাই ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। মুস্তাফা নূরউল ইসলামরা সবাই বিরামহীন পরিশ্রম করছেন। রমনায় এবং পুরান ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় হরতালের ডাকে প্রচারণা চালিয়েছেন। ছোট ছোট গ্রুপ মিটিং করেছেন, মিছিল করেছেন। বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু থেমে থাকেননি। এভাবেই তাঁদের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয়েছে মাতৃভাষা আদায়ের দাবি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ জনমত সংগঠিত করার জন্য তিনি বিভিন্ন পত্রিকা ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। মিটিং করতেন লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কয়ার, অক্সফোর্ড সার্কাসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে অন্যান্য প্রবাসী ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তিনি একটা সাহায্য রজনী সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এই সঙ্গীতানুষ্ঠানের সমুদয় অর্থ বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য সাহায্য তহবিলে দিয়েছিলেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে বিবিসিতে সংবাদ পাঠ করতেন তিনি। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনের অভ্যন্তরে তাঁরা মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারিত ডাকটিকেট প্রকাশনা-উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। এই উৎসব আয়োজনের উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে জানিয়ে দেয়া- আমাদের প্রবসী সরকারের রয়েছে আপন ডাকটিকেট। লন্ডনের হাইড পার্কে হাজার হাজার মানুষের গণসমাবেশ করেছেন তাঁরা। এই সমাবেশ থেকে দুটো দাবি তোলা হয়েছিল- এক. অনতিবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ২.অনতিবিলম্বে পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি। এসব কারণে তাঁর স্কলারশিপ বাতিল হয়েছিল। দেশে তাঁর ব্যাংক এ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। যার ফলে তিনি দেশে তাঁর স্ত্রী ও বাবাকে টাকা পাঠাতে পারতেন না। দেশে তাঁর বাবার বাড়ি আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। চালিয়ে গেছেন তাঁর আন্দোলন সংগ্রাম। শিক্ষক হিসেবে প্রাতিস্বিকতা একজন শিক্ষক মানুষ গড়ার কারিগর। তিনি জাতির আগামীর কর্ণধারদের পরিচর্চা করেন। আমরা জ্ঞাত যে, মনীষী শিক্ষক নূরউল ইসলাম তাঁর জ্ঞানের ব্যপ্তি ও শিক্ষতার অনন্যগুণে ২০১১ সালে দেশের একবিংশতম জাতীয় অধ্যাপকের পদ অলংকৃত করেছিলেন। পাঠদানে স্বকীয়তা, ছাত্রদের মন ও মনন বুঝে পাঠ পরিকল্পনা ও পাঠন করা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন। জাবি বাংলা বিভাগের তাঁর সরাসরি ছাত্র খালেদ হোসাইন স্মৃতিচারণ করে মহৎ শিক্ষক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘স্যার আমাদের বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক পর্যায় পড়িয়েছিলেন, ক্লাস শেষ হয়ে গেলেও তার রেশ কাটত না। মনে হতো, আমাদের মধ্যে কী এক অদ্ভুত অলৌকিক বিবর্তন ঘটে গেছে। পাণ্ডিত্য নয়, নির্ভার জ্ঞানের একটি আবহ। আমার স্ত্রী আইরীনদের স্যার পড়িয়েছেন আধুনিক বাংলা কবিতা। ও এখনো বলে, ‘তোমার কী দুর্ভাগ্য, তুমি আধুনিক কবিতা কোর্সের ক্লাস স্যারের সঙ্গে করতে পারোনি।’ অর্থাৎ যখন তিনি যা পড়িয়েছেন, তা শিক্ষার্থীদের মর্মস্থ করতে পেরেছেন অনায়াসে। বলার তাঁর বিশেষ ভঙ্গিটি সর্বজনজ্ঞাত। মনে হতো, মস্তিষ্ক নয়, তিনি হৃদয় থেকেই উচ্চারণ করেন।’ উপস্থাপনা ও অভিনয়ে প্রাতিস্বিকতা বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় যাঁর ভিতরে ঘটেছিল তিনিই আমাদের মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। তিনি শিল্প-সাহিত্যের যে শাখাতেই পদচারণা করেছেন পেয়েছেন প্রাতিস্বিকতা। রেডিও-টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তিনি রেখে গেছেন এক স্বকীয়, বৈশিষ্ট্য। তাঁর উপস্থাপনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মুক্তধারা’ কিংবা ‘বাঙালির বাংলা’, এটিএন বাংলার ‘কথামালা’ অনুষ্ঠান ছিল অতি জনপ্রিয় শিক্ষণীয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় তাঁর স্বকীয়তা ছিল সবিশেষ আকর্ষণীয়। আর অনুষ্ঠানের বিষয়-নির্বাচন তো ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর এবং কৌতূহলোদ্দীপক। ভাবা যায়, অনুষ্ঠানের বিষয় ‘তুমি’, ‘বাজে কথা’, ‘‘গুজব’ কিংবা ‘কি কথা তাহার সাথে’! ষাটের দশকে বেতারে নানা অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় মুস্তাফা নূরউল ইসলাম রেখেছেন তাঁর অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর। এনলিষ্টেড রেডিও আর্টিষ্ট ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ঘরে-বাইরে নাটকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করে পারিশ্রমিক হিসেবে পেয়েছিলেন পাঁচ টাকার চেক। শেষ জীবনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠায় মুস্তাফা নূরউল ইসলামের অসামান্য অবদান ও ভূমিকার কথা অনেকবারই নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন বলেছিলেন তাঁর জীবদ্দশায়। বহির্বিশ্বে প্রাতিস্বিকতা মুস্তাফা নূরউল ইসলাম গবেষণায়, অনুবাদে ও সৃজনে নিজদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে দেশের নামকে সমুজ্জ্বল করেছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি বক্তা, সংস্কৃতি প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন তিনি। এ ক্ষেত্রেও তাঁর প্রাতিস্বিকতা স্মরণীয়। ব্যক্তিত্বে প্রাতিস্বিকতা একজন সর্বজন গ্রহণযোগ্য মানুষ হিসেবে যে সকল গুণের সম্মিলন প্রয়োজন তার সবগুলোই ধারণ করতেন মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। তিনি ছিলেন সৎ, অমায়িক, স্বল্পাহারি, ক্যালকুলেটিভ, নীতির প্রশ্নে দৃঢ়চেতা ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধকালীন চরমপত্রখ্যাত এম আর আখতার মুকুলের ভ্রাতা মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আশ্চর্য, নিপুণ, চুলচেরা হিসেবি জীবনযাপন করতেন। বলাইবাহুল্য, নিজের পরিচয়েই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সদা ঋজু উন্নত নাসা অমায়িক আচরণ আর পরিশীলিত বাচনভঙ্গির মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ব্যক্তিত্বে পরিশ্রমী- প্রখর ব্যক্তিত্বময় স্পষ্টভাষী মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে তাঁর চারিত্রিক ও ব্যক্তিত্বের প্রাতিস্বিকতা সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়া যায় সম্যকভাবে। অজয় দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘ত্রৈমাসিক দুটো (সুন্দরম ও পূর্বমেঘ) খুলে দেখলাম এমন কি সম্পাদকীয় ও লিখেননি তিনি। মানে এক চিলতে জায়গাও নিজের জন্য রাখেননি। দরকার পড়েনি তাঁর। পুরো পত্রিকায় যে শিল্পবোধ যে রুচি আর মনন সেটাই তিনি। আর তা তিনি জানতেন বলে সম্পাদকীয়র নামে একফোঁটা জায়গা নিতে চাননি। ‘(মুস্তাফা নূরউল ইসলাম : সমুখে শান্তি পারাবার) অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পর্কে তদীয় ভগ্নি শামীম শবনম দীপ্তি বলেন, ‘আমি ১১ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট, তিনি ছিলেন সবার বড়। তার আদর-মমতায় বড় হয়েছি। তিনি কখনও হার মানতেন না।’ খালেদ হোসাইন প্রখ্যাত শিক্ষক মুস্তাফা নূরউল ইসলামের একজন স্নেহধন্য শিক্ষার্থী ছিলেন। জাবি বাংলা বিভাগে অধ্যয়নকালের এক স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘তিনি যখন মাইক্রোবাস থেকে নামতেন, আমার মনে হতো, বিশালাকৃতি কোনো মহামানবের আবির্ভাব হলো। দীর্ঘকায় সুপুরুষ, ব্যাকব্রাশ করা চুল, মুখে স্মিত হাসি। হাঁটার ভঙ্গি সবারই স্বতন্ত্র, কিন্তু তাঁর হাঁটা যেন নায়কোচিত। এ সবই মনে হতো আমরা তাঁকে ভালোবাসতাম বলে। আর সেই ভালোবাসা তিনি অর্জন করে নিয়েছিলেন নিজস্ব কৃতী ও কৃতিত্ব দিয়ে।’ (অন্তহীন আলোর উৎস ও উৎসব, শিলালিপি) সূতরাং অনুমেয় তিনি ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে কতটাই প্রাতিস্বিকতা পেয়েছিলেন! তিনি পরিণত বয়সে কর্মের মধ্যে নিবেদিত থেকে গত ৯ মে ৯২ বসন্তে পদার্পণ করে আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেছেন ওপারে। তিনি বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে, সৃজনে ও প্রাতিস্বিকতায়।
×