ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ নজরুলজয়ন্তী

আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু...

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৫ মে ২০১৮

আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু...

মোরসালিন মিজান ॥ আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু/এই ¯্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু...। বড্ড পরাধীন সময়ে ঝড়ের গতিতে ধূমকেতুর মতোই আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।’ প্রেমদ্রোহের দ্বৈতসত্তায় নিজেকে গড়েছিলেন। সাম্যের মানবের এবং মানবতার কবি ‘অপমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা’ বুকে ধারণ করেছিলেন। সারা জীবন ‘গন্ধবিধুর ধূপ’ হয়ে জ্বলা ‘দুখু মিয়া’ তিনি। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ ২৫ মে শুক্রবার ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষের’ ১১৯তম জন্মবার্ষিকী। বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ সারা দেশে দিবসটি উদ্যাপিত হবে। নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান, পড়ালেখা শুরু করেন মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে রুটির দোকানে কাজ নেন। মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। তরুণ বয়সে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। সাহিত্য চর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। কবি বিশেষ আলোড়ন তোলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি বলেছিলেন, ...আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/ আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/ আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল...। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলমান খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয় সর্বত্র। কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’ তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ার তাঁর। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়। কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। মানবতার কথা বলেছেন। সাম্যের কবি সমাজের নিচু শ্রেণীর মানুষকেও কাছে টেনে নিয়েছেন। নারীর প্রতি উপেক্ষা মেনে নেননি। ধার্মিক মুসলিম সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন তীব্র ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার ছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী।’ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন আজকের নজরুল। তবে জীবনের বড় অংশ জুড়ে ছিল নানা লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলামের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন ও সৃজনশীল কর্ম আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। কবির ক্ষুরধার অগ্নিঝরা লেখনী শোষিত নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার করে। শিক্ষা দেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। নতুন প্রজন্ম নজরুলের কর্ম চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে বলে আশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলা সাহিত্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক অবস্মরণীয় নাম। তাঁর শিকল ভাঙ্গার গানে জেগে উঠেছিল ঝিমিয়ে পড়া বাঙালী সমাজ। সাম্য, মানবতা, তারুণ্য ও দ্রোহের কবি তিনি। নজরুল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকার কাজ করছে বলেও বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশব্যাপী নজরুল জয়ন্তীর প্রস্তুতি ॥ এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনে সারা দেশে উদ্যাপিত হবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন সর্বস্তরের মানুষ। দিনভর চলবে আলোচনা স্মৃতিচারণ। জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে ত্রিশাল কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে। নজরুলের স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে থাকবে বিশেষ আয়োজন। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এছাড়া সারা দেশের অসংখ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয় কবিকে শ্রদ্ধা ভালবাসায় স্মরণ করবে। দ্রোহ প্রেম সাম্যের কবিকে অঞ্জলি জানাবে জাতি।
×