ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সাঙ্গ হলো কান চলচ্চিত্রের ৭১তম উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২৪ মে ২০১৮

সাঙ্গ হলো কান চলচ্চিত্রের ৭১তম উৎসব

বরাবরই এমনটা হয়, তবে এবার যেন তা আরও বেড়েছে। তারার মেলা বসেছিল ৭১তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র তারকারা ভিড় করেছেন উৎসব প্রাঙ্গণে। কান চলচ্চিত্র উৎস পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী চলচ্চিত্র উৎসব। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসব এবং বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে কানকেও সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং মর্যাদাপূর্ণ উৎসবের সম্মান দেয়া হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে প্রতি বছর এই উৎসব পালিত হয়ে আসছে। দক্ষিণ ফ্রান্সের রিজোর্ট শহর কানে প্রতি বছর সাধারণ মে মাসে এটি পালিত হয়। গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরেতে গত ৮ মে মঙ্গলবার সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় হয় ৭১তম কান উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। হলিউড, বলিউডসহ বিশ্বের নানা প্রান্তের তারকা অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতাদের দেখা গিয়েছে এবারের আসরে। বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে আরাধ্য এই আয়োজনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন মার্কিন চলচ্চিত্রকার মার্টিন স্করসেসি ও এবারের আসরের প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারক কেট ব্ল্যানচেট। শুরুতে ফ্রেঞ্চ নিউওয়েভের অন্যতম রূপকার ফরাসি চলচ্চিত্রকার জ্যঁ-লুক গদারের ‘পিয়েরো দ্য ম্যাডম্যান’ (১৯৬৫) ছবির একটি দৃশ্য ভেসে ওঠে পর্দায়। এই চলচ্চিত্রের একটি চুম্বন দৃশ্য নিয়েই সাজানো হয়েছে এবারের উৎসবের অফিসিয়াল পোস্টার। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক (মাস্টার অব সিরিমনিস) ছিলেন এদুয়ার্দ বেয়া। সেদিন একদিকে পিয়ানোতে সুর তুলছেন বর্ষীয়ান ফরাসি সঙ্গীতশিল্পী জেরার্ড দেগের, ওদিকে অনর্গল বলে যাচ্ছেন উপস্থাপক। এরপর মঞ্চে আসেন কান উৎসবের পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমো। তিনি একে একে মঞ্চে ডাকেন প্রতিযোগিতা বিভাগের বিচারকদের। প্রথমে আসেন ‘ব্লেড রানার ২০৪৯’ ছবির পরিচালক ডেনিস ভিলেন্যুভ। তারপর একে একে মঞ্চ আলোকিত করেন ‘ক্রাউচিং টাইগার হিডেন ড্রাগন’ তারকা চ্যাং চেন, ‘সেলমা’ ছবির পরিচালক আভা ডুভারনে, ফরাসি পরিচালক রবার্ট গেদিজিয়ন, ‘টোয়াইলাইট’ তারকা ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট, রুশ পরিচালক আন্দ্রে জিভিয়াজিন্তসেভ, জেমস বন্ড সিরিজের ‘স্পেক্টর’ ও ‘মিশন ইমপসিবল’ সিরিজের ফরাসি অভিনেত্রী লেয়া সেদু, বুরুন্ডির গায়িকা খাজা নিন। অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতা বিভাগে নির্বাচিত ২১টি ছবির পাশাপাশি প্রতিযোগিতা বিভাগের বাইরে, আঁ সার্তেন রিগার্দ ও মিডনাইট স্ক্রিনিং বিভাগে নির্বাচিত ছবির অংশ বিশেষ দেখানো হয়। তারপর ছিল গান। ফরাসি গায়িকা জুলিয়েট আহমানে পরিবেশন করেন ১৯৬৯ সালে অস্কারে সেরা মৌলিক গানের পুরস্কার জেতা মিচেল লেগ্র্যান্ডের সুর করা ‘দ্য মিলস অব মাই হার্ট’। কান চলচ্চিত্র উৎসবের রেড কার্পেট মাতিয়েছেন বলিউডের এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রী ঐশ্বরিয়া রাই। তিনি উৎসবে উপস্থিত হয়েছেন একমাত্র মেয়ের হাত ধরে। অভিনব পোশাকে আর ফ্যাশনে মুগ্ধ করেছেন কান চলচ্চিত্রে আসা মানুষদের। এ সময় কন্যা আরাধ্যর পরনেও ছিল লাল একটি গাউন। এ নিয়ে ১৭ বার তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন আর জৌলুসময় কান চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দিলেন ঐশ্বরিয়া। দুবাইয়ের প্রখ্যাত ডিজাইনার মাইকেল চিনকোর পোশাক পরে এদিন লাল গালিচায় হাঁটেন ঐশ্বরিয়া রাই। পারপেল আর ব্ল্যাক গাউন পরিহিত ঐশ্বরিয়া কেড়ে নিয়েছেন কানের সমস্ত আলো। ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক। ঐশ্বরিয়ার পোশাকটি ছিল পুরোপুরি প্রজাপতির পাখনার মতো। যা তাক লাগিয়ে দেয় উপস্থিত দর্শনার্থীদের। তবে কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭০ বছরের ইতিহাসে এক নতুন ঘটনার অবলোকন করলো বিশ্ববাসী। গত বছর থেকে হলিউডে একের পর এক যৌন হয়রানির কেচ্ছা বেরিয়ে আসার পর পরিস্থিতি এবার অনেকটাই ভিন্ন। প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের হাতে চার অভিনেত্রী এই কান উৎসবে এসেই হেনন্থার শিকার হয়েছিলেন। এরপর অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব, গ্র্যামি পুরস্কারের মতো কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭১তম আসরেও ‘# মি টু’ এবং ‘টাইমস আপ’ আন্দোলনের ছোঁয়া লেগেছে। চলচ্চিত্রের সঙ্গে নানাভাবে সংশ্লিষ্ট ৮২ জন নারীকে গতকাল শনিবার দেখা গেছে কানের লালগালিচায়। কানে পালে দো ফেস্টিভ্যাল ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে প্রবেশের মূল ফটকের সামনে এই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছেন প্রতিযোগিতা বিভাগের প্রধান বিচারক হলিউড অভিনেত্রী কেট ব্ল্যানচেট। তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন অভিনেত্রী ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট, জেন ফন্ডা, সালমা হায়েক, মারিয়ন কঁতিয়ারসহ আরও অনেক তারকা। ৮২ জন নারীর পক্ষ থেকে লিখিত বিবৃতি পড়েন বরেণ্য ফরাসি নারী নির্মাতা আনিয়েস বারদা ও অভিনেত্রী কেট ব্ল্যানচেট। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘নারী হিসেবে আমাদের প্রত্যেককেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু নিজেদের সংকল্প আর সামনে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে আজ আমরা এই সিঁড়িতে একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি।’ বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে যে নারীরা কাজ করছেন, এখানে তাঁদের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার ডাক দেন এই নারীরা। কান উৎসবে নারীদের এমন প্রতিবাদ এবারই প্রথম, তা নয়। এর আগে লালগালিচায় অভিনেত্রীরা কী পোশাক পরবেন, হিলওয়ালা উঁচু জুতা পরবেন কি পরবেন না, এসব বিতর্ক হয়েছে। তবে হার্ভি-কাণ্ডের পর বিতর্ক তার চরম সীমায় পৌঁছেছে। স্কটিশ চিত্রনাট্যকার কেইট মুওর কানকে ‘দুই সপ্তাহের পুরুষ বুদ্ধি ও নারী সৌন্দর্যের’ উৎসব বলে অভিহিত করেছেন। হার্ভি-কাণ্ডের পর কান উৎসব পরিচালক থিয়েরি ফ্রেমোও বলতে বাধ্য হয়েছেন, কান আর আগের মতো কখনোই থাকবে না। তাই হয়তো উৎসব কর্তৃপক্ষ এবার নারীদের জন্য প্রথমবারের মতো খুলেছে হেল্পলাইন। তাছাড়া কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের কড়াকড়ি নিয়ম-যে কোন ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনীতে অতিথি পুরুষ দর্শককে আসতে হবে টাক্সিডো, বো টাই, ফরমাল জুতো পরে আর মেয়েদের পরিপাটি পোশাকের জন্য পরে আসতে হবে হাই হিল। এই নিয়মের বাইরে গেলে গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরের লালগালিচায় কারও পা ফেলার সুযোগ নেই। তবে গত ১৫ মে মঙ্গলবার রাতে এই নিয়ম ভাঙলেন একজন। টাক্সিডো-বো টাই তো দূরে থাক, সেই দর্শক প্যান্টও পরেননি; চলে এসেছিলেন লালগালিচায়। নিয়ম ভাঙার পরও তারা যাকে লালগালিচায় সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেটি হলো এক বনমানুষ, চিউবাকা। মহাজগতের জনপ্রিয় ডাকাত হান সোলোর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। ‘স্টার ওয়ারস’ সিরিজের দুটো চরিত্র তারা। লালগালিচাকে মাতিয়ে তুলল কিম্ভূতকিমাকার প্রাণী চিউবাকা। নিজের লোমশ শরীর নিয়ে শুধু লালগালিচায় নয়, কানের আনুষ্ঠানিক ফটোকলেও চিউবাকা হাজির। লালগালিচায় লোমশ ‘চিউবাকা’ চরিত্রের অভিনেতা জোনাস সুতামো ছাড়া আরও হাঁটেন ছবির পরিচালক রন হাওয়ার্ড, তরুণ ‘হান সোলো’ অলডেন এরেনরাইক, তাঁর প্রেমিকা ‘কিরা’, অর্থাৎ এমিলিয়া ক্লার্ক, সোলোর গুরু ‘টবাইস বেকেট’ অর্থাৎ উডি হ্যারেলসনসহ অনেকে। উদ্বোধনী প্রদর্শনী শেষে এর পরিচালককে প্রায় তিন মিনিট দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান দর্শক। কারণ, হ্যারিসন ফোর্ডের করা কালজয়ী এ চরিত্রের ইতিহাস একটি ছবির মধ্য দিয়ে এমনভাবে গুছিয়ে আনা খুব সহজ কাজ ছিল না। এর আগে নির্মাতা ফিল লর্ড ও ক্রিস্টোফার মিলারের ছবিটি পরিচালনার কথা ছিল। পরে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিচালকের দায়িত্ব বুঝে নিয়ে অসাধ্যকে সাধন করে দেখিয়েছেন রন হাওয়ার্ড। তাই কানজুড়ে তাঁর এই সাফল্য উদ্যাপন করা হয়েছে তিন মিনিটের দাঁড়িয়ে অভিবাদন, জাঁকজমক বিচ পার্টি এবং আট মিনিটের জমকালো আতশবাজির প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭১তম আসরের পর্দা নেমেছে গত ১৯ মে শনিবার। গত ৮ মে শুরু হয়ে শনিবার শেষ হয় ১২ দিনের এই উৎসব। ৭১তম আসরে সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দ’র পেয়েছেন জাপানের নির্মাতা কোরি-ইদা হিরোকাজু। শপলিফটার্স ছবির জন্য এই পুরস্কারটি জিতেন তিনি। আসরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্রাঁ প্রিঁ পেলেন মার্কিন নির্মাতা স্পাইক লি। ‘ব্ল্যাকক্ল্যান্সম্যান’ ছবি নির্মাণের স্বীকৃতি হিসেবে ৬১ বছর বয়সী এই নির্মাতাকে দেওয়া হলো এই সম্মান। শনিবার কানের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় পালে দো ফেস্টিভ্যাল ভবনের গ্র্যান্ড থিয়েটার লুমিয়েরে বসে কানের সমাপনী আসর। সেখানে সবার বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় পুরস্কার। পুরস্কারগুলোকে পাম দ’র, গ্র্যাঁ প্রিঁ, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, সিনেফঁদাসিউ, আঁ সার্তেন রিগার্দ, ফিপরেস্কি, ক্রিটিকস উইক এমন কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
×