ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মশালায় অভিমত ॥ ফলমূল নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ

ইথোফেনে পাকানো ফল ক্ষতিকর নয়

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ২৪ মে ২০১৮

ইথোফেনে পাকানো ফল ক্ষতিকর নয়

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সম্প্রতি বাজারে অভিযান চালিয়ে কয়েক হাজার মণ আম, কলা ধ্বংস করা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকারী সংস্থা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। কর্তৃপক্ষ বলছে, জানা-বোঝার ঘাটতির কারণে এভাবে আমসহ ফলমূল নষ্ট করা হচ্ছে। এসব ফলমূল ইথোফেনের মাধ্যমে পাকানো হলেও তা অনিরাপদ বা ক্ষতিকর নয়। আর ইথোফেন ফরমালিনের চেয়েও ক্ষতিকর- এ তথ্যও সঠিক নয়। অপরিপক্ব আমে স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিক পাকা আমের চেয়ে কম থাকে। তার মানে এই নয় যে, এসব আম-কলা ধ্বংস করতে হবে। এর ফলে একদিকে যেমন কৃষক ও দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাশপিাশি জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হচ্ছে। বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। ফলমূলের বাজার চলে যাচ্ছে অন্য দেশের দখলে। বুধবার রাজধানীর বিজ মিলনায়তনে ‘মৌসুমি ফল পাকাতে বিভিন্ন রাসায়নিকের ব্যবহার ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক কর্মশালায় এসব বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বক্তারাও। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান(অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ মাহফুজুল হকের সভাপতিত্বে কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ ইকবাল রউফ মামুন। এছাড়া বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. শাহ মনির, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক(পুষ্টি) ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম, একই প্রতিষ্ঠানের হর্টিকালচার বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক শাহ মোঃ আকরামুল হক, বারি’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মনোরঞ্জন ধর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি (অপারেশন) শাহেদ আলম, বিএসটিআইএর সহকারী পরিচালক এ এস এম আবু সাইদ, ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভুইয়া, কৃষি বিপণন অধিদফতরের আব্দুর রশিদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা দলের পরিদর্শক কামরুল হাসান প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মনজুর মোর্শেদ আহমেদ, মাজেদা বেগম, মাহবুব কবীরসহ পদস্থ কর্মকর্তারা। সম্প্রতি র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) দুই অভিযানে আড়াই হাজার মণ এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) ৪০০ মণ আম ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের অভিযোগ, আমগুলো অপরিপক্ব এবং কার্বাইড ও ইথোফেন দিয়ে পাকানো হয়েছে। এই আম স্বাস্থ্যের জন্য কি ক্ষতিকর কিনা? এর জবাবে নিরাপদ খাদ্য কর্তপক্ষ বলেছে- অপরিপক্ব আমে স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিক পাকা আমের চেয়ে কম থাকে। কিন্তু এটা ক্ষতিকর নয়। তাই এসব আম ধ্বংস করার কোন মানে হয় না। আর কার্বাইড (ক্যালসিয়াম কার্বাইড) দিয়ে পাকালে ফলে এর অবশিষ্টাংশ বা রেসিডিউ থাকে না। তাই তা ক্ষতিকর নয়। আবার নির্দিষ্ট মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার করে ফল পাকানো দেশের আইনে বৈধ। সারা বিশ্বেও তাই। ২০১৪ সালের আগে ফরমালিন মেশানোর অভিযোগে প্রচুর আম ও অন্যান্য ফল ধ্বংস করা হয়েছিল। পরে দেখা যায়, যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করা হচ্ছে, তা বাতাসে ফরমালডিহাইড মাপার যন্ত্র। তিনটি সংস্থার পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে হাইকোর্ট সেই যন্ত্রটি ফল ও মাছে ফরমালিন পরীক্ষায় অকার্যকর ঘোষণা করেন। এ অবস্থায় ফল পাকানোর বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি জানাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নিয়ে বুধবার কর্মশালার আয়োজন করে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, আইনে ফল পাকাতে নির্দিষ্ট মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার বৈধ। তবে কার্বাইড ব্যবহার বৈধ নয়। এটি ব্যবহার করার ফলে এর কোন ‘রেসিডিউয়াল ইফেক্ট’ থাকে না, তাই ক্ষতি নেই। অপরিপক্ব আম পাকানোর দায়ে ব্যবসায়ীদের জরিমানা করা যায়, সাজা দেয়া যায়। কিন্তু ফল ধ্বংস করা উচিত নয়। এতে দেশ ও জাতির অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। বহির্বিশ্বে দেশের ফলমূল বাজার হারাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম কিস্তু তারা আসেননি। হয়ত দাফতরিক কাজে ব্যস্ত। এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ঘটনাস্থলে তথ্য-প্রমাণ ও উপস্থিত টেকনিক্যাল লোকজনের মতামতের ভিত্তিতেই ফলমূল ধবংস করা হয়েছে। যা হয়েছে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী করা হয়েছে। এ নিয়ে নিরাপদ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার এক ঘণ্টা কথা হয়েছে বলেও জানান। সারওয়ার আলম আরও বলেন, বুধবারের কর্মশালায় তাদের আমন্ত্রণ জানালে তারা অবশ্যই উপস্থিত থাকতেন। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের জনবল সঙ্কট তুলে ধরে মাহফুজুল হক বলেন, সাম্প্রতিক ফলমূলের ভেজাল বিরোধী অভিযানে তাদের প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিল কিন্তু আমরা দিতে পারিনি। কারণ, আমাদের লোকবল মাত্র ১৬ জন। আমাদের প্রতিনিধি থাকলে হয়ত এমন পরিস্থিতি হতো না। ফলমূল শাক-সবজিতে রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ ইকবাল রউফ মামুন বলেন, ইউরোপে আমের ইথোফেনের নির্ধারিত মাত্রা বা এমআরএল প্রতি কেজিতে শূন্য দশমিক ০৫ মিলিগ্রাম। আম পাকার সময় প্রাকৃতিকভাবেও ইথোফেন তৈরি হয়। আর কার্বাইড ব্যবহার দেশের আইনে নিষিদ্ধ। এটি যিনি প্রয়োগ করবেন, তার স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা থাকে বলে আমরা কার্বাইড ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করি। তবে ফলের ভেতরে কার্বাইড প্রবেশের ঝুঁকি কম। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. শাহ মনির বলেন, কোন অসাধু ব্যবসায়ী যদি ইচ্ছাকৃত অখাদ্যকে খাদ্যের সঙ্গে মিশ্রিত করে বিক্রি করে সেটা অবশ্যই দ-নীয় অপরাধ। স্বার্থান্বেষী মহল অনেক সময় জনমনে পেনিক সৃষ্টি করে থাকে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে ফলমূল ও শাকসবজিতে ফরমালিন কাজ করে না। এছাড়া আমসহ ফলমূলে প্রাকৃতিকভাবেই ফরমালিন রয়েছে যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। কাজেই হুজুগে ফলমূল খাওয়া বন্ধ না করে জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক(পুষ্টি) ড. মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, ইথোফেন ও ফরমালিন দুটিই ফল পাকাতে ব্যবহƒত হয়। কার্বাইডে আম পাকালে তা অবৈধ হলেও ইথোফেন দিয়ে পাকানো বৈধ। এটা ক্ষতিকর নয়। এটি গ্যাস; যা ফলের সঙ্গে থাকে না। বাতাস হয়ে উড়ে যায়। কাজেই অপরিপক্ক ফলমূল রাসায়নিকের মাধ্যমে পাকালেও তা ক্ষতিকর নয়। হয়ত পুষ্টিগুণ বা স্বাদ কম হবে। এর জন্য টন টন ফলমূল ধ্বংস করা উচিত নয়। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মনোরঞ্জন ধর বলেন, কৃষকরা যেন অপিরপক্ব ফলমূ বাজারজাত না করে সে ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের ন্যায় ফল পাকানোর ‘ইথিলিন চেম্বার’ গড়ে তুলতে হবে, যা প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রয়েছে।
×