ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টানা বর্ষণে জনদুর্ভোগ ॥ গ্রীষ্মের বিচিত্র রূপ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৪ মে ২০১৮

টানা বর্ষণে জনদুর্ভোগ ॥ গ্রীষ্মের বিচিত্র রূপ

শাহীন রহমান ॥ ঋতুবৈচিত্র্যের ধরন অনুযায়ী প্রকৃতিতে এখন খরতাপ বিরাজ করার কথা। বয়ে যাওয়ার কথা প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ। দাবদাহে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠার কথা। বর্ষা মৌসুম আসতে এখনও ২৪ দিন বাকি। অথচ আবহাওয়া বৈচিত্র্যের সব নিয়ম ভঙ্গ করে চলছে অবিরাম বৃষ্টিপাত। শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ার পর গত মার্চ থেকে বৃষ্টির যে ধারা আর কালবৈশাখী শুরু হয়েছে তা এখনও অব্যাহত। আবহাওয়া অফিস বলছে, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। তারা জানায়, শুষ্ক মৌসুমের এই সময়ে টানা তিনমাস অবিরাম বৃষ্টিপাতের রেকর্ড খুব কমই আছে। আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, অতীতে এ ধরনের একটানা বৃষ্টিপাতের রেকর্ড থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৩ সালের পর এই ধরনের বৃষ্টিপাতের কোন রেকর্ড নেই। তিনি জানান সামনে আরও বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। আবহাওয়া অফিসের রেকর্ড বলছে, এ বছর এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে শতকরা ৩৬.৭ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। মে মাসে এখন পর্যন্ত যে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে তাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। গত মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তারা জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পুবালি বায়ুর সংমিশ্রণ এবং বায়ুম-লের নি¤œস্তরে জলীয়বাষ্পের জোগান বেশি থাকায় এ বছর বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। এছাড়া প্রতিবছর এ সময় সাগরে নি¤œচাপ হলেও এবার কোন নি¤œচাপ সৃষ্টি হয়নি। ফলে স্থলভাগে এর প্রভাব পড়ছে বেশি। এই তিনের সমন্বয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অন্য বছরের তুলনায় বেশি। তবে আবহাওয়া অফিস বলছে, তিনমাস একটানা বৃষ্টিপাত হলেও এই মুহূর্তে দেশে আগাম বন্যার কোন আশঙ্কা নেই। দেশের অধিকাংশ নদনদীর পানি হ্রাস, বৃদ্ধি স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহেও ভারি বৃষ্টিপাত বা পাহাড়ী ঢলের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না। তবে আবহাওয়া অফিস জানায়, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে জুনের শেষে বা জুলাইয়ে বন্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এদিকে, গ্রীষ্মের এই সময়ে বৃষ্টিপাতের কারণে গরম থেকে জনগণ স্বস্তি পেলেও এর ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। বজ্রপাতের কারণে এ বছর কয়েক শ’ লোকের মৃত্যু ঘটেছে। ফসলের ক্ষতি হচ্ছে ব্যাপক। ক্ষতির মুখে পড়েছে বোরোধান। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের কারণে মাঠে ধান কাটা নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে কৃষককে। প্রতিদিন বৃষ্টির কারণে রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি তলিয়ে যাওয়ায় নগরবাসীর ভোগান্তির শেষ নেই। রমজান শুরু হওয়ার পর একদিনও বৃষ্টির হাত থেকে রেহায় পায়নি নগরবাসী। বুধবার সকাল থেকেই দেশের বিভিন্নস্থানে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এদিন খোদ রাজধানীতেই ৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই বৃষ্টিপাতের কারণে বেশ ভোগান্তিতেও পড়তে হয়েছে অফিসগামীসহ স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীকে। আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী, চলতি সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতেও থাকছে বৃষ্টি। বুধবারের বৃষ্টিতেই রাজধানীর ব্যস্ততম বিভিন্ন এলাকার সড়ক তলিয়ে যায়। নগরবাসীকে বরাবরের মতো অসহায়ের মতো চলতে দেখা গেছে গন্তব্যে। রাজধানীর কাকলী, চেয়ারম্যানবাড়ি, বনানী এলাকার সড়কের উভয়পাশেই হাঁটুপানি থেকে কোমরপানি জমে যায় সামান্য বৃষ্টিতে। ফলে এই সড়কে যানজট তীব্রতর হতে দেখা গেছে। এছাড়াও সকাল থেকে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় আগারগাঁও, শেওড়াপাড়া, কালশি, মিরপুর-১২ এলাকা পানিতে থৈ থৈ করতে দেখা গেছে। এদিকে দেশে কয়েক মাস ধরে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলেও এখনই আগাম বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, বর্তমান দেশের অধিকাংশ নদীর পানির হ্রাস-বৃদ্ধি স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এসব নদীর পানির হ্রাস, বৃদ্ধির সামান্য পরিবর্তন ঘটতে পারে। তবে এখন তারা বড় বন্যার কোন আশঙ্কা দেখছেন না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, জুন-জুলাই দেশে বন্যার গতি-প্রকৃতি বোঝা যাবে। এই মুহূর্তে নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি যে পরিসংখ্যান ততে বন্যার কোন আশঙ্কা নেই। তারা জানিয়েছে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেরেশর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোন ময়মনসিংহ শেরপুর জেলার কিছু স্থানে এবং এর আশপাশে ভারতীয় অংশে মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এসব জেলার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতলে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এর বাইরে দেশের অন্যত্র নদী-নদীর পানি বৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দেশের প্রধান প্রধান নদীসহ অধিকাংশ নদীর পানিই সমতলে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কাও এই মুহূর্তে নেই। এবারের আবহাওয়ার গতি-প্রকতি অন্য বছরের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন। শীত মৌসুমে শুরু হওয়ার পরই দেশে কালবৈশাখীর আধিক্য দেখা দিয়েছে। এছাড়া গত মার্চ মাস থেকেই দেশে অব্যাহতভাবে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বৃষ্টিপাতের কারণে প্রকৃতিতে যেমন গ্রীষ্মে প্রচ- গরম অনুভূত হচ্ছে না তেমনি প্রতিবছর এই সময়ে তাপপ্রবাহ থাকলেও এবার তাপপ্রবাহের দেখা মেলেনি। তাপমাত্রাও রয়েছে সহনীয় অবস্থায়। তারা বলছে, দীর্ঘমেয়াদী পশ্চিমা লঘুচাপ বিরাজ করার কারণে এবং সাগরে কোন নি¤œচাপ না থাকায় স্থলভাগে কালবৈশাখীর পাশাপাশি বৃষ্টিপাতের আধিক্য রয়েছে। তবে মার্চ মাস থেকেই অব্যাহতভাবে বৃষ্টিপাত হলেও এখন পর্যন্ত দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তবে তারা জানান, দেশের বন্য পরিস্থিতি মূলত নির্ভর করে ভারি বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসার ঢলের ওপর। আগামী জুন-জুলাই হলো বৃষ্টিপাতের মৌসুম। এই সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক বৃষ্টিপাত হলেই বন্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে উজানে ভারি বৃষ্টিপাত এবং নেমে আসা পানির কারণে দেশের উত্তর- পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। ওই সময়ে দেশের উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহের পানিও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। মূলত দেশের ভেতরে ভারি বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণেই ওই অবস্থার সৃষ্টি হয়। সরদার উদয় রায়হান জানান, বর্তমান দেশের কোন নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে না। ফলে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার আশঙ্কাও নেই। আবহাওয়া অদিফতরের সাবেক পরিচালক শাহ আলম বলেন, প্রতিবছর এই সময় সাগরে বেশ কয়েকটি নি¤œচাপের জন্ম হয়। এবার এই সময় নি¤œচাপের কোন দেখা পাওয়া যায়নি। সাগরে নি¤œচাপ না থাকায় স্থলভাগে কালবৈশাখী এবং বৃষ্টিপাতের আধিক্য অন্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়াও পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাব অনেক বেশি। পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পুবালি বাতাসের সংমিশ্রণের কারণে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হয়। এ গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত আবহাওয়া প্রতিবছর ভিন্ন আচরণ করছে। গত কয়েক বছর দেশে বৃষ্টিপাতের কম আধিক্য দেখা দিয়েছে। এর আগে বৃষ্টিপাত ছিল না বললেই চলে। তারা জানান, সম্প্রতি বৃষ্টিপাতের ধরন বদলেছে। বিশেষ করে গত বছর থেকেই অধিক বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছর এপ্রিলে যে বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে তা আবহাওয়া অধিদফতরের কাছে থাকা চার দশকের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এছাড়াও গত বছরজুড়েই ছিল বৃষ্টিপাতের আধিক্য। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। তবে গত বছর হাওড় অঞ্চলের আগাম বন্যা বাদ দিলে জুন-জুলায়ের আগে কোন বন্যার দেখা মেলেনি। এবার মৌসুমের শুরুতেই বৃষ্টিপাতের আধিক্য দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ বছর মার্চ মাস থেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ বছর এপ্রিল মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। গতবারের সঙ্গে তুলনা করলে এবার ১ থেকে ২১ মে পর্যন্ত স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তারা জানায়, ২০১৫ সাল থেকে বৃষ্টিপাতের এই প্রবণতা শুরু হয়েছে। অধিদফতরের গবেষণায় পাওয়া তথ্য বলছে, ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে এপ্রিল ও মে মাসে গড় বৃষ্টিপাত ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা কম। আবার ১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৩০ বছরে বৃষ্টিপাতের ধরন একই রকম ছিল। তবে বৃষ্টিপাতের ধরন যাই হোক এ বছর এই মুহূর্তে আগাম বন্যার কোন পূর্বাভাস নেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে।
×