ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে ব্যয় শত কোটি টাকা

রূপগঞ্জে ৩শ’ মাদকের স্পট

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ২৪ মে ২০১৮

রূপগঞ্জে ৩শ’ মাদকের স্পট

নিজস্ব সংবাদদাতা, রূপগঞ্জ, ২৩ মে ॥ মাদকের কালো থাবায় ফোকলা হয়ে পড়েছে রূপগঞ্জের অর্থনীতি। বিভিন্ন সমীক্ষালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, উপজেলায় প্রায় ৫০ হাজার মাদকসেবী রয়েছে। বছরে এসব মাদকসেবীর অপচয় হয় প্রায় শতকোটি টাকা। রূপগঞ্জে মাদকের স্পট রয়েছে ৩শ’র ওপরে। এর মধ্যে চনপাড়া পুনর্বাসনে মাদকস্পট রয়েছে একশ’র ওপরে। আর মাদক কারবারি রয়েছে প্রায় ৪শ’। খুচরা বিক্রেতা রয়েছে প্রায় ১২শ’। শর্টকার্ট ফর্মুলায় বড়লোক হওয়ার আশায় অনেক তরুণ ও নারীরা এ পেশায় ঝুঁকছে। মরণ নেশা গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইসপিল, টিডিজেসিক ও লুপিজেসিক ইনজেকশন নানা ধরনের নেশায় সয়লাব হয়ে গেছে রূপগঞ্জ। এসব মাদকের বিষাক্ত ছোবলে হাজার হাজার তরুণের জীবন বিপন্ন। মাদক সেবন করে মাদকাসক্তরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। গত এক দশকে মাদক সংক্রান্ত ঘটনায় ৬ ব্যক্তি খুন হয়েছেন। এ ছাড়া সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ শতাধিক। মাদক কারবারর সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। সব সরকারের আমলেই এরা বহালতবিয়তে মাদককারবার চালিয়ে আসছে। রূপগঞ্জে মাদকের জাল বিস্তার হচ্ছে। এ উপজেলার ১২৮টি গ্রামের মধ্যে একশ’ ১২টি গ্রামেই মাদককারবার চলছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে যারা ॥ পুলিশ, এলাকাবাসী, মাদকসেবীদের দেয়া তথ্য ও এলাকায় অনুসন্ধানে চালিয়ে জানা যায়, নয়ামাটি এলাকার মৃত হবুল্লার ছেলে কবির হোসেন, নগরপাড়া এলাকার মৃত তাফাজউদ্দিনের ছেলে মিতু মিয়া, রাতালদিয়া এলাকার রহমান আলীর স্ত্রী ছলে বেগম, সাওঘাট এলাকার মৃত উকিলউদ্দিন ভুঁইয়ার ছেলে মোশারফ হোসেন রঞ্জু, দরিকান্দি এলাকার পোশানির ছেলে মজিবুর রহমান, মাছিমপুর এলাকার আঃ সালামের ছেলে জসিম, আঃ মজিদের ছেলে পরদেশী সফিক, রূপগঞ্জ থানার পাশের নিলু ফকিরের ছেলে জুয়েল, রূপসী স্লুইচগেট এলাকার চান্দু ফকিরের ছেলে জামাল-কামাল, মাছিমপুর এলাকার আকছারউদ্দিনের ছেলে তাওলাদ, চনপাড়া এলাকার বাদশা মিয়ার ছেলে ফেন্সি ফারুক, খোয়াজ বক্স হাওলাদারের ছেলে শাহআলম, কালাদি এলাকার সোলায়মান মিয়ার ছেলে আমানউল্লাহ, সিদ্দিক মিয়ার ছেলে আলতাফ হোসেন, আতলাশপুর এলাকার ফারুক মোল্লার ছেলে নিশাত মোল্লা, হাটাবো টেকপাড়া এলাকার আঃ হেকিমের ছেলে মিলন, তারাব হাটিপাড়া এলাকার ফিরোজ মিয়ার ছেলে আতিকুর রহমান, আক্কাস আলীর ছেলে সোহেল মিয়া, মধুখালী এলাকার ছাদেক মিয়ার ছেলে আবুল কসাই, গোয়ালপাড়া এলাকার নুরমোহাম্মদের ছেলে শফিকুল, ছনি এলাকার আমির হোসেনের ছেলে শামীম, গর্ন্ধবপুর এলাকার ফারুক মিয়ার স্ত্রী জাহানারা বেগম, আব্দুল হকের ছেলে আব্দুল সামাদ মিয়া, কাজেম মিয়ার ছেলে শরীফ মিয়া, ছফুল উদ্দিনের ছেলে ফারুক মিয়া, কামশাইর এলাকার হাবিবুল্লাহ মোল্লার ছেলে মিন্টু মোল্লা, তারাব হাটিপাড়া এলাকায় মাদক সম্রাট ফরিদ, দক্ষিণ মাসাবো এলাকায় মহসিন, বরপা এলাকায় রুহুল সিকদারের পুত্র সাইফুদ্দিন, তোবারকের পুত্র নাহিদ ও তানভীর, লতিফের ছেলে অহিদ, সহিদ, মিজানের পুত্র শাহিনসহ আরও অনেকে। এরা সবাই মাদকের ডিলার। কেউ ইয়াবা, কেউ ফেনসিডিল, কেউ হেরোইন আবার কেউবা গাঁজার পাইকারি বিক্রেতা। যেসব রুট দিয়ে আসছে মাদক ॥ অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপগঞ্জে সড়ক ও নৌপথে অবাধে মাদকদ্রব্য আসে বলে জানায় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা। মাদক প্রবেশের সবচেয়ে নিরাপদ রুট হচ্ছে বালু নদ। এ নদে পুলিশ টহলের ব্যবস্থা না থাকায় মাদককারবারিরা নির্বিঘেœ ইঞ্জিনচালিত ট্রলারযোগে মাদক আনা-নেয়া করে। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যা নদ দিয়েও মাদকদ্রব্য রূপগঞ্জে ঢোকে। এ নদ দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজে করে মাদক ঢোকে রূপগঞ্জে। এ দিকে, এশিয়ান হাইওয়ে সড়ক দিয়ে বিভিন্ন যানবাহনে কুমিল্লা থেকে মাদক ঢোকে রূপগঞ্জে। আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে মাদক ঢোকে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভুলতা হচ্ছে মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট। আখাউড়া, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইন বাস, নাইটকোচ, সংবাদপত্রবহনকারী মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাকযোগে আসে। পাচারের নানা কৌশল ॥ পুলিশ ও মাদক কারবারিদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র জানায়, মাদককারবারিরা নানা কৌশলে মাদক বহন করে থাকে। সূত্রটি জানায়, ইয়াবা ও ফেনসিডিল বহন করা হয় লাউ, নারিকেল আর ম্যাচের বাক্সের ভেতরে করে। হেরোইন বহন করা হয় মিষ্টির প্যাকেটের ভেতরে করে। আর গাঁজা বহন করা হয় ছালার চটের ভেতরে করে। মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হয় কোমলমতি ছেলেমেয়েদের। সূত্রটি জানায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের দিয়ে মাদক বহন করা হয়। মহিলাদের বিশেষ স্পর্শকাতর জায়গায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা রেখে বহন করা হয়। মাদককে ঘিরে ৬ খুন ॥ থানা পুলিশ ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, গত সাত বছরে নেশার কাজে বাধা ও প্রতিবাদে ৫ জন খুনের শিকার হয়েছেন। ২০০৮ সালের ২৭ আগস্ট মাদকের টাকা দিতে অস্বীকার করায় গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের মাহনা এলাকায় কারবারি নুরুল ইসলাম মোল্লাকে তার নেশাসক্ত ছেলে মিলন মোল্লা ও তার সহযোগীরা হত্যা করে। পরে বস্তাবন্দী করে একটি মজাপুকুরে ফেলে দেয়। ১৯৯৫ সালে চনপাড়া বস্তিতে মাদকে বাধা দেয়ায় তারা মিয়া নামে একজনকে খুন করে পিচ্চি মালেক। ২০০৮ সালের ২৫ অক্টোবর চনপাড়া বস্তিতে মাদক কারবারে বাধা দেয়ায় আব্দুর রহমান নামে এক যুবককে প্রকাশ্যে রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে মাদক কারবারিরা। ২০১১ সালে মাদক কারবারে বাধা দেয়ায় মাছিমপুর এলাকায় নজরুল ইসলাম বাবু নামে এক যুবকেকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালে হাটাবো এলাকায় মাদক কারবারে বাধা দেয়ায় সোহেল মিয়া নামে এক যুবককে হত্যা করে মাদক কারবারিরা। ২০১৪ সালের ২৯ মার্চ মাদক সেবনে বাধা দেয়ায় জনতা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহেদী হাসান বাবুকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে। আর এ ছাড়া হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৫ শতাধিক। মাদক সেবন করে গত কয়েক বছরে মারা গেছে ৩ জন। প্রশাসনের বক্তব্য ॥ রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মনিরুজ্জামান বলেন, মাদক নিয়ে রীতিমতো অভিযান চলে। রূপগঞ্জে অনেক এলাকা দুর্গম। এসব এলাকায় যেতে লাগে অনেক সময়। এ সুযোগে মাদক কারবারিরা পালিয়ে যায়। বেচাকেনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে বলেন, অনেক সময় ভুলে মাদক সেবনকারীদের ধরে নিয়ে আসে। এ সময় তদবির হলে ছেড়ে দেয়া হয়। এমপির বক্তব্য ॥ স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী (বীর প্রতিক) বলেন, মাদক কারবারিরা কোন দলের না। তারা দল এবং জাতির শত্রু। এদের কোন ছাড় নেই। মাদক নির্মূলে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে হবে।
×