ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভিক্ষা করছেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক শেখ আর কোটাওয়ালারা তাতেও যুক্তি খুঁজছে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৪ মে ২০১৮

ভিক্ষা করছেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক শেখ আর কোটাওয়ালারা তাতেও যুক্তি খুঁজছে -স্বদেশ রায়

ফেসবুকে আমি নিজের লেখা ছাড়া সাধারণত কিছু শেয়ার করি না। তবে স্নেহাস্পদ সাংবাদিক আমির মোহাম্মদের একটি পোস্ট দেখে চোখে জল এসে গেলো। শেয়ার না করে পারলাম না। আমির মোহাম্মদ একটি ছবি শেয়ার করেছে। ছবিটি মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবদুর রাজ্জাক শেখের। তাঁর ঠিকানা, গ্রাম: নান্দুয়ালি, থানা ও জেলা- মাগুরা, বিভাগ- খুলনা। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে তিনি একটি ব্যানারে নিজের পরিচয় লিখে ভিক্ষে করছেন। ভদ্রলোক মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় পত্রের নম্বর দিয়েছেন ওই ব্যানারে। আমাদের বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাই একজন মুক্তিযোদ্ধা এ দেশের কে, তিনি আমাদের কী হন- সে সত্য তাঁর কাছে বলার প্রয়োজন পড়ে না। শুধু এইটুকু বলব, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গর্ব, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান- এই সব সাধারণ শব্দে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকাশ করা যায় না। যেমন, এ রোজ ইজ এ রোজ, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেবলমাত্র প্রকাশ করা যায় একটি শব্দে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তাই এ দেশে যখন একজন মুক্তিযোদ্ধা এভাবে ভিক্ষে করেন তখন সত্যিই দেশের মাথা হেঁট হয়ে যায়। স্নেহভাজন সাংবাদিক আমিরের প্রতি আমার আস্থা আছে, তাই নতুন করে আর এই ছবির সত্যতা খুঁজতে যাইনি। এখন শুধু বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীকে বলব, যত শীঘ্র সম্ভব মোঃ আবদুর রাজ্জাককে প্রয়োজনীয় সকল রকম সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করে, দেশ ও জাতিকে অপরাধমুক্ত করুন। কোন মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষে করছে, এ দেশে এটা নতুন নয়। ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টের পর থেকে ২১ বছর এ দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের একটানা শাসন চলেছে। আর ওই শাসনামলে মুক্তিযোদ্ধাদের যতভাবে পারা যায় নিষ্পেষণ করা হয়েছে। তাই মাঝে মাঝেই আমাদের সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায় খবর দেখতে হয়, একজন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা জীবিকার প্রয়োজনে তীব্র গরমে রিক্সা চালাচ্ছেন। আবার কখনও কখনও খবর আসে ভিক্ষে করছেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। নিজের চোখে দেখা একটি ঘটনা বলি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পরে একটি বাজারে দেখি একজন মুক্তিযোদ্ধা মাছ বিক্রি করছেন। মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগেও তিনি মাছ বিক্রি করতেন। যুদ্ধ করে, দেশ স্বাধীন করে, বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে তিনি আবার নিজ পেশায় ফিরে গেছেন। যা হোক, জিয়াউর রহমান যখন জেল থেকে ৩৩ হাজার খুনী, ধর্ষক, রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানদের ছেড়ে দেয়, তখন এক শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান জেল থেকে মুক্তি পাবার পরে একদিন- বাইসাইকেলে চেপে ওই বাজারে আসে। মুক্তিযোদ্ধা ভদ্রলোক উবু হয়ে বসে মাছ বিক্রি করছেন। ওই শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান সাইকেলের এক পা প্যাডেলে রেখে আরেক পা ওই মুক্তিযোদ্ধার হাঁটুর ওপর দিয়ে বলে, এই মুক্তিযোদ্ধা, চুক্তিযোদ্ধা তোর মাছের দাম কত? মাছ বাজারের সব লোক তার দিকে তাকাতেই শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তার পা টেনে নেয়। তবে তারপরে চোখের সামনে দেখলাম শীঘ্রই সে আবার ওই এলাকার দ-মু-ের কর্তা হয়ে পড়েছে। ১৯৭৫-এর পনেরো আগস্টের পর থেকে একুশ বছর মুক্তিযোদ্ধারা মূলত এমনিভাবে অপমানিতই শুধু হননি, শহীদ পরিবারের সদস্যদের জন্য বঙ্গবন্ধুর আমলে বরাদ্দ দেয়া বাসস্থান অবধি ছাড়তে হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে সরকার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে সামান্য ক’টা টাকা ভাতা দেয়া হয়, সেটাই করা হয়েছে। অন্য কিছু করা হয়নি। একুশ বছর টানা মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হয়েছে। পাঁচ বছর এ দেশে চিহ্নিত আলবদর নেতা নিজামী ও মুজাহিদ মন্ত্রী ছিল- এরা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করেই শেষ করেনি। ভবিষ্যতে যাতে মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকাররা সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক মেরুদ- ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সত্য উপলব্ধি করে যখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও তাদের পরবর্তী জেনারেশনকে টেনে তোলার জন্য চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রাখেনÑ তখন দেখা গেল রাজাকারের সন্তানরা সাধারণ ছাত্রদের প্রতারিত করে রাজপথে নেমে এলো। দুর্ভাগ্যজনক হলো, দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, এমনকি ছাত্রলীগের একটি অংশ এই রাজাকার আলবদর সন্তানদের প্রতিহত না করে তাদেরকে সমর্থন দিল। মিডিয়ার বড় অংশ তাদেরকে সাধারণ ছাত্র বলে সমর্থন দিল। বাস্তবে ১৯৭৫ এর পর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়ার কাজ করেছে যারাÑ সেই কাজের অংশ হিসেবে এই রাজাকার আলবদরের সন্তানরা সাধারণ ছাত্রদের প্রতারিত করে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলোকে ঠেকাতে পথে নেমেছে- এই সত্য এখনও দেশের সকল মানুষ বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছে। টানা একুশ বছর সামরিক শাসন ও ছদ্ম সামরিক শাসনের নামে রাজাকার আলবদররাই ক্ষমতায় ছিল। এরপরেও ২০০১ থেকে পাঁচ বছর। দেশের মূল অর্থনীতির এখনও ৯০ ভাগ তাদের হাতে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ওইভাবে অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বোঝে না। তাই তাদের হাতে মেওয়া রেখে এখনও সবটুকু খাচ্ছে জামায়াত-বিএনপি। যে কারণে প্রকৃত ছাত্রলীগের ছেলেমেয়েরা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কোথাও চাকরি পাচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ঢুকতে পারছে না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কেউ শিল্প গড়তে গেলে প্রশাসন, ব্যাংক সবই নানানভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সদস্যরা এখনও প্রশাসনসহ সর্বত্র সহযোগিতা পায় আগে ভাগে। বাস্তবে শেখ হাসিনা নিয়োগ দেন বটে, তবে অধিকাংশ নিয়োগ সিনহার নিয়োগের মতো হয়ে যায়। নিয়োগ পাবার আগে তারা খুবই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, স্বাধীনতার পক্ষের থাকে। নিয়োগ পেলেই বেরিয়ে আসে তাদের আসল রূপ, দেখা যায় শান্তি কমিটির সদস্য। তবে বাস্তব সত্য হলো যতদিন না এদেশের অর্থনীতি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের হাতে আসবে, ততদিন এ দেশ থেকে রাজাকার, আলবদরদের দৌরাত্ম্য কমানো যাবে না। আর এই অর্থনীতি, সামাজিক শক্তি, প্রশাসনিক শক্তি যতই মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, শহীদ পরিবারের হাতে আনার চেষ্টা হবে, ততই তাদেরকে নানান কৌশলে ঠেকিয়ে দেয়া হবে। যেমন, এই রাজাকার, আলবদরের সন্তান, ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতৃত্বের আন্দোলনে এ দেশে বাতিল হলো মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানদের চাকরির কোটা। এ জাতি ভবিষ্যতে এ লজ্জা কোথায় রাখবে ভেবে পাই না। শুরুতেই যে যা ভুল করুক, এই আন্দোলন যে ইসলামী ছাত্রশিবির ও বিএনপির নেতৃত্বে হয়েছে তাতে এখন আর কোন প্রশ্ন নেই। যেমন, আমার লেখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে তাদের বক্তব্য এসেছে- ‘এ দেশে ভালো কোন আন্দোলন হলেও কি তাতে শিবির যোগ দিতে পারবে না?’ এর উত্তর অত্যন্ত সোজা। শিবিরের কোন আন্দোলনে যোগ দিতে পারা নয়, বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্রশিবির গড়ে তোলার কোন অধিকারই থাকা উচিত নয়। কারণ, তাদের নেতা কারা? যারা রাজাকার, আলবদর, ধর্ষক, খুনী ছিল, তারাই তো ছাত্রশিবিরের মূল দলের নেতা। আর স্বাধীন দেশে এই সংগঠনটি করার পরে কী করেছে তারা? এ দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের রগ কেটে হত্যা করেছে, প্রগতিশীল শিক্ষকদের হত্যা করেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তারা পুলিশ হত্যা করেছে। পুলিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে। পুলিশ কে? পুলিশের শরীরে এদেশের রাষ্ট্রীয় পোশাক। অর্থাৎ তারা রাষ্ট্রের প্রতীক। তাই ইসলামী ছাত্রশিবির মূলত এই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এ কারণে কোন ভাল আন্দোলন কেন, ছাত্রশিবির পরিচয়ের যে কারোরই বিচারের আওতার বাইরে থাকার কোন যুক্তি নেই। শিবির পরিচয় হলে যেই হোক তাকে বিচারের আওতায় আনা উচিত। আর এটা করতে হলে প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের, শহীদ পরিবারের সন্তানদেরকেই আসতে হবে। আনতে হবে তাদেরকে। নইলে পাকিস্তানী ও সেমি পাকিস্তানী রক্ত দিয়ে কোন মতেই বাংলাদেশ তৈরি করা যাবে না। সেমি পাকিস্তানী রক্তের ভাষা কি দেখুন, আমার ফেসবুকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাকের ছবি শেয়ার করার পরে এক সেমি পাকিস্তানী রক্তধারী লিখেছে, ‘আমি মনে করি কোটা ব্যবস্থা উঠে গেলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা মূল্যায়ন পাবেন, কারণ চাকরি করার সুযোগ না থাকলে কেউ টাকা খরচ করে ভুয়া মু্িক্তযোদ্ধা হবে না। তখন আসল মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।’ খুব সচেতনভাবে লক্ষ্য করে দেখুন এসব সেমি পাকিস্তানী রক্তধারীদের মূল উদ্দেশ্য কি? সে বলছে, কোটা উঠে গেলে আর চাকরি পাবার সুযোগ থাকবে না। অর্থাৎ, শুরুতেই যে কথা বলেছি, রাজাকার, আলবদর ও এই সব সেমি পাকিস্তানী রক্তধারীদের মূল উদ্দেশ্য, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়া। যাতে তারা সমাজের কোন স্থানেই দাঁড়াতে না পারে। যাতে তারা প্রশাসনে কোন চাকরি না পায়। এখনও সমাজে, প্রশাসনে এই রাজাকারের সন্তানদের অবস্থান কত শক্তিশালী তা বোঝা যায়, কয়েদি হওয়া সত্ত্বেও দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে কয়েদির পোশাক পরানো হয় না। তাই বাংলাদেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে এখনও অনেক চোখ কান খোলা রাখতে হবে। যে ইমরান এইচ সরকার জয় বাংলা স্লোগান বুকে নিয়ে শাহবাগে এলো, সেই আবার রাজাকার, আলবদর সন্তানদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে শামিল হলো। ইমরানের মতো তরুণরা যদি সব কিছু এতটা সাধারণ চোখে দেখে তাহলে এ দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফেরানো যাবে না। ইমরান এইচ সরকার রাস্তায় নামার আগে একবার ভেবে দেখতে পারল না, তাদের আন্দোলন মূলত মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও নারী কোটার বিরুদ্ধে। দুটোই মৌলবাদী স্বাধীনতা বিরোধীদের ইস্যু। তারা যেমন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারগুলো ধ্বংস করতে চায়, তেমনি নারীদেরও ঘরের মধ্যে বেঁধে রাখতে চায়। তারা কখনও নারী মুক্তি চায় না। কারণ, এরা নিজের পরিবারের নারীদের নিয়ে ১৯৭১-এ কী করেছে? সাংবাদিকতা করতে গিয়ে অনেক খবর পেয়েছি, বহু রাজাকার পরিবার, আলবদর পরিবার পাকিস্তানী সেনাদের বাড়িতে দাওয়াত দেয়ার পরে তাদের মেয়েদের, স্ত্রীর ওপর চোখ পড়তো পাকিস্তানী সেনাদের। আর তারা তাদেরকে ‘কমফোর্ট লেডি’ হিসেবে পাকিস্তানীদের কাছে দিয়েছে। তাদের ইজ্জত রক্ষার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়নি। রাজাকার, আলবদর সন্তানদের রক্তে এভাবেও সেমি পাকিস্তানী রক্ত রয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে আরও অনেক বেশি চোখ কান খোলা রেখে আগামীতে এগোতে হবে। বাংলাদেশ থেকে যাতে এই রাজাকার, আলবদর ও সেমি পাকিস্তানী রক্ত চিরতরে উচ্ছেদ হয় তার জন্যে তাদেরকে সর্বস্ব পণ করে নামতে হবে। কারণ, দেশটি তাদের। তাদের পিতা-মাতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এ দেশ। এখানে আর যেন কোনদিনই রাজাকার, আলবদররা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে কাজটি তাদের করতে হবে। দেশের অর্থনীতি এখনও রাজাকার আলবদরদের হাত থেকে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধার সপক্ষের হাতে দিতে পারেনি। নতুন প্রজন্মকে সেটা করতে হবে। এর বিকল্প কিছু ভাবার সুযোগ নেই। [email protected]
×