ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল ২০১৮

প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ্বাস

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ২৩ মে ২০১৮

প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ্বাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ এ প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আশ^াস দিয়েছে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ওই বিলের বহুল আলোচিত ৩২ ধারাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ধারাগুলোতে সংশোধনীর পর আবারও আলোচনার মাধ্যমে বিলটি চূড়ান্ত করা হবে। গণমাধ্যমের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়, এমন কোন বিধান আইনে থাকবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বিলটি অধিকতর যুগপোযোগী করার লক্ষ্যে সংবাদপত্র সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস কাউন্সিল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং বেসরকারী টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন-এ্যাটকোরসহ সুবিধাভোগীদের (স্টেক হোল্ডার) সঙ্গে বৈঠক করে সংসদীয় কমিটি। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ। বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেন ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার এবং আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। বৈঠকে কমিটির সদস্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, শওকত হাচানুর রহমান (রিমন), কাজী ফিরোজ রশীদ ও হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কমিটির আমন্ত্রণে অংশ নেন এ্যাটকোর প্রেসিডেন্ট সালমান এফ রহমান ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাম্মেল হক বাবু, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সরওয়ার ও দি ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম এবং বিএফইউজের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল ও মহাসচিব ওমর ফারুক। কমিটি সূত্র জানায়, বৈঠকের শুরুতে দেশকে এক ধাপ এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু-১ সাটেলাইট সফলভাবে উৎক্ষেপণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কমিটির পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানানো হয়। এরপর ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ এর ওপর উপস্থিত স্টেকহোল্ডাররা সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখেন। এ সময় বিলের ধারা ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২ ও ৪৩-এর ওপর বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনাকালে কমিটির সদস্যরা কয়েকটি বিষয়ে সংশোধনী ও কিছু বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা সংযোজনের বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন। বিলটিকে অধিকতর যুগপোযোগী করার লক্ষ্যে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো যুক্ত করে পরবর্তী বৈঠকে সুপারিশ চূড়ান্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানে বাকস্বাধীনতার কথা বলা আছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথাও বলা হয়েছে। তাই সংবিধানের বিপরীতে বা সাংঘর্ষিক কোন আইন আমরা করতে পারি না। আর সাংবাদিকতা ব্যাহত করা আমাদের উদ্দেশ্য না। তাই কাউকে টার্গেট করে কোন আইন করা হবে না। আইন করা হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। তিনি বলেন, কমিটির বৈঠকে বিলের ৮টি ধারা নিয়ে প্রস্তাব এসেছে। বৈঠকে আমরা একমত হয়েছি, ওই আইনের কিছু ধারা ও শব্দ সংজ্ঞায়িত করা উচিত। যেগুলো ষ্পষ্ট না। যেমনঃ বিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হলেও সে বিষয়ে ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু সাংবাদিকরা এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। যেটা যুক্ত করা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে বিলের কোন ধারায় কোন সংশোধনী প্রয়োজন হলে বা নতুন কোন শব্দ বা বাক্য যুক্ত করা প্রয়োজন হলে তা করা হবে। এরপর আবারও সকলের সঙ্গে বসে বিলটি চূড়ান্ত করা হবে। আসন্ন বাজেট অধিবেশনে বিলটি পাস হবে কিনা জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, বাজেট অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন। অধিবেশনটি বাজেট নিয়ে আলোচনার জন্য। এই অধিবেশনে বিশেষ জরুরী বিল ছাড়া সাধারণত কোন আইন পাস হয় না। তাই বিলটি এই অধিবেশনেই পাস হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা অপব্যবহার রোধে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশের বিশেষ সেল থেকে অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত মামলা রুজু হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর ৫৭ ধারায় মামলা শতকরা ৯৫ ভাগ কমেছে। নতুন ডিজিটাল আইন কার্যকর হলে ওই ৫৭ ধারা বাতিল হবে বলে তিনি জানান। এদিকে বিলে বেশ কিছু সংশোধনী আনা হবে জানিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার বলেন, সাংবাদিক প্রতিনিধিরা যে ধারাগুলোর ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা একমত হয়েছি। নতুন আইনটি সংবাদপত্রের জন্য যাতে বাধা না হয় এবং গণমাধ্যম যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা বিলে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনব। বৈঠক শেষে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সারওয়ার বলেন, বৈঠকে অত্যন্ত ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। বিলের যে সকল ধারায় সাংবাদিকদের অবাধ বিচরণের ক্ষেত্রে বাধা আছে, সেসব দূর করতে বলা হয়েছে। মন্ত্রী এসব গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন। এই বিল চূড়ান্ত হওয়ার আগে আরেকবার বসা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা নিশ্চিত হতে চাই, সেখানে যেন কোন বিতর্কিত ধারা না থাকে। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেন, যে সকল ধারাতে স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতিবন্ধক কিছু আছে তা আমরা তুলে ধরেছি। সাংবাদিকদের দুশ্চিন্তার বিষয়টি উনারা খুবই সহানুভূতির সঙ্গে গ্রহণ করছেন। আমরা আশা করছি আইনে আমূল পরিবর্তন আসবে। আইনমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, এটি ফাইনাল ফর্মে দেয়ার পর আমাদের সঙ্গে আরেকবার বসবেন। যা অত্যন্ত ইতিবাচক বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রস্তাবিত আইন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগগুলো বৈঠকে তুলে ধরা হয়েছে জানিয়ে বিএফইউজের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয় এমন আইন পাস না করার আহ্বান জানানো হয়েছে। আর আইনে এমন কোন ধারা রাখা যাবে না, যাতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হয়। তিনি আরও বলেন, এই আইনে এমন ধারা থাকা উচিত, যাতে সাংবাদিকদের বিচারের ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিলকে ক্ষমতা দেয়া হয়। প্রেস কাউন্সিলই সিদ্ধান্ত নিবে, অভিযুক্ত সাংবাদিকতা করেছে, না অপসাংবাদিকতা করেছে। যেসব ধারা নিয়ে আপত্তি ॥ বিভিন্ন মহলের আপত্তি সত্ত্বেও গত ৯ এপ্রিল বহুল আলোচিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। ওই বিলের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে- কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ : যদি কোন বেআইনী প্রবেশের মাধ্যমে কোন সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ কোন সংস্থার কোন ধরনের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তি বলে গণ্য হবে। এর শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদ- বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। ধারা (৮) বলা হয়েছে- কতিপয় তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষমতা : মহাপরিচালক নিজ অধিক্ষেত্রভুক্ত কোন বিষয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোন তথ্য-উপাত্ত ডিজিটাল নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি সৃষ্টি করলে তিনি উক্ত তথ্য উপাত্ত অপসারণ বা ক্ষেত্রমত, ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবেন। এক্ষত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যদি মনে হয় ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোন তথ্য-উপাত্ত দেশের বা তার কোন অংশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকা-, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণœ করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহলে উক্ত তথ্য বা উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ করা যাবে। ধারা (২১) বলা হয়েছে- মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রোপাগা-া বা প্রচারণা অপরাধ। এতে বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রোপাগা-া ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন তাহলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর শাস্তি হিসেবে ১৪ বছরের কারাদ- বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। ধারা (২৫) বলা হয়েছে- আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত পাঠানো, প্রকাশ ইত্যাদি অপরাধ বলে গণ্য হবে। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে এমন কোন তথ্য পাঠান যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক বা এমন কোন তথ্য সম্প্রচার বা প্রকাশ করেন, যা কোন ব্যক্তিকে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ করতে পারে। তাহলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং এর শাস্তি অনধিক ৫ বছরের কারাদ- বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- হতে পারে। ধারা (২৮) বলা হয়েছে- ওয়েবসাইট বা কোন ইলেকট্রনিক বিন্যাসে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোন তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করলে অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি ৭ বছরের কারাদ- বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-। ধারা (২৯) বলা হয়েছে- মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সম্প্রচার করলে তা অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি ৫ বছরের কারাদ- বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-। ধারা (৩১) আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর অপরাধ বা দ-: যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন যার কারণে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটনায় তাহলে অপরাধ বলে গণ্য হবে। এর শাস্তি ৭ বছরের কারাদ- বা ৫ লাখ টাকা অর্থ দ- বা উভয় দ-।
×